ডকুমেন্টারি থিয়েটার আসলে কী? একটা গল্পকে প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে নতুন করে বলা, যা কিনা প্রকৃত ঘটনা ও কল্পকাহিনীর মধ্যে নতুন সম্পর্ক গড়ে দেবে, যোগসূত্র তৈরি করবে ব্যক্তিগত পরিসর আর রাজনীতির মধ্যে! এখানে এই যোগসূত্রটা তৈরি হয় নির্দেশক ও নাট্যকারের দর্শনের হাত ধরে, তারা কিভাবে প্রকৃত ঘটনার ব্যাখ্যা করছেন, তার মাধ্যমে! আর যদি নাটকটি আত্মজৈবনিক হয়, তাহলে শুকনো তথ্যের বদলে মূল চরিত্রের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা স্মৃতির গুরুত্ব অনেক বেশি। ‘উপল ভাদুড়ী’ নাটকটি ডকুমেন্টারি থিয়েটারের এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যই সফলভাবে আত্মস্থ করেছে, নাট্যকার তথা নির্দেশক তথা ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার রাকেশ ঘোষের হাত ধরে।
‘উপল ভাদুড়ী’ নাটকটির বিষয় হল বর্ষীয়ান অভিনেতা শ্রী চপল ভাদুড়ীর অভিনয় জীবনের প্রায় আশি বছরের যাত্রাপথ। একটা সময় ছিল যখন বাংলা নাটক বা যাত্রাপালায় পুরুষরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। চপল ভাদুড়ী ছিলেন এমনই এক অভিনেতা, আর তার জনপ্রিয়তা ও ছিল আকাশ ছোঁয়া! কিন্তু ক্রমে বাঙালি মহিলারা সামাজিক বাধা গুলো পার করে নাটক বা যাত্রামঞ্চে পা রাখতে শুরু করলেন, আর চপল ভাদুড়ীর মতো অভিনেতাদের চাহিদাও কমতে শুরু করল। স্বাভাবিকভাবেই, থাবা বসল তাদের রোজগারে। তবে চপল ভাদুড়ীর কাছে অভিনয়টা শুধুমাত্র রোজগার-কেন্দ্রিক ছিল না; আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল দর্শকদের কাছে নিজের অভিনয় দক্ষতাকে মেলে ধরতে পারা, বা তাদের মুগ্ধ করতে পারা! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সুযোগটাই কমে আসছিল। তার জীবনের এই অংশটাকে ঠিকঠাক করে তুলে ধরতে পারা কিন্তু বেশ কঠিন। আমরা সবাই জানি যে তার জীবন নিয়ে একটা ফিল্ম হয়ে গেছে। তবে সেই ফিল্মের মূল ফোকাস ছিল তার নারীসত্ত্বা, যার প্রভাবে তিনি নিজেকে পুরুষের বদলে সবসময় একজন নারী বলেই মনে করতেন। ঐ বিশেষ দিকটাই মুখ্য হয়ে ওঠায় ফিল্মের দর্শকদের পুরো মনোযোগটাই চলে যায় চপল ভাদুড়ীর যৌনতা বোধের দিকে, শিল্পী হিসাবে তার সংগ্রাম চলে যায় পিছনের সারিতে!
Previous Kaahon Theatre Review:
এই রিপ্রেজেন্টেশনের রাজনীতিটাকে পরিচালক রাকেশ ঘোষ এই নাটকে বদলে ফেলতে পেরেছেন। চপল ভাদুড়ীর সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন জনিত যাবতীয় অহেতুক কৌতুহলকে প্রাণপণে দূরে সরিয়ে রেখে তিনি সামনে নিয়ে এসেছেন তার শিল্পীসত্ত্বাকে। তাই বলে তার নারীসত্ত্বার দিকটিকে কিন্তু নাটকে অবহেলা করা হয়নি। সেই নারীসত্ত্বা, যে কিনা অভিনয় কলায় প্রবল পারদর্শী, পুরুষের শরীরে বাস করেও নারীর অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে চূড়ান্ত ভাবে সক্ষম, এবং সেই কারণেই সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। কিন্তু সেই সফল নারীসত্ত্বাই অন্যদিকে আবার বারে বারে পুরুষের প্রেমে পড়ে আঘাত পায়, সহজে প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারে না! একজন শিল্পী হিসেবে তিনি অর্জন করেন অনেক সন্মান, ভালোবাসা, ক্ষমতা; আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিই ডুবতে থাকেন অনন্ত হতাশা আর দারিদ্র্যে, একজন শিল্পীর অপূর্ণতার বেদনাকে সঙ্গে নিয়ে। এই হল চপল ভাদুড়ীর জীবনের আসল ট্র্যাজেডি, দর্শক যাকে একেবারে অন্তঃকরণ দিয়ে অনুভব করতে পারেন এই নাটকে। আর এটা সম্ভব হয় মূল চরিত্রে স্বয়ং চপল ভাদুড়ী এবং পাশাপাশি রঞ্জন বোসের অসাধারণ অভিনয়ের গুণে। শুধু তাই নয়, বাকি সমস্ত ছোট বড় চরিত্রগুলিও খুব বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেন, আর দর্শককে বাংলা থিয়েটারের সেই ফেলে আসা সময়ের মধ্যে টেনে নিয়ে যান। বাবলু সরকারের আলোক ভাবনা, অতনু সরকারের সিনোগ্রাফি, অভিজিৎ আচার্য্যরসঙ্গীত, এইসব কিছুর যথাযথ সঙ্গতি নাটকটিকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়।
ডকুমেন্টারিতে প্রামাণ্য তথ্যগুলো সাধারণত ইন্টারভিউ, রেকর্ডিং, নথিপত্র, ভিডিও, বা আলোকচিত্রের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়। এই নাটকে কিন্তু অতীতের ঘটনাগুলো আসে একটা বিশেষ ধরণের পারফরমেটিভ ডিজাইন আর কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অডিওভিজুয়াল উপকরণ ব্যবহারের প্রলোভন জয় করতে পারাটা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। নাটকটি মেলোড্রামার ধারা অনুসরণ করলেও তার পরিবেশন পদ্ধতি কিন্তু যথেষ্ট আধুনিক। নাটকের অভিনয় শৈলী বাংলার ইতিহ্যবাহী যাত্রা পালার মতো, কিন্তু দর্শকের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে সহজেই ছুঁয়ে যেতে পারে। আর সেট, আলো, কোরিয়োগ্রাফির চমৎকার সমণ্বয়ে দর্শক একটা চূড়ান্ত আধুনিক নাট্যঅভিজ্ঞতা মুখোমুখি হন। তবে কিছু সংলাপের পুনরাবৃত্তি এড়ানো গেলে আরও ভালো হত।
চপল ভাদুড়ীর শিল্পী জীবনের যাত্রাপথটি হল প্রতিকূল পরিবেশে জীবন সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক! সেই সংগ্রামী জীবনভিত্তিক এই আধুনিক মঞ্চায়ন তাই দর্শককে সমৃদ্ধ করে, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও জীবনের সম্ভাবনার প্রতি আস্থা রাখতে প্রেরণা জোগায়।
বাংলায় অনুবাদঃ অঞ্জন নন্দী