সাধারণ মানুষের ভাবাবেগ আর ধর্ম ভীরুতাকে কাজে লাগিয়ে, সাথে লোভ এবং সীমাহীন চাহিদার সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ধর্মীয় আবরণের আড়ালে ধর্মকেই পুঁজি করে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে – এ সমন্ধে আমরা অবগত নই এমনটা নয়। ধর্মকে নিয়ে এই ব্যবসা আজ এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে চলে গেছে। ভণ্ড আর অসৎ ধর্মগুরুর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমন অন্যদিকে তাদের অসততা প্রকাশ পাচ্ছে জনসমক্ষে, তবুও সবকিছু জেনে বুঝে মানুষ সেই ফাঁদেই পা দিচ্ছে বারবার। নানা কৌশলে মানুষকে ঠকিয়ে এই ব্যবসা ক্রমেই ফুলে ফেঁপে উঠছে। কিন্তু কিভাবে বেড়ে উঠল এই কারবার, এর পিছনে রয়েছে কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত রাজনীতি আর ষড়যন্ত্র, কিভাবে দখল হয়ে গেল সরল ধর্মভীরু মানুষের মানব জমিন? এইসব প্রশ্নের খোঁজ করেছে শ্যামবাজার নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাটক ‘দখলনামা’।
গত ৫ই মার্চ তপন থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই নাটকের চতুর্দশতম অভিনয়। এর পরে আরও দু’একটি অভিনয় হয়েছে প্রযোজনাটির। নাটকটি রচনা করেছেন সৌমেন পাল এবং নির্দেশনা সমরেশ বসু।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে নাট্যকার সৌমেন পাল যে বিষয়বস্তু এবং বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠান ও মানুষকে ইঙ্গিত করে নাট্য আখ্যানটি রচনা করেছেন তা বিশেষ সাহসিকতার পরিচায়ক। নাটকের কাহিনীটি খুব সহজ ভাবে তার পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়, তবে এই অগ্রসর যে নিপুণতার সাহায্যে করা হয়েছে তা দর্শকদের মনকে আকৃষ্ট করে। প্রতিটি চরিত্র ও তার সংলাপ রচনায় চিন্তাশীলতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। অপ্রয়োজনীয় কোনো চরিত্র বা সংলাপ নাটকে নেই বললেই চলে। ফলে নাটকের শরীর নির্মেদ হয়েছে এবং মূল বিষয়বস্তু সঠিকভাবে দর্শকদের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি চরিত্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে।
Previous Kaahon Theatre Review:
নাটকের মূলচরিত্র কৃষ্ণলোচন একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, ভক্তিবাদী, ও আদর্শে অবিচল মানুষ। একটি মন্দির সংলগ্ন একখন্ড জমিই তার একমাত্র সম্বল। অভাব অনটন তার নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু কোন রকম লোভ তাকে আদর্শ থেকে টলাতে পারে না। একদা তার এই ভিটেতে শ্রীচৈতন্যদেবের পদধূলি পড়েছিল বলে শোনা যায়। এই বিষয়কে হাতিয়ার করে ধর্মব্যবসায়ীর দল (এমস্কন, শ্রীজীব গোঁসাই) ঐ জমির দখল নিতে চায় বাজারদরের পাঁচ বা দশগুণ দাম দিয়ে। ছদ্মবেশী শিষ্য ব্রজকিশোর আবার কৃষ্ণলোচনকে চৈতন্যদেবের অবতার রূপে প্রচার করে তার শিষ্য সংখ্যাবৃদ্ধি করে প্রচুর অর্থ উপার্জনের লোভ দেখায়। কিন্তু কৃষ্ণলোচনকে কিছুতেই রাজি করানো যায় না। তখন ব্রজকিশোর কৌশলে অর্থলোভ দেখিয়ে কৃষ্ণলোচনের পুত্র শ্যামলোচন ও স্ত্রী চন্দ্রাবতীর কাছ থেকে চুক্তিপত্র লিখিয়ে নেয়। কৃষ্ণলোচন হার না মেনে এদের বিরুদ্ধে আইনের সহায়তা নেয়। তখন পথের কাঁটা কৃষ্ণলোচনকে সরাতে ব্রজকিশোর চক্রান্ত করে শ্যামলোচনকে বাধ্য করে নিজের হাতে তার বাবাকে খুন করতে । এরপর শ্যামলোচন উপলব্ধি করে যে অর্থলোভে সে কত বড় ভুল করে ফেলেছে। পিতৃহত্যার দায় নিয়ে সে গভীর অনুশোচনায় বিলাপ করতে থাকে। এই মর্মান্তিক পরিণতিতে নাটক শেষ হয়।
নির্দেশক সমরেশ বসু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অত্যন্ত সহজ সরলভাবে কিন্তু বলিষ্ঠতার সাথে দর্শকদের সামনে যেভাবে উপস্থাপনা প্রশংসার দাবি রাখে। প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করলেই বৈষ্ণব আখড়ার পরিবেশ অনুভূত হয়, প্রত্যেক দর্শকের কপালে চন্দনের ফোঁটা আর হাতে নকুলদানা প্রসাদ দিয়ে আপ্যায়নের মাধ্যমে, ও নেপথ্য চলতে থাকা কীর্তনের সুরমূর্চ্ছনা, ধূপধুনার গন্ধ এক ভক্তিরসের পরিবেশ সৃষ্টি করে। সৃষ্ট এই বাতাবরণ নাটক শুরুর আগেই নাট্যঘটনার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে দেয়। পর্দা খোলার সাথে সাথে মঞ্চ ও দর্শকদের মধ্যে ব্যবধান সহজেই ঘুচে যায়। নির্দেশকের দৃশ্যভাবনা ও মঞ্চে চরিত্রদের অবস্থানের (composition) মধ্যে একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়। নাটকের স্বাভাবিক ও স্বতস্ফূর্ত চলনে কয়েকটি সুন্দর নাট্যমুহূর্ত তৈরি হয় যা নাটকে বিশেষ ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে।
অভিনয়ের দলগত সংহতি এই প্রযোজনাটিকে বিশেষ মাত্রা দান করে। সবকটি চরিত্রই এখানে গুরুত্বপূর্ণ, তাই অভিনয়ের মধ্যে একটা নির্দিষ্টমান বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রত্যেক অভিনেতা তাদের স্ব স্ব চরিত্রগুলিকে সংলাপ উচ্চারণ, চলাফেরা, অভিব্যক্তি, মডুলেশন প্রভৃতির মাধ্যমে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে যোগ্যতানুসারে চেষ্টা চালিয়েছেন। কৃষ্ণলোচনের চরিত্রে শ্যামাশিস পাহাড়ী তার সততা, আদর্শ ও নিজের বিশ্বাসের প্রতি অবিচল থাকার দৃঢ়তা সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন। তার কন্ঠের গানগুলি যেমন সুন্দর তেমনই সাবলীল। সংসারের অভাব অনটনে দিশেহারা চন্দ্রাবতীর (কৃষ্ণলোচনের স্ত্রী) চরিত্রটিকে বিশেষ ভঙ্গির উচ্চারণ ও চলাফেরা দিয়ে যোগমায়া বসু বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, তবে তা সর্বদাই চেষ্টা-কৃত মনে হয়ছে, স্বাভাবিক (natural) অভিনয়ের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। অধরের চরিত্রে নীলাভ চট্টোপাধ্যায় বরাবরের মতই স্বাভাবিক। খলচরিত্র ব্রজকিশোরের ভূমিকায় প্রসেনজিৎ বর্ধন এককথায় চমৎকার, মিনার্ভা রেপার্টরির এই প্রাক্তনীর বহুমুখী (versatile) অভিনয় প্রতিভার নিদর্শন পূর্বে দর্শকরা বহু নাটকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি এই সময়ের একজন বলিষ্ঠ অভিনেতা এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
সঙ্গীত ও আবহ (কঙ্কন ভট্টাচার্য) এই প্রযোজনার সম্পদ। একক ও কোরাসে অনেকগুলি গান ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু কোন গান অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়নি। সমগ্র নাট্য উপস্থাপনার সাথে গানগুলি মিলে মিশে গেছে। নাট্য পরিস্থিতি অনুসারে এমন করে গানের ব্যবহার করার জন্য বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়। সঠিক পরিবেশ বজায় রাখতে বা বিশেষ নাট্যমুহুর্ত তৈরি করতে সৌমেন চক্রবর্তীর আলোকপরিকল্পনা নিঁখুত প্রক্ষেপণের সাহায্যে সুন্দর কাজ করেছে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মঞ্চ খুবই ছিমছাম। সামান্য উপকরণের সাহায্য মঞ্চটিকে বাস্তবরূপ দান করেছেন। মঞ্চে কোনো মন্দির বা বিগ্রহ না রেখে তিনি চমৎকার ভাবে ধর্মকে নিদিষ্ট গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ না করে বৃহত্তর ভাবনার পরিসরে উর্ত্তীণ করেছেন। যোগমায়া বসুর পোশাক পরিকল্পনার মধ্যে ভাবনার ছাপ আছে। অতি সাধারণ পোশাক-আশাকের দ্বারা চরিত্রগুলিকে বিশ্বাসযোগ্যতার স্তরে নিয়ে গেছেন।
শুধুমাত্র কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই ধর্মকে পুঁজি করে স্বার্থসিদ্ধির কাজে লিপ্ত আছে তাই নয় , চিন্তার বিষয় এই যে রাষ্ট্রক্ষমতাও রাজনৈতিক ফায়দা তোলবার জন্য ধর্মের সাথে রাজনীতি আর রাজনীতির সাথে ধর্মকে মিলিয়ে দিয়ে অর্থাৎ ধর্মের রাজনীতিকরণ বা রাজনীতির ধর্মীয়করণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে। সবকিছু অবগত হবার পরও আমরা অদ্ভূত এক নীরবতার মধ্যে রয়েছি। শ্যামবাজার নাট্যচর্চাকেন্দ্রের নাটক ‘দখলনামা’ এই নীরবতা ভাঙার আহ্বান করে। সবশেষে নাট্যকার, নির্দেশক ও দলের সদস্যদের কুর্নিশ জানাই এরকম একটি প্রযোজনা উপহার দেবার জন্য।