যব শহর হামারা সোতা হ্যায় – একটি বলিষ্ঠ নাট্য প্রযোজনা

Posted by Kaahon Desk On March 8, 2019

উইলিয়াম শেক্সপীয়রের ‘রোমি ও জুলিয়েট’ এর অনুপ্রেরণায় Arthur Laurents ১৯৫৭ সালে মিউজিকাল ড্রামা ‘West Side Story’ লেখেন। ১৯৬১সালে Robert Wise এবং Jerome Robbins কৃত West Side Story-র চলচ্চিত্র রূপটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ একাধিক অস্কার পুরস্কার লাভ করেছিল। এর বিষয়বস্তু চিরকালীন, তার জন্য নাটকটি বহু দেশে বহু ভাষায় অনুদিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে এবং হয়ে চলছে। বিখ্যাত ভারতীয় থিয়েটার ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র অভিনেতা ও সুগায়ক পীযুষ মিশ্র West Side Story হিন্দিতে রূপদান করেন এবং তার পরিচালনায় মঞ্চস্থও হয়।তার লেখনীর গুণে নাটকটি সম্পূর্ণ ভারতীয় রূপ পেয়েছে।

পীযূষ মিশ্রের নাটকটি হিন্দি ভাষাতেই কলকাতার ‘অ্যাক্টো’ নাট্যদল তাদের নবতম প্রযোজনা হিসেবে গত ৩০শে জানুয়ারি গিরীশ মঞ্চে অভিনয় করল। নির্দেশনা শ্রীদীপ চট্টোপাধ্যায়। বর্তমান সময়ের রাজনীতিতে গনতন্ত্রের বর্মের আড়ালে যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আর দমনপীড়নের উন্মত্ত খেলা শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধে এই নাট্যপ্রযোজনা এক প্রতিবাদ স্বরূপ। অ্যাক্টো দলটি প্রতিষ্ঠার (২০১৫) পর থেকে ‘ওরে বিহঙ্গ’, ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’, ‘ত্রস্ত্র নিলীমা’ প্রভৃতি নাট্য প্রযোজনার মাধ্যমে সমাজের প্রতি সচেতনতা ও দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়ে এসেছে। বর্তমান প্রযোজনাটিতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

Previous Kaahon Theatre Review:

দেশভাগের বহুদিন পরেও বর্তমান প্রজন্মের যুবকদের মনে জমে থাকা রাগ আর জীবনযুদ্ধের যন্ত্রণার ফলে তাদের বিভ্রান্ত মানসিকতা ও যৌবনের উদ্দীপনা এই নাটকে দেখানো হয়েছে।আবার অপর দিকে ‘প্রেম’ কিভাবে যৌবনের উগ্র উন্মাদনাকে ও শিথিল করে দিতে পারে তার সুন্দর ছবি এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ‘খঞ্জর’ আর ‘ফনিয়‍র’ দুটি যুবগোষ্ঠি (গ্যাং) একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। করিমপুরায় বসবাসকারী গ্যাং খঞ্জরের দলনেতা আসলাম আর সুহাসধাম অঞ্চলের বসবাসকারীদের গ্যাং ফনিয়রের দলনেতা বিলাস। এরা একটি নিদিষ্ট এলাকার দখল নেবার জন্য নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। ধর্মীয় পৃথকীকরণের জন্য খঞ্জর ও ফনিয়‍র একে অপরকে ঘৃণা করে। এক গ্রামীন জলসায় খঞ্জরের দলনেতা আসলামের বোন তারানা ও ফনিয়রের এক সদস্য আভাস একে অপরকে দেখে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যায়। দু’দলের সদস্যরা কেউই সহজে মেনে নিতে পারে না। নানা বাধা পেরিয়ে আভাসও তারা না গোপনে দেখা করতে থাকে এবং তাদের ভালোবাসা গভীর হয়। এদিকে দুদলের মধ্যে এক শেষ ফয়সালার পরিকল্পনা হয়, যারা এই লড়াইয়ে জিতবে এলাকা তাদের দখলে থাকবে আর লড়াই চিরকালের মত শেষ হবে। আভাস আর তারানার প্রেম কি পরিণতি পাবে এই লড়াইয়ে শেষে, যে লড়াই তাদের আশে পাশের প্রিয় মানুষদের ধ্বংস করবার ভয় দেখায়?

পীযুষ মিশ্রের নাটক ‘যব শহর হামারা সোতা হ্যায়’ মূলতঃ গানও কোরিওগ্রাফের উপর নির্মিত মিউজিকাল প্লে। এখানে নির্দেশক শ্রীদীপ চট্টোপাধ্যায় এটিকে মিউজিকাল প্লে হিসেবে পরিবেশন না করলেও কয়েকটি গানও গানের অংশ খুব দক্ষতার সাথে অর্থবহ করে ব্যবহার করছেন। শুরুতে শিরোনাম সঙ্গীতটির নাচের দৃশ্য পরিকল্পনাটি চমৎকার। ‘উজালা হিউজালা’ গানটির সাথে আভাস ও তারানার স্বল্প সময়ের নৃত্য দৃশ্যটি সুন্দর নাট্য মুহূর্ত তৈরি করে যা মনে থাকার মত। নাটকটি বেশ কয়েকটি দৃশ্য দিয়ে তৈরি এবং অনেকবার দৃশ্য পরিবর্তন আছে। এই দৃশ্য পরিবর্তনগুলি যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং নূন্যতম সামগ্রী অদল বদলের মাধ্যমে দৃশ্যপট রচনা করা হয়েছে তা বেশ ভাবনা প্রসূত, নাটকের গতিকে কখনো ব্যাহত হতে দেয় না। নির্দেশক এক ঝাঁক তরুণ তরুণীদের সুশৃঙ্খল ভাবে কাজে লাগিয়ে নাট্যপ্রযোজনাটি পরিবেশন করেছেন। তাদের কাজের মধ্যে দীর্ঘ অনুশীলন ও অধ্যবসায়ের ছাপ লক্ষ করা যায়। অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে অনেকে অহিন্দীভাষী হলেও হিন্দী উচ্চারণ ত্রুটিহীন যা একটি প্রযোজনাকে সার্থক করে তোলার প্রাথমিক শর্ত।সামগ্রিক অভিনয়ের মধ্যে একটি দলগত প্রয়াস লক্ষ করা যায় যার মধ্যে সাবলীলতা ও স্বাভাবিকতা বর্তমান। সবার অভিনয়ের মধ্যে মোটামুটি একটা নিদির্ষ্ট মান বজায় ছিল, শুধু দু’একজন ব্যাতিক্রম হিসেবে চোখে পড়ে যেমন পুলিশ ও চাচার চরিত্রে অভিনেতাদের মধ্যে একটা কৃত্রিমতা লক্ষ করা গেছে।

নাসিকা পুরাণ - সরকারি আনুকূল্যে একটি দিশাহীন নাটক

সঙ্গীত বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পীযুষ মিশ্রের গাওয়া গানগুলি সুন্দর ব্যাঞ্জনার সৃষ্টি করে সঙ্গীত নাটকের মূলভাবটি সঠিকভাবে ব্যাক্ত করেছে। শুরু ও শেষে কোরিওগ্রাফের সাথে কোরাসে যে লাইভ গান গাওয়া হয়েছে তা দু’একজায়গায় শুনতে কিছু অসুবিধা হয়। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে নজ‍র রাখা প্রয়োজন। দৃশ্য অনুসারে আলো কমিয়ে বাড়িয়ে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। নাচের দৃশ্যে আলোক পরিকল্পনা সঙ্গীতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় দৃষ্টিনন্দন লাগে। সুচিন্তিত পোষাক নির্বাচনের ফলে চরিত্রগুলি বিশ্বাসযোগ্য লাগে।

বর্তমানে প্রতিনিয়ত আমারা একে অপরের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। হিংসা, বিবাদ, জাতিবিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা প্রভৃতি আমাদের কাছের মানুষকে শত্রু করে তুলেছে‌। চিন্তার কথা এই যে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রক্ষমতা এগুলিকে মদত দিচ্ছে। আমরা সব দেখে শুনে ও চোখ বুঁজে আছি। এ নাটক আমাদের ঘুম ভাঙ্গানোর এক প্রয়াস। সময়ের প্রেক্ষিতে আতি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় নাটকের উপস্থাপনা করেছে ‘অ্যক্টো’ নাট্যদল। তবে যুগপৎ দুঃখ ও চিন্তার বিষয় এই যে নাটক দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত ছিলেন মাত্র জনা কুড়ি দর্শক।বর্তমানে দর্শকদের মধ্যে এক বিশেষ প্রবণতা লক্ষ‍ করা যাচ্ছে। তারা নাটক দেখার আগেই বিচার করে ফেলছে ভালো ও মন্দের। এই বিচারের মাপকাঠি দলের নাম, নির্দেশকের নাম বা সিনেমা-সিরিয়ালের মুখ। এর ফলে বহু ছোট দলের পরিশ্রম আর গভীর চিন্তার সৃজন বেশ ভাল হওয়া সত্বে ও দর্শকদের কাছে পৌঁছতে পারছে না। কিছু বড়  দল, নাম করা (নাম হয়ে যাওয়া) নির্দেশক আর কিছু চেনামুখ সম্বলিত নাটকেই ভীড় করছে মানুষ। যদিও সেগুলি সব সময় উচ্চমানের হচ্ছে তা নয়। ফলে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলার নাট্যজগৎ‌। এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য ছোট দলগুলিকেই সংঘবদ্ধ হতে হবে, তারাই পারবে নতুন পথ তৈরী করতে কারণ তারা সংখ্যায় নেহাৎ কম নয়।

শেষে অ্যাক্টো দলকে ধন্যবাদ জানাতে চাই তাদের নাট্য প্রযোজনাগুলি নির্বাচনের ক্ষেত্রে মননশীলতার ছাপ রাখার জন্য। আশাকরি ভবিষ্যতে ও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us