1984? – একটি রাজনৈতিক উপন্যাসের সময়োপযোগী মঞ্চায়ন

Posted by Kaahon Desk On July 1, 2018

‘স্বপ্নসন্ধানী’ প্রযোজিত নতুন নাটক ‘1984?’-এর দ্বিতীয় অভিনয় অনুষ্ঠিত হ’ল ২৩শে জুন মিনার্ভা থিয়েটারে। জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত ও আলোড়ন সৃষ্টি কারী উপন্যাস ‘1984’ অবলম্বনে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে বঙ্গীকরণ করেছেন এই সময়ের একজন জনপ্রিয় নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। স্বপ্ন সন্ধানীর আমন্ত্রণে এই নাটকের নির্দেশকও তিনি। এই নাটকে অংশ গ্রহণ করেছে দলের প্রায় পঁচিশ জন সদস্য।

জর্জ অরওয়েলের ‘1984’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে, ইংরাজী ভাষায় প্রকাশিত শ্রেষ্ঠতম উপন‍্যাস গুলির মধ‍্যে এটিকে গণ‍্য করাহয়। এই কাহিনীর প্রভাব এমনই যে এখানে উদ্ভাবিত বেশ কিছু শব্দ পরে কথ‍্য ভাষায় চলে এসেছে, যেমন বিগ ব্রাদার, থটক্রাইম, ডাবলথিঙ্ক, টেলিস্ক্রিন, ইত্যাদি।উপন‍্যাসে অনাগত ভবিষ্যতের  জন‍্য এমন এক রাষ্ট্রশক্তির কল্পনা করা হয়েছে যা সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, এমন কি নাগরিকের ভাবনা পর্যন্ত। শুধুমাত্র দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিরোধীতাহীন সর্বগ্রাসী শক্তিগুলির উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এই উপন‍্যাস ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রসঙ্গত, ‘1984’ এবং ‘Animal Farm’, অর‌ওয়েলের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় দুটি উপন‍্যাসের বিষয় বস্তুর মধ‍্যে মিল লক্ষ‍ণীয়- সমষ্টির সামনে ব‍্যক্তির অসহায়তা, বিপ্লব এবং বিশ্বাসঘাতকতা, কঠোর শ্রেনী বৈষম‍্য, বাধ‍্যতামূলক দৈনিক ক্রিয়া ইত‍্যাদি। ‘Animal Farm’ যেমন বারে বারেই বাংলা মঞ্চে উঠে এসেছে, ‘1984’ কিন্তু সেভাবে আসেনি। তাই এই প্রযোজনার কাছ থেকে চাহিদা অনেক।

Previous Kaahon Theatre Review:

নাটকটি মোটামুটিভাবে উপন‍্যাসের কাহিনী অংশকেই অনুসরণ করে, তেমন কোন স্বাধীনতা আদায় করে নিতে চায়নি। পটভূমি এমন এক সর্বক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্র যেখানে “Big Brother is watching you” অর্থাৎ সেখানকার প্রতিটি নাগরিকের সমস্ত গতিবিধির উপর কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে টেলিস্ক্রিনের (দ্বিমুখী টেলিভিশন) মাধ‍্যমে। ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা করবার কোন অধিকার নেই। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামান্য কোন চিন্তাও ‘থটক্রাইম’। ‘থট পুলিশ’ সর্বদা মানুষের মগজে হানা দিচ্ছে। রাষ্ট্রের পক্ষে হিতকর শুধুমাত্র এমন ভাবনাই মানুষের মস্তিষ্কে সঞ্চারিত করা হচ্ছে, যেমন – যুদ্ধই শান্তি, মুক্তিই দাসত্ব, অজ্ঞানতাই শক্তি প্রভৃতি। ছোট শিশুদের বলা হচ্ছে যে তারা যেন তাদের অভিভাবকদের নজরে রাখে, অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়লেই যেন থট পুলিশকে খবর দেয়। নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপিত মানুষের উপর, ভালোবাসতে হবে শুধুই পার্টিকে, ব্যক্তিপ্রেম বা যৌন কার্যকলাপ শাস্তিমূলক অপরাধ, এমন কি রাস্তায় হাত ধরাধরি করে চলাও মানা। নাটকের মূল চরিত্র গৌতম ইসলাম (উজ্জ্বল মালাকার) একজন সাধারণ নাগরিক ও পার্টির এক সাধারণ কর্মী। মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ-এর রেকর্ডিং ডিপার্টমেন্টে তার কাজ ইতিহাসের পুনঃলিখন, অর্থাৎ রাষ্ট্র ভাবনার অনুসারী করে ইতিহাসকে নতুন রূপে তৈরি করা। গৌতম মনে মনে পার্টিকে ঘৃণা করে এবং সে চায় এই অবস্থার অবসান। মুছে ফেলা ঐতিহাসিক তথ্যগুলি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গোপনে সে একটা ডাইরিতে লিখে রাখতে চায়। ১৯৮৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল ডাইরি লেখা শুরু করে তবে গৌতম বুঝে উঠতে পারে না সালটা ১৯৮৪ নাকি অন্য কোন সময়, সে বিভ্রান্ত হয়। তাই নাটকের শিরোনামে একটি জিজ্ঞাসা চিহ্ন জুড়ে যায়। পার্টির এক মহিলা সহকর্মী লোপামুদ্রার (শুভনিতা গুহ) প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায়। তাদের এই রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধাচরণ কত দূর সাফল‍্য পায়, তাই নিয়েই নাটক।

এখানে বিগ ব্রাদার হ’ল ক্ষমতা ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রতীক। জর্জ অরওয়েল বহু বছর আগে কল্পনায় ভবিষ্যতের যে ভয়াবহ ছবি তার উপন্যাসের মাধ্যমে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন, আমাদের দেশে আজ তা আর কল্পনা নয় ঘোরতর বাস্তব। রাষ্ট্র ক্ষমতা সর্বদা আমাদের উপর নজর রেখে চলেছে, আমরা কী করছি, কী বলছি, কোথায় যাচ্ছি, এমনকি কী খাচ্ছি সবকিছুর উপর। আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য নানা ছলে বলে কৌশলে জেনে নেওয়া হচ্ছে। আমাদের ভাবনা চিন্তা, খাদ্যাভাস, চলা ফেরা সবকিছুর মধ্যেই রাষ্ট্রক্ষমতার নির্দেশকে মানিয়ে নিচ্ছি, তার তৈরি ছকের মধ্যে ক্রমশ আটকে পড়ছি। এই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে এই প্রযোজনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও ভীষণ প্রয়োজনীয়। এই নাটক আমাদের গৌতম হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করে।

শব্দ-পরিকল্পনা (অনিন্দ্য নন্দী), আবহ (শ্রেয়ান চট্টোপাধ্যায়) ও আলো (দিনেশ পোদ্দার) এক কথায় অনবদ‍্য। সঞ্চয়ন ঘোষের মঞ্চ অত্যন্ত সুচিন্তিত, একটা বদ্ধভাবের অনুভূতি দেয় এবং দমবন্ধ করা পরিবেশ সৃষ্টি করে যা এই নাটকের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী ছিল। এই রকম উপযুক্ত মঞ্চে আলো ও আবহের অসাধারণ যুগলবন্দী শুরু থেকে শেষ অবধি প্রযোজনাকে এক বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যায়। আবহের মধ্যে যে কর্কশতা ও ধাতব শব্দের ব্যবহার দেখা যায় তা আমাদের মনে ভয় ও অস্বস্তি দুই অনুভূতি সৃষ্টি করে।প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশের সাথে সাথে ভাষ্য, আবহ ও আলোর ব্যবহার আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে আমরা বিগ ব্রাদারের নজরদারির মধ্যে চলে এসেছি। একটা অস্বস্তি হয় যা নাটক শুরুর আগেই আমাদের নাট্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়। রাজীব বর্ধন ও অনিক ঘোষের পোশাক পরিকল্পনা চরিত্রানুসারে সাযুজ্যপূর্ণ।

অভিনয় সমন্ধে আলাদা করে বিশেষ কছু বলার নেই। উজ্জ্বল এবং শুভনিতা দুজনেই খুব সম্ভবনাময় অভিনেতা-অভিনেত্রী একথা অনস্বীকার্য্য, তবে নাট্যে আলো, আবহ, মঞ্চ সমগ্রিক ভাবে যে ছন্দ তৈরি করে, তাদের অভিনয় রীতি কখনো কখনো তা’ থেকে একটু মন্থর হয়ে পড়েছে। আশা রাখি ভবিষ্যতে এদের আরো ভালো কাজ দেখতে পাব। পঁচিশজন অভিনেতা অভিনেত্রী অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের মধ্যে নিবিড় অনুশীলনের প্রভাব লক্ষ করা যায়, প্রত্যেকের অভিনয় ব্যাকরণগতভাবে নিখুঁত, পরিশীলিত উচ্চারণ, দক্ষ চলা ফেরা। তবে প্রত্যেকের অভিনয়ের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট শৈলী লক্ষ হয় যা গুরুবাদী শিল্পচর্চার আরেকটি উদাহরণ মাত্র। এই প্রবণতা অবশ্য বাংলা থিয়েটারের প্রায় সব বড় বড় নাট্যদলের মধ্যেই দেখা গেছে ও আজও রয়ে গেছে।

অর্পিতা ঘোষ এবং দেবশঙ্কর হালদার এই নাটকে নেপথ্য-ভাষ্য পাঠ করেছেন। দুজনেই অত্যন্ত আন্তরিকতা ও যত্ন সহকারে কাজটি করেছেন, যা নাটকে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে।

জর্জ অরওয়েলের এই কালজয়ী উপন্যাসকে বঙ্গমঞ্চপোযোগী করে নাটককার যেভাবে রচনা করেছেন তাতে বিষয়বস্তুর গভীরতা সম্পূৰ্ণ বজায় থাকে। বর্তমান সময়ে এই রকম উপন্যাসের নাট্য প্রযোজনার ভাবনা প্রশংসাযোগ্য। শক্তিশালী বিষয়বস্তু, উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিকারী মঞ্চ, মানানসই পোশাক, অসাধারণ শব্দ-পরিকল্পনা, আবহ, আলো, একঝাঁক নবীন অভিনেতা – এইসব কিছু সুচারু রূপে গ্রথিত করে নির্দেশক একটি সার্থক প্রযোজনা উপস্থাপিত করলেন যা দর্শকদের মনকে প্রার্থিত ডিসটোপিয়ার দিকে নিয়ে যায়। তবে এতো সব আয়োজন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, ইত্যাদি সমস্ত কিছূই যে ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে, তার মূল কারণ কিন্তু উপন্যাসের শক্তিশালী প্লট! উপন্যাসের বিষয়বস্তু এতটা গভীর না হলে এ সমস্ত ঝাঁক জমক হয়ত অন্তঃসার শূন্য মনে হতে পারত। তাই মনে হয়, কী যেন একটা না পাওয়া রয়ে গেল। নাট্য হিসেবে উপন্যাসের সীমার বাইরে বেরিয়ে স্বকীয়ভাবে বিশেষ কোন ছাপ ফেলতে না পারাই কি তার কারণ? হয়তো এটা নাটককার-নির্দেশক সচেতনভাবেই করেছেন। তবে উপন্যাসটি যেভাবে নাটকের (text) রূপ পেয়েছে তা প্রশংসনীয়। এসব মন্তব্য কোন‌ও ‘থটক্রাইম’-এর উদ্রেক ঘটাচ্ছে না সে ভরসা আমাদের আছে।

সব শেষে, এ নাটক বিষয়গত ভাবে মগজের কারফিউ সরিয়ে দর্শককে ভাবাবে সে আশা রাখি। আমরা এই সময়ে যে অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি তা পরিবর্তনের সামান্য হলেও একটা আশার আলো দেখায় এই প্রযোজনা।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us