দোষ – প্রৌঢ়ত্বের অত্যন্ত জরুরী উদযাপন

Posted by Kaahon Desk On March 15, 2020

এ বছরের গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারিখে পদাতিক লিটল থিয়েটার টু অন্তরঙ্গ মঞ্চে পদাতিক থিয়েটার ও রিখ-এর যৌথ প্রযোজনায় নতুন হিন্দি নাটক ‘দোষ’-এর প্রথম অভিনয় হল। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনা বিনয় শর্মা। এই প্রতিবেদনটি ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখের শো-এর ভিত্তিতে লেখা। নাটকটির সাম্প্রতিকতম অভিনয় হয়ে গেল গত ৮ই মার্চ ২০২০ তারিখে সেই একই পদাতিক লিটল থিয়েটার টু-তে।

দুজন পূর্বপরিচিত ব্যক্তি আকষ্মিকভাবে অথবা প্ল্যানমাফিক কোথাও মিলিত হচ্ছেন, কথাবার্তা বলছেন নিজেদের অতীত নিয়ে, মক ট্রায়াল বা মক ইন্টারভিউতে উঠে আসছে অতীতের অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব বা গোপন কথা; সবকিছু মিলেমিশে গিয়ে তারা নিজেদের নতুন করে চিনতে শিখছেন — সাহিত্য, নাটক, বা সিনেমায় এই টেম্পলেটটা একেবারে অপরিচিত কিছু নয়! একাধিক সুলভ বিদেশী নাটকের মূল উপজীব্য হল চরিত্রদের ‘স্মৃতি’, বেশ গালভরা একটা নাম আছে এই জঁর-টার – Memory Play। মূলত গত শতাব্দীর টেনেসি উইলিয়ামস বা হ্যারল্ড পিন্টারের বেশ কিছু নাটককে এই গোত্রে ফেলা হলেও উনবিংশ শতকে হেনরিক ইবসেনের When We Dead Awaken বা অগস্ট স্ট্রিণ্ডবার্জের The Burned Site কে বলা হয় এই ধারার পূর্বসূরী! দেশজ উদাহরণও আছে – ‘জতুগৃহ’ বা ‘ইজাজত’, কিংবা ভেবে দেখুন একেবারে হাল আমলের ‘প্রাক্তন’ ছবিটার কথা! বিনয় শর্মার ‘দোষ’ নাটকটা এই ছাঁচটাকেই অনুসরণ করে। এখানে অতীতচারণ করেন একজোড়া নারী-পুরুষ, সম্পর্কে তারা ভাই-বোন (সহোদর)। কিন্তু তাদের সেই অতীতের কাহিনী, তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসর ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে ভীষণভাবে রাজনৈতিক!

Previous Kaahon Theatre Review:

এই নাটকের সময়কাল ১৯৯৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের সন্ধ্যা, নতুন সহস্রাব্দ শুরুর প্রাকমুহূর্ত! সীমা এবং তার বড়ভাই দুজনেই প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়, নিজেদের অতীত জীবনকে ফিরে দেখছেন ওল্ড মঙ্ক সহযোগে! জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তারা কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ষাটের দশকে। সেই সময়ের সুখ দুঃখের স্মৃতি উঠে আসে তাদের কথায়, বিটলসের Yesterday-র সঙ্গে একাকার হয়ে যায় হিন্দি ছবি ‘ওয়াক্ত’-এর গান (দুটোই ১৯৬৫তে প্রকাশিত)! ছেলেবেলার স্মৃতির সঙ্গে উঠে আসে পারিবারিক হিংসার প্রসঙ্গ, আর তার সঙ্গেই নাটকটা ঢুকে পড়ে সামাজিক হিংসার বৃত্তে – বোঝা যায় যে এরা আসলে ফিরে দেখছেন গোটা শতকের ইতিহাসটাকেই – যে ইতিহাস রক্তাক্ত ইতিহাস, হিংসার ইতিহাস! অন্যভাবে বলা যায়, গোটা শতকের ইতিহাসটাই যেন প্রবাহিত হয় এই দুই চরিত্রের জীবনের মধ্যে দিয়ে!

এই নাটকের বিজ্ঞাপনে ট্যাগলাইন হিসেবে লেখা হয়েছে – to obey or not to obey that is the question! এরা এটা কেন লিখেছেন সেই ব্যাখ্যায় বিস্তারিত যাচ্ছিনা, শুধু এই ইঙ্গিত দিয়ে রাখি যে ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে করা একটা প্রবল বিতর্কিত সোশ্যাল সাইকোলজি এক্সপেরিমেন্টের সঙ্গে এই ট্যাগের সম্পর্ক! বাকিটা রইল দর্শকের এক্সপ্লোর করার জন্য! আর হ্যাঁ, এই নাটকের একটা খুব সরল, সোজাসাপ্টা, আর সমকালীন বক্তব্য আছে, এবং সেটা প্রবল রাজনৈতিক। বলতে দ্বিধা নেই, সেই বক্তব্যটা খুব সার্থকভাবে দর্শকদের মধ্যে কমিউনিকেট করা হয়েছে। নাট্যনির্মাণের সমস্ত উপকরণগুলো একযোগে কাজ করলে তবেই এরকমটা সম্ভব হয়! প্রথমেই আসে টেক্সট – বিশেষ করে বলতে হয় তার পরিমিতি বোধের কথা। মাত্র দেড় ঘন্টার মধ্যে পুরো ব্যাপারটা শেষ, কোথাও চিৎকৃত ভাষণ নেই, কোনও অতিরিক্ত কিছু নেই, বলতে গেলে হয়ত যেন একটু বেশিই আঁটোসাঁটো! যেমন – নাটকটা যেখানে সামাজিক হিংসার প্রসঙ্গে বাঁক নেয়, সেই অংশটা একটু আকস্মিক। যুক্তরাষ্ট্রে সমসাময়িক হিপি বা কাউন্টার-কালচার আন্দোলনের প্রসঙ্গ নাটকে এলেও, ঠিক ঐ একই সময়ে চলতে থাকা সেকেন্ড-ওয়েভ নারীবাদী আন্দোলনের কথা একেবারেই অনুল্লিখিত; অথচ যথেষ্ট সুযোগ, যথেষ্ট কনটেক্সট, কিন্তু নাটকের মধ্যেই ছিল! নাটকের সেট, পোশাক, এবং আবহ পরিকল্পনা করেছেন স্বয়ং পরিচালক। প্রধানত প্যাকিং বাক্স দিয়ে তৈরি সেট, বাক্সের বিশেষ বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছু প্রাইভেট স্পেস তৈরি করা হয়েছে, যা কাহিনীর সঙ্গে বেশ সঙ্গতিপূর্ণ। পোশাক এবং প্রপস নির্বাচন করা হয়েছে সময়কালের কথা মাথায় রেখেই। আবহ কমপ্লিমেন্ট করেছে নাটকের মুডকে, কখনো আলাদা করে নিজেকে জাহির করেনি! এই নাটকে শব্দ প্রক্ষেপণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, দীনেশ হালদার সেই দায়িত্বে উত্তীর্ণ। পদাতিক ও রিখ প্রযোজিত সাম্প্রতিক কয়েকটি নাটকে আলোর ব্যবহার তেমন ইম্পর্টান্ট ছিল না (মার্ক টোয়েন, জাঁচ পরতাল), এই নাটকে কিন্তু দুটি অত্যন্ত জরুরী নাট্যমুহূর্তে আলোর তাৎপর্য্যপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে (আলোকভাবনায় সুদীপ সান্যাল, প্রক্ষেপণে পবিত্র সরকার)। তবে সবকিছু ছাপিয়ে উল্লেখ করতে হয় অভিনেতাদের উজ্জীবিত পারফরম্যান্সের কথা! ভাই চরিত্রে হর্ষ খুরানা তার ফ্ল্যামবয়েন্স আর চেহারার সাদৃশ্য দিয়ে বারেবারে মনে করিয়ে দিয়েছেন টপ ফর্মের শশী কাপুরকে! তার বাচিক ও শারীরিক অভিনয় চরিত্রের বিপন্নতাকে দর্শকের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেয়। সীমা চরিত্রে সারিকা সিং প্রথম দিকে কিছুটা উচ্চকিত, কিন্তু পরের দিকে যথেষ্ট পরিমার্জিত ও সংযত। প্রসঙ্গত, দুই অভিনেতার অভিনয়ের ধারাই কিছুটা ট্র্যাডিশনাল, কিন্তু চমৎকার পেশাদারিত্বের সঙ্গে তারা পরস্পরকে কমপ্লিমেন্ট করেন। তারা চরিত্রের খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্যগুলো যত্ন নিয়ে খেয়াল রাখেন, পুরো অভিনয়ের স্পেসটাকে ব্যবহার করেন, আর নিজেদের স্পষ্ট, দৃপ্ত উচ্চারণ, আর অন্তরঙ্গ স্পেসের সুবিধা ব্যবহার করে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে দর্শককে প্রায় কোনঠাসা করে ফেলেন! তবে এত যত্ন নিয়ে তিলতিল করে গড়ে তোলা এফেক্টটা ক্লাইম্যাক্সের পরেই সামান্য হলেও কমজোরি হয়ে যায়, দর্শকও বুঝতে পারেন যে এবার নাটক শেষ হয়ে আসছে, নতুন শতকের শুরুতে আশার আলো দেখানো হবে – আর তাই হয়ও। তবে অভিনেতারা যখন উচ্চারণ করেন যে তারা হয়ত আরও কুড়ি বছর বাঁচবেন, তখন হতাশার সুরটা আবার ফিরে আসে।

Rani Creusa– Rani Creusa after Medea, Greek myths in Bengali theatreপুরো নাটকের কোথাও বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে একটাও মন্তব্য নেই, কোনরকম ছোটবড় ইঙ্গিতও নেই — অথচ দর্শকের বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়না যে কেন এই নাটক! আর সেই অনুভূতিটা তারা বাড়ি অব্দি বয়েও নিয়ে যান। আর এভাবেই কাজটা হয়ে ওঠে শিল্পোত্তীর্ণ! নির্মাণের দিক থেকে অনেকটাই আলাদা হলেও, এই নাটক মনে পড়িয়ে দিল অস্ট্রিয়ান পরিচালক মাইকেল হানেকের The White Ribbon ছবিটার কথা। ২০০৯ সালে দাঁড়িয়ে হানেকে একশো বছরের পুরোনো জার্মানির গ্রামে গঞ্জে খুঁজে বেড়িয়েছিলেন ভবিষ্যৎ ভায়োলেন্সের উৎস! বিনয় শর্মার কাজটা আরও কঠিন, কারণ তাকে কাজ করতে হয়েছে এই সময়ের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে! কলকাতার বাংলা নাট্যজগতের স্বঘোষিত নটসম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের চিৎকৃত, ফাঁপা রাজনৈতিক বুলি সর্বস্ব নাটকের মুখে একপ্রকার ঝামাই ঘষে দেওয়া হল যেন! আর বাংলা নাটকের একাডেমি-কেন্দ্রিক দর্শকগণ, একাডেমি থেকে পদাতিকের ফিজিকাল দূরত্ব কিন্তু এমন কিছু বেশি নয়, মেন্টাল দূরত্বটা অতিক্রম করতে পারলে লাভবানই হবেন। নির্মাতাদের কাছেও দাবি, পদাতিক লিটল থিয়েটারের চৌহদ্দি থেকে মুক্ত করুন এই নাটককে। নইলে হয়ত একদল সুবেশ, উচ্চবিত্ত, এলিট সম্প্রদায়ের মানুষের বাইরে আর কেউই এই নাটকটা দেখতে পাবেন না! অথচ দেখতে পাওয়াটা খুব জরুরী!

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us