অশোকনগর নাট্যমুখের প্রযোজনা ‘আমি অনুকূলদা আর ওরা’ অভিনীত হল গিরীশ মঞ্চে, ৩রা ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়, নির্দেশনায় অভি চক্রবর্তী। ব্রাত্য বসুর লেখা এই নতুন এই নাটকের বিশেষত্ব হল পরাবাস্তবতা ও সেই সূত্রে দৃঢ় কোনো ন্যারেটিভের প্রায়-অনুপস্থিতি।
পর্দা উঠলে দেখা যায় প্রায়ান্ধকার ও প্রায় নিরাভরণ একটি মঞ্চ, মাঝামাঝি একটি স্বচ্ছ নেটের পর্দা দিয়ে সামনে পেছনে বিভক্ত, ঐ নেটের উপর প্রক্ষেপিত চলন্ত ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম ইমেজ হাসপাতালের ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটের পরিবেশ তৈরি করে। পর্দার পেছনে একপাশে একটি হাসপাতালের শয্যা, তাতে একটি ব্যাণ্ডেজাবৃত দেহ। অপরপাশটি শূন্য, ঐদিকের ব্যাকড্রপটি ব্যবহার করা হয় আলোক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে জ্যামিতিক নকশা সৃষ্টির জন্য। মঞ্চের সামনের অংশে দুপাশে দুটি বিচিত্র আকারের চেয়ার! এহেন পরাবাস্তবধর্মী সেটের মধ্যে প্রথমে ঢুকে আসেন একজন সম্পূর্ণ বাস্তবধর্মী নার্স।হাসপাতালের কোনও এক আধিকারিকের সঙ্গে তার ফোনালাপের মাধ্যমে দর্শক জানতে পারেন যে গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে রোগীটি অর্ধমৃত, চেতনাহীন। নার্স মঞ্চের বাইরে গেলে, রোগীটিকে ‘সোমেশ’ বলে সম্বোধন করে ‘অনুকূলদা’র প্রবেশ। তার সেই ডাকে সাড়া দিয়ে রোগীটির অবচেতন বাইরে বেরিয়ে আসে, এবং মঞ্চের সামনের অংশে এসে অনুকূলদার সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হয়।
Previous Kaahon Theatre Review:
নাটকের বাকি অংশ ঐ অবচেতনটির, পক্ষান্তরে সোমেশের, সঙ্গে অনুকূলদা এবং পরে আরও দুই চরিত্রের কথোপকথন ও ভাবের আদানপ্রদানের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে। এই আদানপ্রদান কখনো সংলাপের আকারে, কখনো স্বগতোক্তি বা বিলাপ, আবার কখনো কবিতার মধ্যে দিয়ে সামনে আসে।কখনো তা মনে হয় অযৌক্তিক প্রলাপ, কখনো ছিন্ন করে তীব্র শ্লেষে। মানবমনের গভীর গোপনে যে অযৌক্তিকতার বাস, তাকে টেনে সামনে বার করে আনাই পরাবাস্তবতার উদ্দেশ্য, আর সে কাজে অনুকূলদা চরিত্রটি অনেকাংশেই সফল। চরিত্রটির গঠন, তার বিমূর্ত কর্মকাণ্ড, এক বিস্ময় ও ব্যাখ্যাতীত অভিঘাত নিয়ে আসে যার পরিণামে সোমেশ চরিত্রের স্ববিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে। সোমেশ-অনুকূলদার ইন্টার্যাকশনের মাধ্যমে যখন নাটকের বিমূর্ত অবয়বটি সন্তর্পণে গড়ে উঠছে, ঠিক তখনই অনুকূলদার প্রস্থান এবং মঞ্চে প্রবেশ করেন এক যুবতী। এই চরিত্রটি সোমেশকে সরাসরি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করতে থাকে, এবং তাদের কথোপকথনে উঠে আসে সোমেশের বিবাহিত জীবন ও তার ব্যর্থতা সম্পর্কিত নানা তথ্য! এইখানে এসে দর্শক কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এতক্ষণ তো ছিল বিশুদ্ধ পরাবাস্তবতা, এবার কি তবে ন্যারেটিভের দিকে টার্ন নিচ্ছে? এটাও কি সেই বহুপরিচিত নাটকগুলোর একটি হয়ে উঠতে চাইছে যেখানে চরিত্ররা স্বপ্নে বা কল্পনায় অতীতের মুখোমুখি হয়? প্রসঙ্গত, অনুকূলদার অংশেও সোমেশের বিগতজীবনের কিছু তথ্য উঠে আসে, কিন্তু সেখানে বাস্তব-অবাস্তবের দোদুল্যমানতা পুরোমাত্রায় বজায় ছিল। কিন্তু যুবতীর অংশটিতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি। উল্টে এই অংশে এসে নাটকটি জনচিত্তবিনোদনের দিকে ঝুঁকছে কিনা, সেই সন্দেহও উস্কে দেয়! এরপরেই সোমেশের সঙ্গে দেখা করতে তৃতীয় ও শেষ চরিত্র, যা কিনা এই নাটকের সেরা চমক বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।
সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই সারা পৃথিবীর নাট্যমোদীরা যে চরিত্রটির অপেক্ষায় কালযাপন করে চলেছেন, তার নাম ‘গোডো’(স্যামুয়েল বেকেটের কালজয়ী নাটক ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ স্মর্তব্য)। এতদিনে হল সেই প্রতীক্ষার অবসান! বাংলার মঞ্চে পদার্পণ করলেন স্বয়ং গোডো, তার চলনবলন নায়কোচিত, মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ! অস্তিত্বের চূড়ান্ত নিরর্থকতা থেকে মানুষের পরিত্রাণের আকাঙ্খার প্রকাশই যদি এই অংশটির উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে তা অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে যায় অতিনাটকীয়তার উচ্চকিত উচ্চারণে। ফলে যে চরম সম্ভাবনা নিয়ে নাটকটি শুরু হয়, তা মাঝখানে এসে খেই হারিয়ে ফেলে, শেষে আবার গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পুরোটা করে উঠতে পারেনা! যে নাটকের হয়ে ওঠার কথা ছিল আত্মানুসন্ধানের অনন্য দলিল, তা হয়ে পড়ে অসম্পূর্ণ এবং আপাতবিচ্ছিন্ন কিছু বাক্যসমষ্টি! এই সমস্যা কি টেক্সটের, নাকি নাট্যনির্মাণের, নাকি দুয়েরই, এই বিষয়ে সংশয় রয়ে যায়। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে নাট্যকারের পূর্ববর্তী একাধিক নাটকের তুলনায় এই নাটক অনেক বেশি পরিণত এবং পরিমিত (বিরতি বাদে সময়সীমা আনুমানিক দেড় ঘন্টা), অন্তত কোনও রহস্য বা রোমাঞ্চকাহিনীর মোড়কে পরিবেশিত নয়। এবং এও হয়ত সত্যি যে এক সচেতন মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা থেকেই এই নাটকের প্লটটি উদ্ভূত, যা কিনা বিভিন্ন মানসিকতার দর্শকের কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন বার্তা বয়ে আনতে পারে।
অভিনয়ে সকলেই পরিশীলিত, শিক্ষিত এবং শক্তিশালী, তবে তিন দর্শনার্থীদের মধ্যে একমাত্র অনুকূলদারূপী অনুপম চন্দ নাটকের পরাবাস্তবতার আমেজটিকে চিত্রায়িত করতে পারেন। সৌমিকের চিন্তাশীল মঞ্চভাবনা নাটকের মূলভাবনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যায়। আলোকভাবনা চমকপ্রদ হলেও পরাবাস্তবতার চেয়ে কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গেই মিল বেশি। সঙ্গীত আলাদা করে চোখে পড়েনা, নিজের কাজটি ঠিকমতো করে যায়। সব মিলিয়ে নাটকটি একটি মিশ্র অনুভূতি দেয়, একটি সার্থক নাটক হয়ে ওঠার বেশ কিছু গুণ থাকলেও দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়।