এলা তখন, এলা এখন, এলারা চিরন্তন

Posted by Kaahon Desk On December 19, 2018

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’ অবলম্বনে বেলঘড়িয়া রূপতাপসের নতুন প্রযোজনা ‘এলা এখন’ মঞ্চস্থ হ’ল একাডেমি মঞ্চে ৬ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায়, নাট্যভাবনা ও পরিচালনায় কৌশিক ঘোষ।

১৯৩৪সালে এই উপন্যাস প্রকাশিত হবার সাথে সাথে পাঠককূলে, বিশেষ করে বিপ্লবী সমাজে, বেশ ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। বিভিন্ন মহল থেকে রবীন্দ্রনাথকে নানা সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।রবীন্দ্রনাথ ‘চার অধ্যায় সম্বন্ধে কৈফিয়ত’ শীর্ষক একটি লেখায় লিখেছিলেন — “আমার ‘চার অধ্যায়’ গল্পটি সম্বন্ধে যত তর্ক ও আলেচনা উঠেছে তার অধিকাংশই সাহিত্য বিচারের বাহিরে পড়ে গেছে।এটা স্বাভাবিক, কারণ, এই গল্পের যে ভূমিকা, সেটা রাষ্ট্র চেষ্টা আলোড়িত বতর্মান বাংলাদেশের আবেগের বর্ণে উজ্জ্বল করে রঞ্জিত। এই জন্যেই গল্পের চেয়ে গল্পের ভূমিকাটাই অনেক পাঠকের কাছে মুখ্য ভাবে প্রতিভাত। চার অধ্যায় রচনায় কোন বিশেষ মত বা উপদেশ আছে কিনা সে তর্ক সাহিত্য বিচারে অনাবশ্যক। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে এর মূল অবলম্বন কোন আধুনিক বাঙালি নায়ক নায়িকার প্রেমের ইতিহাস। সেই প্রেমের নাট্য রসাত্মক বিশেষত্ব ঘটিয়েছে বাংলাদেশের বিপ্লব প্রচেষ্টার ভূমিকায়। এখানে সেই বিপ্লবের বর্ণনা অংশ গৌন মাত্র; এই বিপ্লবের ঝোড়ো আবহাওয়ায় দুজনের প্রেমের মধ্যে যে তীব্রতা যে বেদনা এনেছে সেইটেতেই সাহিত্য পরিচয়।” রবীন্দ্রনাথ চিরকালই মনুষ্যত্বকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন এমনকি দেশাত্মবোধ বা জাতীয়তাবাদেরও উপরে। মনুষ্যত্বকে কোনভাবে অস্বীকার করলে জীবনে আর সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়। দেশাত্মবোধ যদি মনুষ্যত্বকে অবহেলা করে, তবে তা হয়ে পড়ে শুধুমাত্র আবেগ তাড়িতমোহ। রবীন্দ্রনাথের এই দর্শন তার অনান্য লেখার মতো ‘চার অধ্যায়’-এর দেশাত্মবোধের প্রেক্ষাপটে এলাও অতীন্দ্রের প্রেমের আখ্যানেও সমানভাবে প্রতিভাত।

Previous Kaahon Theatre Review:

আজকে আমরা যে অসহনীয় অবস্থার মধ্যে অবস্থান করছি, সেখানে একদিকে চরম মৌলবাদী শক্তি ভীষণ ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে বিশ্বব্যাপী এক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে জাতীয় ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সাম্প্রদায়িক মত তাদের সৃষ্ট পথে ইতিহাসকেও চালনা করবার উগ্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে মানুষের স্বাধীন চিন্তাধারাকে আঘাত করে এক নির্দিষ্ট মতকে তাদের উপর চাপিয়ে দেবার যে চেষ্টা চলছে তার ফলে প্রতিনিয়ত মনুষ্যত্বের অবমাননা ঘটে চলেছে। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ প্রযোজনা ভীষণভাবে প্রাসংঙ্গিক মনে হয়েছে।

‘চার অধ্যায়’ অবলম্বনে নাটকের নাম যখন দেওয়া হয় ‘এলা এখন’, তখন স্বভাবতই মনে হয় এ নাটকের বিষয়বস্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এনে সমকালের সাথে মিলিয়ে দেওয়া হবে। ফলে নাটকের উপস্থাপনার কী ধরনের হবে সে বিষয়ে দর্শকদের মনে উৎসাহ জাগে। পরিচালক রবীন্দ্র সংলাপ অক্ষুন্ন রেখে কিছুটা সম্পাদনা করে চার অধ্যায়েরই উপস্থাপনার মাধ্যমে অতীতের আয়নায় বর্তমানকে প্রতিফলন করেছেন, তবে উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স অংশটি তিনি বাদ রেখেছেন, ফলে মনে হয় বর্তমান যুগে এই নাটকের পরিণতি তিনি নির্দিষ্ট করে দিতে চাননি। তবে পরিচালকের নাট্যভাবনার বিশেষত্ব এখানেই তাৎপর্যপূর্ণ যে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরবর্তী কবিদের রচনাকে সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন, এতে আরো সহজ ও সাবলীলভাবে এই সময়ের অস্থিরতা ও অসহনীয়তা দর্শকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। এ নাটক কিছুটা হলেও দর্শকদের ভাবিত করে তুলবে একথা বলা যায়। নাটকের শুরুতে এলা যাদবপুরের কোন এক কানাইদার চায়ের দোকানে বসে দর্শকদের জানায় সে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে, তারপর ইন্দ্রনাথের প্রবেশের সাথে সাথে চার অধ্যায়ের অভিনয় শুরু হয়ে যায়। নাটকের শেষে সে আবার কানাইদার চায়ের দোকানে ফিরে আসে, তখন মনে হয় এযুগের এলা রবীন্দ্রনাথের এলার সাথে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে আর ৮৪ বছর আগে লেখা উপন্যাস সমকালের সাথে দারুণভাবে মিলে গেছে। পরিচালক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিশেষ কোন পরীক্ষার মধ্যে যাননি, শুধুমাত্র সৃজনশীলতার সাথে রবীন্দ্র প্রাসংঙ্গিকতাকে কাজে লাগিয়ে একটি নিটোল প্রযোজনা উপহার দিয়েছেন আমাদের। নাটকে তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মণিভূষন ভট্টাচার্য্য, নবারুণ ভট্টাচার্য্য, বিপুল চক্রবর্তী প্রমুখ কবিদের কবিতা ব্যবহার করেছেন। যদিও রবীন্দ্র ভান্ডার থেকেই সমপোযোগী কবিতার ব্যবহার করা যেত, যা রবীন্দ্র প্রযোজনায় সচরাচর হয়ে থাকে। কিন্তু সে পথে না গিয়ে তিনি এই ব্যবহারের মাধ্যমে সমকালের সুন্দর ব্যঞ্জনা ও চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন। তবে ব্যবহৃত কবিতার সংখ্যা একটু কম হলেই ভালো হত। তাছাড়া পোস্টার আকারে যে পংক্তিগুলি ব্যবহার করেছেন তার মূলভাব রবীন্দ্রনাথের রচনাতে বিদ্যমান, পৃথক ভাবে দেখাবার দরকার ছিল না। যখন মঞ্চে নাটক চলাকালীন পোস্টারগুলি বদল করা হচ্ছিল তখন বারবার নাটকের গতি ব্যহত হয়ে পড়ছিল এবং পোস্টারগুলি পড়তে গিয়ে সৃষ্ট নাট্যমুহূর্ত দর্শকদের চোখ থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল। এ ব্যপারটি পরিচালকের মাথায় রাখা প্রয়োজন। মঞ্চে ভিডিও প্রজেকশনের মাধ্যমে তথ্যচিত্রের যে অংশগুলি দেখান হয় তার মাধ্যমে পরিচালকের ভাবনা সহজেই দর্শকদের কাছে পৌঁছে যায়, ফলে পোস্টারের ব্যবহার বাহুল্য মনে হয়।

উপন্যাসের চারটি অধ্যায়ের চারটি দৃশ্যকে নাট্যকার তথা পরিচালক দুটি দৃশ্যের মধ্যেই আবদ্ধ রেখেছেন – কানাই এর চায়ের দোকান আর অতীন্দ্রের গোপন আস্তানা। সারা নাটক জুড়ে এলা, অতীন্দ্র আর কানাই গুপ্তর উপস্থিতিই লক্ষ্য করা যায়। ইন্দ্রনাথ প্রথমে নাটকের ভূমিকা গড়ে দেয় এবং বটুক একঝলক আসে দৃষ্টান্ত স্বরূপ। এলা চরিত্রে শিপ্রা মুখোপাধ্যায় ও অতীন্দ্র চরিত্রে তথাগত চৌধুরীর অভিনয় নাটকের গতিকে বাধাহীন ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছ, দুজনের অভিনয়ের মধ্যে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া লক্ষ করা যায়, দুজনের বাচিক অভিনয় ও বেশ ভালো যা এধরনের সংলাপ নির্ভর নাটকে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কানাই গুপ্তের চরিত্রটি স্বল্প সময়ের জন্য দেখা গেলেও নীলাভ চট্টোপাধ্যায়ের সহজ ও সাবলীল অভিনয় নাটককে সমৃদ্ধ করেছে। ইন্দ্রনাথ চরিত্রে বিপ্লব নাহা বিশ্বাসের অভিনয় অন্যদের তুলনায় খুবই সাদামাটা এবং কিছুটা কৃত্রিমও বটে।

সামান্য উপকরণ দিয়ে নাটকের মূল ভাবকে মঞ্চ সজ্জার মাধ্যমে প্রকাশ করা হিরণ মিত্রের অনায়াস লব্ধতা আরো একবার প্রত‍্যক্ষ করা গেল এই নাটকে। শুভেন্দু মাইতির আবহ নাটকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং নাট্যচলনকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ঠান্ডু রায়হানের আলোক পরিকল্পনা নাটকের সাথে মানানসই হয়েছে।

সব শেষে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’-কে পরিচালক কৌশিক ঘোষ নিজ উপলব্ধিও ভাবনা দিয়ে বর্তমানের সাথে সংযোগ করে যে নাট্যপরিবেশনা আমাদের কাছে উপস্থাপন করলেন তা প্রশংসারই যোগ্য।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us