ভাদ্রজা – গবেষণাধর্মী নাটক, নাট্যে অপরিণত

Posted by Kaahon Desk On May 12, 2018

Spectactors নাট্যগোষ্ঠী প্রযোজিত নাটক ‘ভাদ্রজা’-র প্রথম অভিনয় মঞ্চস্থ হল ৩রা মে, কলকাতার জ্ঞানমঞ্চে, নাটক ও নির্দেশনায় সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়। নাটকের বিষয়বস্তু ‘ভাদু’। বলা হয়েছে যে, ভাদু নিয়ে এর আগে একাধিক প্রযোজনা হয়েছে, কিন্তু এই প্রযোজনা একেবারে অন্যরকম কারণ লোকনাট্যের আঙ্গিকে প্রচলিত আখ্যানকে শুধু তুলে ধরা নয়, বরং ভাদুর ইতিহাসের জটিলতা ও অন্ধকারময়তাকে নাটককার সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় তার গবেষণালব্ধ জ্ঞানের আধারে কিছুটা কল্পনা মিশিয়ে নাটকটি লিখেছেন।

Previous Kaahon Theatre Review:

লোককথা লৌকিক সমাজের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি, সামাজিক ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক ইতিহাসের মৌখিক উপাদান লুকিয়ে আছে লোককথার মধ্যে। আর মৌখিক বলেই একই কাহিনি-নির্ভর লোককথা স্থান ও কাল ভেদে আমাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়, প্রকৃত রূপটি সঠিক ভাবে প্রকাশ পায় না। তথ্য ও প্রমাণের অভাবে সঠিক রূপটি খুঁজে বের করাও কঠিন। ভাদু উৎসব নিয়েও বেশ কিছু লোককথা প্রচলিত আছে, কিন্তু সেগুলি ঐতিহাসিকভাবে এবং তথ্যগত ভিত্তিতে সম্পূর্ণ সত্য নয়। ভাদু সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য যা পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে এখনও পর্যন্ত যাঁরা গবেষণা চালিয়েছেন তাঁরা একটি জায়গায় এসে থমকে গেছেন। প্রমাণ ও তথ্যের অভাবে ভাদুর ইতিহাস যে বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে থমকে গেছে, এই নাটক সেই বন্ধ দরজা খোলবার চেষ্টা করেছে কল্পনার চাবি দিয়ে।

নাটককার বর্তমান ও অতীতকে পাশাপাশি রেখে ঘটনা প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, সমকালের দর্পণে অতীতকে দেখেছেন। তবে আখ্যান অংশে নির্দেশকের সাম্প্রতিক অভিনীত একটি চলচ্চিত্রের বহুল পরিচিত মূলকাহিনির ছায়া চোখ এড়ায় না। নির্দেশক টুকরো টুকরো দৃশ্য এবং ভাদুগান দিয়ে নাটকটি সাজিয়েছেন, গানগুলি খন্ড দৃশ্যগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে নাটকটি এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। কিছু গান ও গানের সুর যেমন প্রচলিত আবার কিছু গান তিনি নাটকের প্রয়োজনে রচনা করেছেন। সিংদেও বংশের বর্তমান বংশ ধরের (সম্ভবত শেষ বংশ ধর) মুখে শুনিয়েছেন তারই পূর্বপুরুষদের কাহিনি। সে কাহিনি যে কতটা সত্যি আর কতটা কল্পনা তা এই সিংদেও নিজেও জানেন না, সত্য মিথ্যার জট ছাড়াতে গিয়ে উঠে আসে নানা প্রশ্ন আর সেই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলে সারা নাটক জুড়ে। আখ্যানটিতে আমরা দেখতে পাই ভদ্রাবতী ও ভদ্রেশ্বরীর নির্মম পরিণতি যার জন্যে দায়ী রাজা মহতাব সিংদেও। তিনি অরণ্যে ভদ্রাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে গন্ধর্ব বিবাহ করেন, কতকটা দুষ্মন্তের মতই কয়েক দিন পর রাজ বাড়ি ফিরে যান ভদ্রাবতীকে স্ত্রী হিসাবে সামাজিক স্বীকৃতি না দিয়েই। এরপর গর্ভবতী ভদ্রাবতী তার অধিকারের দাবী নিয়ে  রাজবাড়ি যান এবং প্রত্যাখ্যাত হন, পরবর্তীকালে ভদ্রেশ্বরীকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান, পরে ভদ্রেশ্বরী যখন কিশোরী তখন রাজা জঙ্গলে এসে ভদ্রেশ্বরীর খোঁজ পেলে তাকে সাথে করে নিয়ে যান তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য, ভদ্রেশ্বরীকে দেবী রূপে পূজা শুরু করেন, নিজের কৃত পাপ প্রকাশের ভয়ে এবং নিজের সম্মান বজায় রাখতে ভদ্রেশ্বরীকে হত্যা করেন এবং তাকে দেবীরূপে প্রতিষ্ঠা করে ভাদু পূজার প্রচলন করেন। ভাদু পূজা করবার আধিকার দেন শুধু মাত্র মহিলাদের। এভাবে তিনি সাধারণ মানবীকে দেবী বনিয়ে দিলেন শুধুমাত্র নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এ হল শ্রেণী বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা অবাক হই এবং বাস্তবের আয়নার সামনে দাঁড়াতে হয়, যখন দেখি বর্তমান সিংদেও-এর লালসার শিকার হতে হয় তারই দেওয়ান কন্যাকে, তখন মনে হয় আমরা মিথ্যে আধুনিকতা ও সভ্যতার মুখোশ পরে আছি।

নাটকে মূল আভিনেতা পাঁচজন – সৌম্য সেনগুপ্ত, শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়, বরুণ গঙ্গোপাধ্যায়, আর্যা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরিজিতা মুখোপাধ্যায়। এদেরকে তেরো চোদ্দটি চরিত্র ঘুরে ফিরে অভিনয় করতে হয়েছে, একটি চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে খুব দ্রুত যাতায়াত করতে হয়েছে। কাজটি খুব সহজ নয়, প্রত্যেকে বেশ আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করেছেন বটে তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে যে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন এমনও নয়।মহতাব সিংদেও এবং বর্তমান সিংদেও বংশধর, এই দুটি চরিত্রের গঠনগত মেজাজটি মূলত একই; দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অভিনেতা সৌম্য সেনগুপ্ত তার চলাফেরাও বাচন ভঙ্গির মধ্যে অল্প কিছু পরিবর্তন করে দুটি চরিত্রকেই আলাদাভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। মাতান এবং অন্য কয়েকটি ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়, তিনি আলাদা আলাদা চরিত্র চিত্রণে কন্ঠস্বরের তারতম্য ঘটিয়ে চরিত্র গুলি পৃথকভাবে উপস্থাপন করবার চমৎকার প্রয়াস করেছেন, তবে চলাফেরা বা অভিব্যক্তি একটি চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে খুব একটা হেরফের হয়না ফলে বিশ্বাস যোগ্যতা কমে যায়, মাঝেমাঝে একটু অতি অভিনয় ও চোখে পড়ে। আর্যা বন্দ্যোপাধ্যায় ভদ্রাবতী চরিত্রের উচ্ছলতা, রাগ, অভিমান বেশ দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়া তিনি ভদ্রেশ্বরী ও সহেলী চরিত্রেও অভিনয় করেছেন, এই দুটি চরিত্রের অভিনয় যথাযথ। অরিজিতা মুখোপাধ্যায় অভিনীত রাণী অহল্যাও বৌঠান চরিত্র দুটির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। প্রসাদ মাহাতো, প্রফেসর, আর দেওয়ান চরিত্র গুলিতে অভিনয় করেছেন বরুণ গঙ্গোপাধ্যায়। এর মধ্যে প্রফেসর চরিত্রে তাকে বেশ ভালো লাগে, তার হাবভাব ও বাচন ভঙ্গি চরিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। চরিত্রটিতে হালকা কমেডির উপাদান ছিল, তবে সেটা তিনি সর্বদা একটি নিদিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ রেখেছেন, ফলে চরিত্রটি কখনই আলাদা করে ‘কমিকচরিত্র’ হয়ে ওঠেনি। শ্রমণ চট্টোপাধ্যায় ও অরিজিতা মুখোপাধ্যায় অভিনয় ছাড়াও মূল গায়েনের ভূমিকা পালন করেছেন, এজন্য তারা আলাদা প্রশংসার দাবি রাখেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়ের গানের কন্ঠটি চমৎকার।

মঞ্চ নির্মাণে অরুণ মন্ডল অল্প কিছু সামগ্রী ব্যবহার করেই মঞ্চকে নাটকের চাহিদার অনুসারী করে তুলতে পেরেছেন। একটি পঞ্চবাহু পর্দাযুক্ত স্ট্যান্ডের উপর নানা রকম দৃশ্য প্রক্ষেপন করে আলাদা আলাদা পরিবেশ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছেন, স্ট্যান্ডটিকে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে সরিয়ে স্থান পরিবর্তন বোঝাতে পেরেছেন।

মৃগনাভি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত নাটকের মুডটির সাথে ঠিকমত চলতে পেরেছে, তবে কখনও তা’ কিছুটা উচ্চকিত। তবে মনে হয়েছে এই নাটকটিতে সম্পূর্ণটাই Live Music হলে আরো ভালো হত।

অগ্নিমিত্রা গিরি সরকারের পোশাক পরিকল্পনার কাজটি সুচিন্তিত, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যখন একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেন তখন পোশাক নির্বাচনে বিশে নজর রাখতে হয়, তা’ তিনি করেছেন সুচারুভাবে।

বরুণ করের আলোক পরিকল্পনা মোটের ওপর ভালোই, তবে কয়েক জায়গায় আলোক প্রক্ষেপনের ত্রুটি দর্শকের মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটায়।

এবার আসা যাক নাট্য নির্মাণের কথায়। আলো, মঞ্চ, সঙ্গীত, ইত্যাদির সঠিক সমন্বয়ে নির্দেশক তার মেধা, ভাবনা, ও সৃজন শীলতার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে একটি লিখিত নাটককে মঞ্চে তার চূড়ান্ত রূপ দেন, যা আমরা দর্শকাসনে বসে দেখতে পাই। একটা লিখিত রূপ (text) নানা পর্যায় অতিক্রম করে পূর্ণাঙ্গ নাট্যে রূপ নেয়। নিৰ্দেশক এই সকল পর্যায়গুলি সুচারু রূপে অতিক্রম করে সফল নাট্যসৃজনের চেষ্টা করেন। আলোচ্য নির্দেশকের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল বেশি, কিন্তু এই প্রযোজনা যেন সেই উচ্চতা ছুঁতে পারল না, টেক্সট থেকে নাট্যে উত্তরণে কমতি থেকে গেল! এর প্রধান কারণ হিসেবে আমার মনে হয় এই নাটকে দর্শকের মনে গেঁথে যাওয়ার মতো বিশেষ নাট্য মুহূর্তের অভাব। ব্যতিক্রম হিসেবে অবশ্য শেষ দৃশ্যটির কথা বলা যায় যা অভিনয়, আলোক সম্পাত, আর সঙ্গীতের সঠিক সমন্বয়ে মুহূর্তটি সার্থক করে তোলে। সারা নাটকে এরকম আরও কিছু মুহূর্ত প্রত্যাশিত। দৃশ্যের সংযোগ রক্ষাকারী গানগুলির কথা অনেক ক্ষেত্রে উচ্চকিত নেপথ্য সঙ্গীতের কারণে দর্শকের বোধগম্য হয় না, নাটকের রস গ্রহণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। নাটকের দৈর্ঘ্যও কিঞ্চিৎ বেশি হওয়ায় মনোসংযোগ ছিন্ন হয়। তাই সব মিলিয়ে নাট্য নির্মানে একটি যত্নশীল প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেলেও নাট্য-উপাদানগুলির মধ্যে সামগ্রিক মেলবন্ধনের অভাবে তা পূর্ণতা পায় না।

বলা হয়েছে যে ভাদুর ইতিহাসের জটিলতাকে যথা সম্ভব খুলে, তুলে ধরার প্রয়াস, কিন্তু এই প্রয়াসে অনুমানও কল্পনার আধিক্য, ফলে ইতিহাসের জট খুব একটা খুলল না। একটি নতুন গল্পের গঠন হল, কিন্তু সত্যানুসন্ধানের পথ দেখাল না। ভাদুর ইতিহাসের নতুন কোনদিক উন্মুক্ত হল না তবে ভাদুর কাহিনী তো শুধু মানভূমের আঞ্চলিক ছবিটা তুলে ধরে না, বৃহত্তর সমাজের ছবিটাও মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এখানেই আমরা নাটকের সাথে একাত্ম হতে পারি, নাটকের চরিত্রের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাই, এটাই এই নাটকের সার্থকতা।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us