সেলসম্যানের সংসার – আরেকবার ‘ডেথ অফ অ্যা সেলসম্যান’-এর সুঅভিনয় বাংলার মঞ্চে

Posted by Kaahon Desk On May 10, 2019

অঞ্জন দত্ত পরিচালিত, অঞ্জন দত্ত প্রোডাকশন্‌সের নাটক “সেলসম্যানের সংসার”। “সেলসম্যান” নিয়ে তৈরি নাটক – এ কথাটা শুনলেই একাডেমী ঘোরা বাঙ্গালি দর্শকের মনে পড়তে বাধ্য আমেরিকান নাট্যকার আর্থার মিলারের সেই বিখ্যাত মডার্ন ট্র্যাজেডি “ডেথ অফ অ্যা সেলসম্যান”এর কথা। বস্তুত নান্দিকার প্রযোজিত “ফেরিওালার মৃত্যু” দেখেননি এমন নাটক-প্রেমী মানুষ কলকাতা শহরে কমই আছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বড়-মেজো-ছোট দল এই নাটক মঞ্চস্থ করেছে, শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। যুগে যুগে এহেন পপুলারিটির প্রধান কারণ হল নাটকের বিষয়বস্তু – যা কখনোই প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না। এই নাটকটাও সেই ডেথ অফ অ্যা সেলসম্যান থেকেই অনুপ্রাণিত, তবে কোনোভাবেই তার বঙ্গীকরণ নয়।

নাটকের নামকরণ থেকেই খানিকটা স্পষ্ট, নির্দেশক সেলসম্যানের মৃত্যু ছাপিয়ে তাঁর “সংসার” নিয়ে বেশী আগ্রহী। (যদিও শুরুর অ্যানাউন্সমেন্টের সময় নির্দেশক “সেলসম্যানের মৃত্যু” বলে ফেলেছিলেন) এমন একটি সংসার যা আমার আপনার মত স্বপ্ন দিয়ে তৈরি আর বাস্তব দ্বারা উচ্ছিন্ন। “ডেথ অফ অ্যা সেলসম্যান” নাটকটির থিম “অ্যামেরিকান ড্রিম”। সেই ড্রিম যার জন্ম হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশেপাশে কন্সিউমারিসমের হাত ধরে, আগ্রাসন এবং উন্নাসিকতা যার সহগামী, ক্রমশ ভালো, আরও ভালো, সবচেয়ে ভালোটা পাওয়ার মাদকতা যার অবদান এবং একটি অবধারিত ফ্রাস্ট্রেটেড ডেথলি উইশ (হতাশাজনিত মৃত্যুর ইচ্ছে বললে তীব্রতাটা ঠিক বোঝানো যায় না)যার অন্তিম অধ্যায়। বুঝতেই পারছেন, নাটকটা কেমনভাবে আজকের দিনেও সমান প্রাসঙ্গিক।

Previous Kaahon Theatre Review:

এই নাটকেও আমরা সেরকম ভাবেই দেখতে পাই স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করা উইলি লোম্যানকে। তার জীবনের সাধ সফল সেলসম্যান হওয়া। তা সে ছিলও একজন সফল সেলসম্যান একসময়ে। ক্লায়েন্টরা তাকে মান্যগণ্যর তালিকাতেই ধরত, অফিসে তখন তার কত কদর! তার ছুতোর মিস্তিরি বাবার সেল্ফ এমপ্লয়মেন্টের থেকেও তার বেশি ভালো লাগত অন্যের অধিনস্থ সেলসম্যানের পেশা, প্রথমে মনে মনে এবং পরে প্রকাশ্যে নিজের জন্য গর্ব বোধ করত উইলি। সে চাইত তার দুই ছেলেও হয়ে উঠবে সফলতম সেলসম্যান। কিন্তু তখনও উইলি ক্যাপিটালিসমের খারাপ দিকটার কথা বুঝে উঠতে পারেনি। বুঝে উঠতে পারেনি কন্সিউমারিসমের প্রভাবে কিভাবে তার অজান্তেই ক্রমশ বদলে গেছে মানুষের মূল্যবোধ।অতঃপর সময়ের সাথে সাথে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে ছিবড়ে হয়ে যাওয়া সেলসম্যানের অচল সিক্কার মত অবহেলিত হতে থাকা। দৈহিক সামর্থ্য হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হারিয়ে যায় টাকা রোজগার, সংসারে সম্মান, অফিসে কদর। কিন্তু উইলি কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা এই ব্যর্থতা। তার দুই ছেলে ততদিনে হয়ে উঠেছে ক্যাপিটালিসম এবং কন্সিউমারিসমের প্রকৃষ্ট ফলাফল। তারা কি করতে চায় নিজেরা জানে না, কতখানি শ্রমের সাথে কতখানি নিষ্ঠা মেশালে সফল হয়ে ওঠা যায় তা সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। সফল হয়ে ওঠা বলতেই বা কি বোঝায় তাও কি তারা জানে? ক্যাপিটালিসম তো বদলে দিয়েছে সফলতার সংজ্ঞা! তারা খালি টাকা চেনে, ভাবে টাকা থাকলেই সব হয়, জীবনকে কাছ থেকে চিনতে শেখার অভ্যেসটাই তাদের তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরে সেলসম্যানের সংসার তছনছ হয়ে যেতে থাকে। তাও একবার শেষ চেষ্টা করতে চায় উইলি, তার মৃত্যুটাকেও সফল ভাবে বেচে দিতে চায় সে। ইনশিওরেন্স কোম্পানিকে বোকা বানিয়ে সে তার ইচ্ছামৃত্যুকে (স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা) প্রমাণ করে যেতে চায় অ্যাকসিডেন্ট হিসেবে। সে মনে করে তার এই শেষ বিক্রিটা হয়ত বাঁচাতে পারবে তার ধ্বংস হতে বসা সংসারকে, তার সন্তানদের জন্য হয়ত তার এটুকু অবশ্য করণীয়।

উইলি লোম্যান আসলে কোনদিন বুঝতে পারে না যার প্রতিনিধি হয়ে সে লড়ছে আসলে সেটাই তাকে হারিয়ে দেবে একসময়। তার পতন যে তার নিজেরই গড়া ইমারতের সবচেয়ে উঁচু তলা থেকে! “ডেথ অফ অ্যা সেলসম্যান” এবং “সেলসম্যানের সংসার” তাই শেষ পর্যন্ত প্রকৃত অর্থেই হয়ে ওঠে মডার্ন ট্র্যাজেডি। এই নাটক দারুণ লেগেছে বলার নয়, এই নাটক মন খারাপের, বিষাদের, নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া বা হতে চলা ট্রাজেডি সামনে থেকে দেখতে পেয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফেরার।

উইলি লোম্যানের ভুমিকায় অঞ্জন দত্ত এক কথায় অসাধারণ, দুর্দান্ত, অভাবনীয় (এক কথায় বলা গেল না)। উইলির জীবনের অসহায়তা, ক্ষোভ, রাগ, ভালোবাসা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সর্বোপরি ব্যর্থতা যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি তা তিনি ছাড়া আর কেউ পারত কিনা সন্দেহ হয়। সুদীপা বসু সহ নাটকের বাকি সমস্ত অভিনেতাই খুব ভালো অভিনয় করেছেন, কিন্তু অঞ্জন দত্ত তাঁদের থেকে ১০০ মাইল এগিয়ে।

নাটকে আলোর ব্যবহার ও মঞ্চ সজ্জা সবই খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ। অঞ্জনের নাটকের মিউজিক যে দারুণ হবেই সে তো জানাই কথা। বিশেষত ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার “অ্যান্ড নাও দ্য এন্ড ইস নিয়ার” গানটির প্রাসঙ্গিক ব্যবহার নাটকটিকে যেন একটা অন্য মাত্রা দিয়েছে।

Salesmaner Songsar- ‘Death of a salesman’ once again brilliantly acted on Bengali stage

কিন্তু এতকিছুর পরও সেই তেতো প্রশ্নটা করতেই হচ্ছে। বাংলা নাটকে অরিজিনাল প্লে তৈরি হচ্ছে না কেন? অঞ্জন দত্ত তো নিজে নতুন একটা নাটক লিখতে পারতেন, তাঁর সেই ক্ষমতাও রয়েছে। কেন বহুল অভিনীত “ডেথ অফ অ্যা সেলসম্যান”-ই দেখতে যাব আমরা? হয়ত এই কারণেই এত ওয়েল-বিল্ট, ওয়েল-পারফর্মড একটা নাটকে দর্শক হয়নি সে অর্থে। মানছি প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে, কিন্তু ক্লাসিক মানেই তো যুগে যুগে তা প্রাসঙ্গিক থাকবে, তার মানে কি নতুন রকম লেখাই হবে না? নির্দেশকের কি মনে হয়নি ক্যাপিটালিসমের চরিত্রও আজ ২০১৯ এ এসে বদলে গেছে অনেকটা? তার থেকেও বড় কথা… এই নাটকের প্রেক্ষাপট, অ্যামেরিকাও তো বদলে গেছে অনেকটা! যতই “১৯৪৯ এর লেখা দেখছেন” বলে দেখানো হোক না কেন মাস কনশাসনেসে তো আমেরিকার আরও অনেক গুলো দিক ঢুকে পড়েছে… এখনও শুধু বিভিন্ন বিখ্যাত নাটকের প্লট নিয়ে এদিক ওদিক করে যাচ্ছি আমরা, অধিকাংশ রিভিউতেই অমুক অনুপ্রাণিত তমুক নাটক লিখতে হয়… অরিজিনাল প্লে না হলে থিয়েটার টিকবে কিসের ভিত্তিতে? যাঁরা যোগ্য, যাঁদের সুযোগও রয়েছে তাঁরা এরকম করলে বড় মন খারাপ লাগে।

 

Ebong Ipsita
A Kolkata based theatre practitioner, she has been doing theatre from 2005 and now she is co-directing and adapting plays for different theatre groups in Bengal. She believes to explore the web medium as well to express herself to the world.

 

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us