চক্কর – একটি সাধারণ হাস্যরসাত্মক নাটক, নাট্যপ্রয়োগ আশির দশকে আবদ্ধ

Posted by Kaahon Desk On April 13, 2020

প্রখ্যাত আইরিশ সাহিত্যক, কবি তথা নাট্যকার অস্কার ওয়াইল্ডের (১৮৫৪-১৯০০) ছোটগল্পের অনুপ্রেরণায় নান্দীপট নাট্যদল তাদের নতুন প্রযোজনা ‘চক্কর’ এর প্রথম অভিনয় উপস্থাপিত করেছে একাডেমি মঞ্চে গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি। মধুসূদন মঞ্চে গত ১১ মার্চ হ’ল এই নাটকের আরেকটি অভিনয়। মূলগল্প ‘Lord Arthur Savile’s Crime’ থেকে বাংলা নাট্যরূপ দিয়েছেন শর্মিলা মৈত্র। নাটকটির নির্দেশনা করেছেন বিমল চক্রবর্তী।

এক সম্ভ্রান্ত বংশের তরুণ জিমি আচমকা এক জ্যোতিষীর ভবিষৎবাণীকে তার আসন্ন বিবাহের পথে বাধা হিসেবে কল্পনা করে নিয়ে মানসিকভাবে বিচলিত হয়ে পড়ে। সেই ভবিষৎবাণীকে নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলতে চেয়ে জিমি নানা কৌশল অবলম্বন করে, কাছের মানুষদের বারবার ব্যবহার করে, কিন্তু বারবারই অসফল হতে থাকে। হাস্যরসাত্মক এই নাটকে শেষপর্যন্ত কী ঘটে সেটা জানবার জন্য নাটকটি অবশ্যই দেখতে হবে। অদেখা ভবিষ্যৎ জীবনের পথকে সুগম, বাধাহীন করবার বাসনায় (চক্করে) একজন সাধারণ যুবকের মধ্যে অপরাধী মানসিকতা কীভাবে জন্ম নেয় তা’ এই কাহিনীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।

Previous Kaahon Theatre Review:

প্রায় সোয়াশতাব্দী আগের ইউরোপীয় পটভূমিকায় লেখা কোনো গল্পকে বর্তমান সময়ে এনে বাংলা নাটক হিসেবে উপস্থাপন করতে গেলে বেশ কিছু বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। স্থানকাল পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবেশ-পরিস্থিতি, চরিত্রগুলোর মানসিকতা, ভাবনা-চিন্তার পরিবর্তন ঘটানোরও দরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, আলোচ্য নাটকে এরকম কোনও প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি। নাটকে অস্কার ওয়াইল্ডের গল্পকে হুবহু অনুসরণ করা হয়েছে, সঙ্গে শুধুমাত্র একটি চরিত্র যুক্ত করা হয়েছে যা এক দার্শনিক ধরনের বিবেক! এই চরিত্রের মাধ্যমে কাহিনীতে কিছুটা নতুন মাত্রা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বটে কিন্তু তা’ যে খুব একটা সফল হয়েছে সেটা বলা যাবে না। অথচ, কাহিনীতে কিছুটা পরিবর্তন এনে, বর্তমান সময়ের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ কিছু ঘটনা যুক্ত করে, নাটকটিকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার বিশেষ সুযোগ ছিল। যেমন ধরা যাক, ভবিষৎবাণী নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা বা বিচলিত হওয়া আজও খুব সাধারণ ঘটনা। এর মূলে কাজ করে মানুষের মনে জমে থাকা ধর্মভীরুতা আর অন্ধবিশ্বাস, যাকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাষ্ট্রশক্তিও মানুষকে পরিচালিত বা বিপথে চালিত করছে। নাটকের মূলভাবকে ব্যক্তির সমস্যা হিসেবে আবদ্ধ না রেখে সামাজিক সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন করা গেলে নাটকটি বর্তমান সময়ের জন্য অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারতো, এবং সেটা এই নাটকের হাস্যরসাত্মক ফর্মটি বজায় রেখেই করা সম্ভব ছিল।

নাটকের উপস্থাপন ভঙ্গিটিও যথেষ্ট প্রাচীনপন্থী, আশির দশকের শুদ্ধ চিত্তববিনোদনমূলক নাটকগুলির সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায়। জিমি চরিত্রর পরমর্শদাতা ধূর্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত সক্রেটিস মাকাল চরিত্রটি নাট্যকার সৃষ্ট, এই চরিত্রটি কিছুটা হলেও তাৎপর্যপূর্ণ। নির্দেশক বিমল চক্রবর্তী তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে চরিত্রটি চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার স্বভাব সিদ্ধ স্বাভাবিক  অভিনয়ের পাশে বাকিদের অভিনয় বেশ সাধারণ মানের বলে মনে হয় এবং দু’একজনের চিৎকৃত অভিনয় বেশ কৃত্রিম লাগে। তাই সক্রেটিস চরিত্রটি মঞ্চে উপস্থিত থাকার দৃশ্যগুলির সঙ্গে বাকি দৃশ্যগুলির অভিনয়গতভাবে সমতা বজায় থাকে না, সামগ্রিক প্রযোজনাটিও তাই জমাট বাঁধতে পারে না। এই ব্যর্থতার দায় অনেকাংশেই নির্দেশকের উপর বর্তায়। সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও নাটকটি শুধুমাত্র একটি সাধারণ হাস্যরসাত্মক নাটক হিসাবেই দর্শকদের কাছে পৌঁছায়।

পাতার বাঁশি – নাট্য নির্মাণে নিষ্ঠা ও একাগ্রতা, একটি উপভোগ্য নাট্যঅভিজ্ঞতাসন্দীপ সুমন ভট্টাচার্যের মঞ্চ ভাবনায় অবশ্য আধুনিকতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। পার্টিশনে হাতের তালুর মতো প্রতীকী আকার নাটকের মূলভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কয়েকটি জিনিস অদল বদল ও পরিবর্তন বা সংযোজন করে দৃশ্যান্তর ভাবনাগুলি ভালোই, তবে অল্পসময়ের মধ্যে বার কয়েক দৃশ্য পরিবর্তন এবং সেই সংক্রান্ত দীর্ঘ সূত্রতা নাট্যগতিকে কিছুটা ব্যাহত করে। ত্রিগুণাশংকরের আলো নাটকের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়েছে মাত্র, আলাদা কোন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহ সমন্ধে একই কথা প্রযোজ্য, হাস্যরসাত্মক অনুভবটি প্রকাশ করতে পারলেও সামগ্রিকভাবে বিশেষ কোনো ছাপ রাখতে পারে না। সেই তুলনায় সহেলী মৈত্রের পোশাক পরিকল্পনা চরিত্রানুসারে বাস্তব ও মানানসই। সব মিলিয়ে বলা যায়, পুরো প্রযোজনাটার মধ্যেই একধরনের দায়সারা ও তাড়াহুড়ো ভাব লক্ষ্য করা যায়, যা কিনা ভালো নাটকের পরিপন্থী।

বাংলা নাট্যজগতে নান্দীপট একটি বিশিষ্ট নাম। তাদের পূর্ববর্তী বেশ কয়েকটি প্রযোজনা দর্শকদের মনে যে বিশেষ প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছিল, এ নাটক তা’ পূরণ করতে পারে না। বর্তমানে বাংলা নাট্যজগতে চটজলদি সাফল্যের যে হাতছানি রয়েছে, এই নাটকের প্রযোজনা যেন তারই প্রতিফলন। তবে আশা আছে, নান্দীপট তার আগামী কাজের মাধ্যমে আবার পরিশ্রমসাধ্য মননশীল নাটক দর্শকদের উপহার দিতে পারবেন।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us