খাজাঞ্চিবাবু – বাংলা নাট্যে বাংলা সাহিত্য; বিদেশী নাটক ও চলচ্চিত্র থেকে মুক্তি

Posted by Kaahon Desk On December 20, 2019

গত ৩০শে নভেম্বর তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহের অন্তরঙ্গ পরিসরে অভিনীত হল ‘বারাসাত কাল্পিক’ প্রযোজিত নাটক ‘খাজাঞ্চি বাবু’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ছোট গল্পটিকে নাট্যরূপ দিয়েছেন সুপ্রিয় সুর, নির্দেশনা অনুরণ সেনগুপ্ত।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথা সাহিত্যিক। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তাঁর একাধিক উপন্যাসও গল্পের বিষয়বস্তু। সমাজের উপেক্ষা, অবহেলা, অশিক্ষা, ও কুসংস্কারের বাস্তব চিত্র তার গল্পে মুন্সীয়ানার সঙ্গে উঠে আসে। ‘খাজাঞ্চিবাবু’ গল্পে নবযুগের কায়দাকানুনের কাছে পুরোনো ধ্যানধারণা বাতিল হয়ে যাওয়ার কাহিনীকেই তুলে ধরে ছিলেন। সংসারের বাস্তবতায় মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই সে পরিত্যাজ্য,উচ্ছিষ্টের ন্যায় বর্জনীয় – কর্মক্ষেত্রে মানুষের এই শোকবহ পরিণতিই এই গল্পের উপজীব্য। মূল গল্পে মানভূম অঞ্চলের ফায়ারব্রিক্স কারখানার খাজাঞ্চিবাবুর বিদায় নেবার দৃশ্যটি একেবারে অনাড়ম্বর ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল বলেই তা’ পাঠক মনকে বিশেষভাবে স্পর্শ করেছিল। সময়ের পরিবর্তন ঘটে, নতুনকে স্থান করে দিতে পুরাতনকে বিদায় নিতেই হয়, এটাই বাস্তব। প্রতিনিয়ত মানুষকে নানা প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করতে হয় তবু সে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলে কী করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এই পৃথিবী, এই প্রিয় সংসার ছেড়ে মানুষ যেতে চায় না, তবু তাকে যেতে হয়। জন্ম-মৃত্যু নিয়ম শাসিত এই পৃথিবীতে মানব জীবনের এই হল সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি।

Previous Kaahon Theatre Review:

নতুন প্রজন্মের কোন নবীন নির্দেশক যখন এতদিন আগে লেখা কোনো গল্পকে নাট্যরূপে মঞ্চে নিয়ে আসেন তখন দর্শক হিসেবে মনে প্রশ্ন জাগে, নাটকের প্রকাশ বা উপস্থাপনা কেমন হবে? স্থান,কাল,পাত্র এক রেখে মূলকাহিনীটিকেই নাট্যরূপে তুলে ধরা হবে? নাকি পরিবর্তন,পরিমার্জন, বা সংযোজনের দ্বারা নতুন ভাবে এবং ভাবনায় প্রকাশ করা হবে? এখানে নাট্যকার ও নির্দেশক মিলে, কাহিনীর স্থান এবং পাত্র প্রায় এক রেখে, কালটিকে একেবারে বর্তমান সময়ে নিয়ে এসেছেন। নাটকের শুরুতে উপস্থাপনার ভাবনাটি বেশ ভালো লাগে। মূলগল্পে খাজাঞ্চিবাবুর বিদায় দৃশ্যটি দিয়ে গল্পের সমাপ্তি হয়, এখানে নাটকের শুরু হয় সেই দৃশ্যটা দিয়েই। এরপর খাজাঞ্চিবাবু ফায়ারব্রিক্স কারখানায় তার চোদ্দো বছরের কিছু অভিজ্ঞতার কথা (সূত্রধার রূপে) শোনাতে থাকেন এবং সেই সূত্র ধরে টুকরো টুকরো ফ্ল্যাশব্যাকের মধ্য দিয়ে মূলগল্পটি অভিনীত হয়। উপস্থাপনায় গল্পের শেষ থেকে শুরুর কৌশলটি অবশ্য বাংলা নাটকে নতুন কোনো ব্যাপার নয়, শুধু গতানুগতিকতার থেকে একটু বেরিয়ে আসা আর কি। নাটকে খাজাঞ্চিবাবুর ভূমিকায় দুজন অভিনেতা অভিনয় করেন, একজন গল্পটি বলেন অন্যজন ফ্ল্যাশব্যাকের দৃশ্যে অভিনয় করেন। প্রয়োগটি সিনেমাটিক, বেশ চতুর প্রয়োগ, এবং নাটকের ফর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তবে বহুদিন আগে লেখা কোন গল্পকে বর্তমান সময়ে এগিয়ে এনে অভিনয় করতে হলে অনেকগুলি দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। শুধুমাত্র মোবাইল ফোনের ব্যবহার, কম্পিউটারের বা মেট্রোরেলের উল্লেখ, সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে কিছু প্রতিক্রিয়া, অথবা এই সময়ের ফিল্মিগানের উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে যদি বর্তমান সময়কে প্রকাশ করা হয়, তবে যা ঘটার এখানে তাই ঘটেছে। চরিত্রের সংলাপ, হাবভাব, আচরণে আধুনিক সময়ের ছাপ না থাকায় সামগ্রিক ব্যাপারটিতে বিশ্বাসযোগ্যতার বড্ড অভাব থেকে যায়। তারাশঙ্করের গল্পের কোনো নতুন ইন্টারপ্রিটেশন দেওয়া হয় না, শুধুমাত্র কাহিনীর গায়ে একটি আধুনিক সময়ের চাদর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা হয়। গল্পকে আধুনিক সময়ে আনতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই, বক্তব্য বা অনুভূতি সমকালীন হলে দর্শক এমনিতেই সেটা অনুভব করবেন। তবে আধুনিক সময়ে যদি নিয়ে আসতেই হয় তা হলে তার জন্য উদ্ভাবনাশক্তিকে সঠিক খাতে চালনা করা প্রয়োজন, নইলে অযত্নের ছাপ প্রকট হয়ে দেখা দেয়। নাটকের শেষ দৃশ্যে দুজন খাজাঞ্চিবাবুর সাক্ষাৎ, কথোপকথন ও একসাথে চলে যাওয়া অবশ্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে দিয়ে মানবজীবনের অমোঘ পরিণতি ‘মৃত্যু’কে ইঙ্গিত করে।

নাটকে সামগ্রিক অভিনয়ের মান বেশ ভালো। উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি ও শারীরিক অভিনয়ের মধ্যে অনুশীলন এবং পরিশ্রমের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। খাজাঞ্চিবাবু-১ (অনুরণ) ও খাজাঞ্চিবাবু-২(অনিরুদ্ধ) দুজনের অভিনয়ের মধ্যে একটি সমতা (similarity) বজায় ছিল, তার জন্য দুজনেই প্রশংসার যোগ্য। ভিখারীনি চরিত্রে পূবালীর আবেগযুক্ত অতি অভিনয় অন্যান্য অভিনেতাদের পাশে অস্বাভাবিক লাগে। নাটকে একটি মাত্র নারী চরিত্র থাকায় এই বৈপরীত্য আরও বেশি করে চোখে পড়ে। অল্প কয়েকটি আলোক উৎস দিয়ে অর্ণবের অনাড়ম্বর আলোক পরিকল্পনা ভালো লাগে। সৌভিক ও দেবার্ঘের আবহে স্টক মিউজিক ও তার পরিমিত ব্যবহার নাট্যগতিকে সঠিক পথে চালিত করে। দেবব্রত ব্যানার্জির সাজেস্টিভ মঞ্চ পরিকল্পনায় বুদ্ধিদীপ্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনটি চাকাযুক্ত দরজার ফ্রেমকে নানাভাবে অবস্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন দৃশ্য তৈরি করা বেশ সুন্দর এবং তাতে বিশ্বাসযোগ্যতার কোনো অভাব ঘটে না।

শব চরিত্র কাল্পনিক – তারুণ্য, উৎসাহ, উদ্দীপনা, উদ্ভাবনায় ভরা একটি নাট্য প্রযোজনাবর্তমানে বাংলা নাট্যজগতে দেখা যাচ্ছে যে অধিকাংশ নাট্যদলগুলিই হয় বিদেশী নাটকের অক্ষম অনুবাদ, বা চলচ্চিত্র থেকে স্রেফ টুকে দেওয়া, নয়তো অগভীর ভাবনা দ্বারা নাটককে কেবলমাত্র লঘুচিত্ত বিনোদনের মাধ্যমে পরিণত করে তুলেছে। তারই মধ্যে একদল প্রতিভাবান নবীন নাট্যোৎসাহী দ্বারা গঠিত ‘বারাসত কাল্পিক’ দলটি বাংলা সাহিত্য থেকে নাট্যসৃষ্টির প্রয়াস করেছেন, এবং তাদের কাজের মধ্যে নিষ্ঠা ও সততা প্রতিফলিত হচ্ছে, তা অবশ্যই সাধুবাদের যোগ্য। এখন আমাদের (দর্শকদের) সামনে সময় এসেছে স্পষ্ট করে ভালো বা মন্দ লাগাকে বুদ্ধি, যুক্তি, আর বিবেচনা দিয়ে প্রকাশ করার, তবেই বাংলা নাট্যজগৎ কৃত্রিমতার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারবে।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us