অথৈ জল – উপন্যাসের মঞ্চরূপ, একটি সাহিত্যধর্মী নাট্য

Posted by Kaahon Desk On June 14, 2019

বাংলা থিয়েটারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে। হাতে গোনা যেক’টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তার মধ্যে বেশিরভাগই কয়েকটি মাত্র প্রদর্শনী হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে আরণ‍্যক, কিন্নর দল, পথের পাঁচালী, অশনি সংকেত, এবং আদর্শ হিন্দু হোটেল বাংলা রঙ্গমঞ্চে পরিবেশিত হয়েছে। তবুও শুধুমাত্র আদর্শ হিন্দু হোটেলের কথা মানুষের কিছুটা জ্ঞাত আছে, বাকি সবকটিই স্মৃতির অতলে ধূসর। আদর্শ হিন্দু হোটেল পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রঙমহল ও শ্রীরঙ্গমে নিয়মিত অভিনয়ের ফলে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, তাই সে নাটক মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে এবং প্রসঙ্গক্রমে তা নিয়ে আজও চর্চা হয়। বিভূতিভূষণের রচনার বিশাল ব্যাপ্তি, যাকে বলা যায় ‘আকাশের ক্যানভাসে জীবনের ছবি’। সেই বিশালতাকে মঞ্চের স্বল্প পরিসরে এনে সাহিত্যের মূলভাবকে অক্ষুন্ন রেখে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা কষ্টসাধ্যই নয় প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি, তাই বাংলা রঙ্গমঞ্চে বিভূতিভূষণের উপস্থিতি খুবই কম। পূর্ব পশ্চিম নাট্যদল বিভূতিভূষণের উপন্যাস ‘অথৈ জল’-কে মঞ্চে এনে সেই অসম্ভবকে চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে সম্ভব করতে পেরেছেন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে এই নাট্যদলটিতে সূচনা পর্ব থেকেই এই ধরণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের একটা নিজস্ব ধারা প্রবহমান।  যেমন ইতিপূর্বে এরা রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্য রচনাকে বিস্তৃত আকারে মঞ্চে উপস্থাপনে সচেষ্ট থেকেছেন। এই ধারায় বিশেষ সংযোজন তাদের নতুন প্রয়োজনা ‘অথৈ জল’। উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়েছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, এবং সম্পাদনা ও নির্দেশনা ব্রাত্য বসু। নাটকটির তিরিশতম অভিনয় মঞ্চস্থ হল গত ২৭শে এপ্রিল, গিরিশ মঞ্চে।

Previous Kaahon Theatre Review:

বাতাসপুর গ্রামের মাঝবয়সী ডাক্তার শশাঙ্ক মুখার্জি, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুখেশান্তিতে সংসার করে। সে একজন কঠোর নিয়মানুবর্তী ও নীতিনিষ্ঠ মানুষ। গ্রামের সে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, তাই গ্রামের যে কোনো সামাজিক সমস্যা সমাধানে সবাই তার শরণাপন্ন হয় এবং তার বিচারই গ্রামের মানুষ শিরোধার্য করে।  নীতিতে বিশ্বাসী শশাঙ্ক সদাসর্বদা গ্রামকে যে কোন রকম কলঙ্ক থেকে মুক্ত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। গ্রামের কোনো মানুষের সামান্যতম নীতিভ্রষ্ট আচরণ সে কঠোর হাতে দমন করে। মনের দিক থেকে সে বড় মাপের মানুষ, দরিদ্র রোগীদের সে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে। নিজের ডাক্তারি আর সামাজিক মঙ্গলই তার জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। অন্য কোনো আমোদ বা আসক্তির ইচ্ছা বা সময় কোনোটাই তার নেই। একদিন মঙ্গলগঞ্জে রুগী দেখার পর ঝড়জলের কারণে সে আটকে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামবাসীরা বিশেষ উপলক্ষে খ্যামটা নাচের আয়োজন করেছিল। সেই নাচ দেখার জন্য শশাঙ্ককে আমন্ত্রণ করা হয়, প্রথমে অসম্মত হলেও পরে সকলের অনুরোধে নাচের আসরে যোগ দেয়। সেখানে সুন্দরী, যুবতী, লাস্যময়ী, নর্তকী পান্নার নাচ দেখে তার প্রতি বিশেষভাবে আকর্ষিত হয়। তার রূপ, দৃষ্টি, আর নৃত্য ভঙ্গিতে বিমোহিত হয়ে শশাঙ্ক আরবী আনন্দ ও ভালোবাসার অথৈ জলে ডুবে দেয়। সে অনুভব করে যে সে তার স্ত্রী সুরবালাকে ভালোবাসে একথা সত্য, কিন্তু আজ পান্নার কাছ থেকে সে যা পেল সুরবালার কাছ থেকে তা’ সে কোনো দিনই পাবে না। মুহূর্তে সমাজ, সংসার, ডাক্তারি, শৃঙ্খলা, নীতিবোধ সবকিছু তুচ্ছ করে সে পান্নার হাত ধরে কলকাতায় চলে আসে। শশাঙ্ক পান্নার রোজগারে পান্নার সাথেই থাকতে শুরু করে।  দুটি অসম বয়সী ও সমাজের ভিন্ন স্তরে অবস্থানকারী নারী ও পুরুষ মিলিত হয় অমোঘ প্রেমের কারণে। ভালোবাসাই হল এই কাহিনীর মূল উপজীব্য।

লিখিত উপন্যাসকে নাট্যরূপ দিতে গেলে বিশেষ কিছু পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন বা বিয়োজন নাট্যকারকে করতেই হয়।  এক্ষেত্রে নাট্যকার এই সবগুলোই করেছেন তবে কিছু ক্ষেত্রে এগুলো নাটককে সমৃদ্ধ বা তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে, আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে তা অপ্রয়োজনীয় বা মূলভাবের বিপরীত চলন বলে মনে হয়েছে। যেমন শশাঙ্কের অন্য দুটি সত্তাকে (কিশোর ও যুবক) মঞ্চে এনে তার মনের দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্ন স্তরকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন। নাচের আসরে দুজন পান্নার ব্যবহার করে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সিনেমাটিক প্রয়োগ সুন্দরভাবে নাটকে কাজে লাগিয়েছেন।  শশাঙ্ক ও পান্নার মানসিক অবস্থার যে চিত্র বিভূতিভূষণ তাঁর লেখার মাধ্যমে পাঠকদের কাছে সহজেই পৌঁছে দিতে পেরেছেন, তা’ কিন্তু একজন নাট্যকারের পক্ষে দৃশ্যভাবনা ও সংলাপের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সহজ কাজ নয়, কিন্তু তা’ তিনি দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছেন। এখানে নির্দেশকও বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। প্রতিটি চরিত্রকে যতখানি জায়গা দিলে তার সঠিক রূপ প্রকাশ পেতে পারে তা’ তিনি হিসেব করেই করেছেন। তবে দারোগা চরিত্রটি মূল উপন্যাসে অন্যায়ের বিপরীতে ভয়ের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছিল। নাটকে তা ঘুষখোর ও চরিত্রহীন হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে, ফলে চরিত্রটির রূপ অনেকটাই বদলে গেছে যার খুব একটা প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। উপন্যাসের শেষটা পরিবর্তন করা হয়েছে। পান্নার সাথে বিচ্ছেদের পর শশাঙ্কের চরম দুর্বিষহ অনুভূতি ও তার মনের অস্থির অবস্থার এমন এক পর্যায়ে মূল উপন্যাসটির পরিসমাপ্তি ঘটে যে তা’ পাঠকের মনে ভাবনার এক পরিসর এনে দেয় যা কিনা প্রেমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আখ্যানটিকে সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে। নাটকে দেখানো হয়েছে পান্নার সাথে বিচ্ছেদের পর সে আবার গ্রামে ফিরে আসে এবং স্ত্রী সংসার সহযোগে পূর্বের ন্যায় সুখে ও শান্তিতে জীবন যাপন করতে থাকে। এ ধরণের ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ আখ্যানের মূল ভাবটিকে ক্ষুণ্ণ করে।

শশাঙ্ক চরিত্রে দেবশঙ্কর হালদার চরিত্রের বৈপরীত্যকে বেশ পরিশ্রমের দ্বারা সুচারু রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। মাঝে মাঝে তার পরিচিত ম্যনারিজিম অভিনয়ে ছাপ ফেলে, তবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও অভিনয়ের অসীম ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এই ম্যানারিজিমকে তিনি চরিত্রের সাথে সুন্দরভাবে মিশিয়ে দেন। পান্নার চরিত্রে সুবর্ণা মৈত্র দাস দেবশঙ্করের পাশে অসাধারণ দক্ষতার সাথে অভিনয় করেছেন। একদিকে তার চরিত্রের কঠোর ব্যক্তিত্ব এবং অপর দিকে তার লাস্য ও যৌবনোচ্ছ্বলতাকে উচ্চারণ, চোখের ভাষা, ও অভিব্যক্তির মাধ্যমে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন। বাকিদের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে সুরবালার চরিত্রে রাজেশ্বরী নন্দী ও নীলির চরিত্রে চলন্তিকা গাঙ্গুলীর কথা। দুজনের অভিনয় বেশ সাবলীল লাগে। অন্যদের অভিনয় গতানুগতিক, বৈচিত্র্যের অভাব লক্ষ্য করা যায়।

কিরীটীর নোটবুক- একটি দায়সারা বাংলা নাটক

পৃথ্বীশ রানার মঞ্চভাবনা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ব্যবহার করে বিভিন্ন স্থান পরিবর্তন বোঝানো হয়েছে এবং চরিত্রের একস্থান থেকে অন্য স্থানে গমন এক দুটি দৃশ্যান্তরে সহজেই বোঝানো গেছে। বিভিন্ন ফ্রেম ব্যবহার করে ঘরের দরজা, দেওয়াল প্রভৃতির আভাস দিয়েছেন। দীনেশ পোদ্দারের আলোয় কোনো বাহুল্য ছিল না, ছিল চিন্তাশীলতা, ফলে শশাঙ্ক ও পান্নার বেশ কিছু দৃশ্য বিশেষ ব্যঞ্জনাময় নাট‍্যমুহুর্ত গড়ে তোলে। আলোর মতো আবহও (শুভদীপ গুহ) এই নাটকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছ। খ্যামটা ব্যবহারের মাধ্যমে নাটকের মূলভারকেন্দ্রটি নিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আবহ এখানে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছে। পান্নার কন্ঠের গান গেয়েছেন এই সময়ের জনপ্রিয় সুগায়িকা ইমন চক্রবর্তী। এটি নাটকে তার প্রথম কাজ যা দর্শকদের কাছে উপরি পাওনা। মালবিকা মিত্র ও মধুমিতা দামের পোশাক পরিকল্পনা সময়ের সাথে মানানসই তবে গ্রামবাসীদের ঝকঝকে ধুতি আর ইস্ত্রি করা ফতুয়া দৃষ্টিকটু লাগে। পান্নার ম্যানেজারবেশী শশাঙ্কের মাথায় ফেট্টি বাঁধার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না।

মঞ্চ, আলো, অভিনয়, আবহ, নাচ ও গান সহযোগে দু ঘন্টা পাঁচ মিনিটের উপস্থাপনাটি দর্শকদের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে তা’ হল ভর্তি দর্শকসংখ্যা দেখে অনুমান করা যায়। যদিও বর্তমানে দর্শকসংখ্যার আধিক্য বা স্বল্পতার নিরিখে প্রযোজনার মান নির্ণয় করা যায় না। পরিশেষে বলার কথা এই যে, বিভূতিভূষণের মতো একজন লেখক যাঁর রচনা বাংলা রঙ্গমঞ্চে খুব একটা উঠে আসে না, তাঁর রচিত একটি কম পরিচিত উপন্যাস ‘অথৈ জল’কে মঞ্চে আনার জন্য পূর্ব-পশ্চিম নাট্য দলকে বিশেষ ধন্যবাদ। আশা রাখি ভবিষ্যতেও তারা এই ধারা বজায় রাখবে।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us