কালমৃগয়া – একটি প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্র মঞ্চপ্রয়াস

Posted by Kaahon Desk On June 22, 2018

‘মুখোমুখি২২’ নাট্যউৎসবের শেষ দিন (১৪ই জুন, ২০১৮) মধুসূদন মঞ্চে অভিনীত হল বিলু দত্ত নিবেদিত ‘মুখোমুখি’ প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিনাট্য কালমৃগয়া, নির্দেশনা পৌলমী চট্টোপাধ্যায়। ১৮৮২ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ কালমৃগয়া গীতিনাট্যটি রচনা করেন। বিলেত থেকে কলকাতায় ফিরে ১৮৮১ থেকে ১৮৮২ সময় কালের মধ্যে রামায়ণ মহাকাব্যের ঘটনাকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং বিলাতি সুরকে নিজস্ব ঢঙে মিলিয়ে তিনি দুটি গীতিনাট্য রচনা করে ছিলেন, তার একটি বাল্মীকিপ্রতিভা ও অন্যটি কালমৃগয়া।

গীতিনাট্যের মূল ব্যাপার হ’ল সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয়ের সুষম সমন্বয়। বাল্মীকিপ্রতিভা ও কালমৃগয়া এই দুই ক্ষেত্রেই নাট্যের গতিকে সুচারু রূপে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে সঙ্গীত। দুই নাটকেরই বেশীরভাগ গান গদ্যছন্দে রচিত এবং সুরগুলিও অভিনয়ের উপযোগী। গীতিনাট্য দুটির সংগীতের মধ্যে যে বিদেশী সুরের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তার অন্যতম কারণ হিসেবে ‘জীবনস্মৃতি’-র লেখা থেকে জানতে পারি – “সেই সময় জ্যোতিদাদা (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর) প্রায়ই ওস্তাদি গানগুলিকে পিয়ানো যন্ত্রের মধ্যে ফেলে তাদেরকে যথেচ্ছ মন্থন করিত, তাতে ক্ষণে ক্ষণে রাগরাগিণীগুলির এক একটি অপূর্ব মূর্তি ও ভাবব্যঞ্জনা প্রকাশ পেত।” কবি ও অক্ষয়বাবু অনেক সময় জ্যোতিদাদার সেই বাজনার সুরে কথা বসাবার চেষ্টা করতেন, তাল বেতাল নৃত্যের সাহায্য একটা দস্তুর ভাঙা গীতি বিপ্লবের প্রলয় আনন্দে বাল্মীকিপ্রতিভা এবং কালমৃগয়া নাট্য দুটি রচনা হয়। রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা থেকেই জানা যায় যে, ইউরোপীয় অপেরা থেকে উদ্বুদ্ধ হলেও অপেরার মত সঙ্গীতই এর মধ্যে প্রাধান্য লাভ করে নি, এখানে নাট্যের বিষয়বস্তুকে সুর করে অভিনয় করা হয়েছে, আলাদা করে সঙ্গীতের মাধুর্য খুব কম জায়গায় আছে।

Previous Kaahon Theatre Review:

দশরথ কর্তৃক অন্ধমুনির পুত্রবধকে কেন্দ্র করে কালমৃগয়ার কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। তৃষ্ণার্ত অন্ধমুনির জন্য সরযূ নদীতে জল আনতে গিয়ে ঋষিপুত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভয় পেলেও পিতার তৃষ্ণার জল আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। রাজা দশরথ শিকারে এসে এক হরিণ শিশুর পিছনে ছুটে, নদীতে জলের শব্দ শুনে ভুল করে হরিণ শিশু ভেবে তীর চালনা করেন এবং তা ঋষিপুত্রের গায়ে লাগে। প্রাণত্যাগের আগে সে দশরথকে অনুরোধ করে তার দেহটি পিতার কাছে নিয়ে যেতে, দশরথও সেই মত কাজ করে। প্রথমে অন্ধমুনি বেদনায় ও ক্রোধে দশরথকে পুত্রশোক লাভের অভিশাপ দেন এবং পরে তাকে ক্ষমাও করে দেন। এই গীতিনাট্যে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ দিক ফুটে ওঠে। কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সে তার মধ্যে মৃত্যুচেতনা ও ক্ষমার মনোভাব লক্ষিত হয়। আরো গভীরভাবে ভাবতে গেলে অমৃত মৃত্যুই ক্ষমার মাহাত্মকে প্রকাশ করে।

মুখোমুখি প্রযোজিত কালমৃগয়া মূলত রবীন্দ্রনাথের লিখিত রূপটিকেই অনুসরণ করেছে, তবে নির্দেশক তাঁর নিজস্ব ভাবনাকেও জায়গায় জায়গায় সুন্দরভাবে সংযুক্ত করেছেন। অন্ধমুনি, মুনিপুত্র, বা রাজা দশরথের জন্য গদ্যছন্দে রচিত গানগুলিকে এই নাট্যে সুর বর্জিত করে কাব্যিক সংলাপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে বনদেবতা ও বনদেবীর সব কটি গানই গীত হয়েছে, প্রতিটি গানই সুগীত। সংগীত আয়োজনেও (music arrangement) দক্ষতার ছাপ লক্ষ্য করা যায় যা নাট্যের গতিকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে চলে। বিদূষকের চরিত্রটি বাদ দেওয়া সঠিক ভাবনা বলেই মনে হয়, শুধুমাত্র কৌতুক পরিবেশনের বাইরে চরিত্রটির বিশেষ কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় নি। রাজার শিকারীদের দৃশ্যটি শুধুমাত্র আবহসঙ্গীতের মাধ্যমে সুন্দরভাবে কোরিওগ্রাফ করা হয়েছে, মূলত রবীন্দ্রনৃত্য ধারাই ব্যবহার করে। তবে শিকারীদের নাচটিতে পাশ্চাত্য নৃত্যশৈলী ব্যবহার করা হয়েছে।

আলো ও আবহের মান একটি নাট্য পরিবেশনার উৎকর্ষ অনেকাংশে বৃদ্ধি করতে পারে, বিশেষ করে নাচ যেখানে নাটকের অধিকাংশ সময় জুড়ে আছে। এখানে আলো (মনোজপ্রসাদ) ও আবহের (দিশারী চক্রবর্তী) সুষ্ঠু সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় নাট্য পরিবেশ সৃষ্টিতে সমর্থ। এরসাথে সৌমিক-পিয়ালীর মঞ্চভাবনা সংযুক্ত হয়ে নাট্যকে একটি সার্থক রূপ দিতে সাহায্য করেছে। মঞ্চ প্রসঙ্গে বলতে হয় রঙিন সরু কাপড় এবং সামান্য কিছু সামগ্রী ব্যবহার করে যে পরিবেশ সৃষ্ট করা হরেছে তাতে যেমন গহন অরণ্যের অনুভূতি আছে তেমনি বনের স্নিগ্ধ, শান্ত, শীতলতার পরশও পাওয়া যায়। এই নাট্যে রূপসজ্জা (সঞ্জয় পাল) ও পোশাক পরিকল্পনা বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছে। পোশাক পরিকল্পনায় গতানুগতিক রবীন্দ্রভাবনা থেকে সরে এসে স্বতন্ত্র ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে, চরিত্রদের বিশ্বাসযোগ্যতা স্থাপনে রূপসজ্জা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, শিকারীদের কালো পোশাক ও লাল ফেট্টি উন্মত্ততা ও ভয়াবহতা সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছে।

প্রথম দৃশ্যে লীলার নৃত্য ভাবনার মধ্যে তাদের কৈশোরের চপলতা, উচ্ছ্বলতা ও সরলভাব প্রকাশ পেয়েছে। শুধুমাত্র শিকারীদের নাচের অংশটি বাদ দিয়ে বাকি নৃত্যের পরিকল্পনা নির্দেশক পৌলমী চট্টোপাধ্যায়ের। পৌলমী একজন দক্ষ নৃত্যশিল্পী, বনদেবীর নাচে তিনি অন্যদের সাথে সমান তালে ও সমান এনার্জি বজায় রেখে নেচে গেছেন, তবে মাঝেমাঝে দৃশ্যত তাকে আলাদা করে চোখে পড়েছে যা একটু বেমানান। শিকারীদের নাচের অংশটি মানস মুখার্জির তত্ত্বাবধানে অন্য একটি নৃত্যগোষ্ঠী (দলের নামটি জানাতে না পারার জন্য দুঃখিত) পরিকল্পনা ও পরিবেশনা করেছেন। পাশ্চাত্য নৃত্যশৈলী দ্বারা গঠিত এই নৃত্য ভাবনা বেশ চমকপ্রদ। শিকারীর দল এখানে ধ্বংসের প্রতীক আর বনদেবীরা প্রকৃতির রূপ। প্রকৃতির রূপকে রবীন্দ্র তথা ভারতীয় নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে প্রকাশ করা হ’ল আর ধ্বংসের রূপকে পাশ্চাত্য নৃত্যশৈলীর দ্বারা তুলে ধরা হ’ল, ভালো মন্দের এ এক অতি সরলীকৃত বিশ্লেষণ! তাৎপর্যপূর্ণভাবে লক্ষণীয় যে বর্তমান সময়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব ভারতীয় সংস্কৃতিতে দারুণ ভাবে অনুপ্রবেশ করেছে, ফলে ভারতীয় সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা কমে যাচ্ছে বলে অনেকেরই মত, বিশেষত শুদ্ধাচারীরা সেভাবেই ভাবেন। নতুন প্রজন্ম অতি সহজেই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে, তবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে অন্ধভাবে অনুকরণ না করে যদি দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধন সঠিকভাবে ঘটানো যায় তবে আখেরে উভয়েরই মঙ্গল, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই। তাই রবীন্দ্র-নির্ভর প্রযোজনায় এই ধরণের নৃত্যপ্রয়োগ রবীন্দ্র-ভাবনার বিপ্রতীপ বলেই মনে হয়।

এই প্রযোজনার বিশেষ আকর্ষণ ও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হ’ল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণ। তিনি অন্ধমুনির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি ও উচ্চারণ সর্বদাই আমাদের মুগ্ধ করে। এখানে তার অভিনয় মূলতঃ বাচিক, তার বাচনভঙ্গির দৃপ্ততা ও কুশলতা অনায়াসভাবে দর্শকদের মনকে ছুঁয়ে যায়, তাঁর কন্ঠে এক কলি গান আমাদের উপরি পাওনা।

কালমৃগয়া করুণরসের কাহিনী একথা সত্য তবে তা শুধু দশরথ কর্তৃক অন্ধমুনিপুত্র বধের জন্য নয়, আরো একটি উপকাহিনী আছে – তা হ’ল শিকারীদল দ্বারা প্রচুর পশুপাখির নিধন এবং বনের পরিবেশকে তছনছ করা। এটাও কম করুণ নয়। বর্তমান বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়নের ফলে মানুষ যে চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছে তার কারণ কিন্তু যথেচ্ছ বৃক্ষ ছেদন ও নির্বিচারে পশুপাখি নিধন। এরফলে আমাদের পরিবেশের সমতা ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাচীনকালেও রাজারা মৃগয়ার মাধ্যমে পশু শিকার করে আত্মতৃপ্তি লাভ করত এবং তা ছিল তাদের বিলাস ব্যসনের অঙ্গ কিন্তু এই গীতি নাট্যে দশরথের মৃগয়া করতে এসে হরিণ শিশু ভ্রমে ঋষিপুত্র বধের কারণে তার জীবনে কাল-বীজ বপন হয়ে গেছিল। আমরা প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে চিন্তা না করে নির্বিচারে বৃক্ষ ও পশু নিধন করে যে কাল-বীজ বপন করে ফেলছি তা’ বিষবৃক্ষ হয়ে ভবিষ্যতে আমাদের পৃথিবীর বুকে খোলা বাতাসে নিশ্বাস নিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এই কারণে একশ ছত্রিশ বছর আগে লেখা নাটক কালমৃগয়া আজও প্রাসঙ্গিক এবং এর প্রযোজনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us