জেরা – প্রখ্যাত বিদেশি সিনেমার হুবহু অনুসরণ, বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব নাট্যে

Posted by Kaahon Desk On October 19, 2019

গত ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে গিরিশ মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল ‘শোহন’ নাট‍্যদলের নাটক ‘জেরা’। Giuseppe Tornatore পরিচালিত ছবি A Pure Formality (1994) অবলম্বনে নাটকটি লিখেছেন জগন্নাথ গুহ, নির্দেশনায় অনীশ ঘোষ। নাটকটি ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অনুদানপ্রাপ্ত।

তোর্ণাতোরে একজন বিশ্ববন্দিত পরিচালক, তার Cinema Paradiso (1988) একটা কাল্ট ছবি! আর আপনি যদি Malena (2000) নাও দেখে থাকেন, তবুও মালেনা অনুপ্রাণিত বেশ কয়েকটি ভারতীয় ছবি আপনি অবশ্যই দেখেছেন! তবে ‘এ পিওর ফর্মালিটি’ ছবিটি তোর্ণাতোরের স্ট‍্যানার্ডে বেশ সাধারণ মানের ছবি। জেরার দেপার্দিউ বা রোমান পোলানস্কি, ছবিতে কেউই যে খুব দুর্দান্ত অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন, এমন‌ও নয়। ছবির কাহিনী কিছুটা রহস‍্যধর্মী, তার সঙ্গে কিছুটা অস্তিত্ববাদী ধ‍্যানধারণা পাঞ্চ করে দেওয়া। খুব যে একটা ভালো করে মিশ খেয়েছিল, এমনটাও বলা যায় না। এক অন্ধকার ঝড়জলের রাতে এক ব‍্যক্তিকে রাস্তায় দৌড়তে দেখা যায়, পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে, অফিসার তাকে জেরা করতে থাকেন। কী সেই ব‍্যক্তির পরিচয়, তিনি আদৌ কোনো অপরাধ করেছেন কিনা, বা কোনো অপরাধ আদৌ সংঘটিত হয়েছে কিনা, এই নিয়ে ধোঁয়াশা চলতে থাকে পুরো ছবি জুড়ে। ছবির টেকনিক কিছুটা নাটকধর্মী, অনেকটাই সংলাপ নির্ভর, সিংহভাগ ঘটনা ঐ থানার ভেতরেই! তবে সব মিলিয়ে ছবিটি দর্শকের মনোযোগ টেনে রাখতে ব‍্যর্থ হয়। আর যেহেতু ছবির শেষের দিকে আসল ঘটনাটা দেখিয়ে দেওয়া হয়, তাই ছবির অস্তিত্ববাদী মুখোশটা খসে পড়ে, আর দর্শক কিছুটা ঠকে যাওয়ার অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফেরেন।

Previous Kaahon Theatre Review:

‘জেরা’ নাটকটি নিয়ে আলোচনার সূত্রে মূল ছবিটি নিয়ে এত কথা বললাম তার কারণ হল, নাটকটি ঐ ছবিটিকে প্রায় হুবহু অনুসরণ করে, সিন বাই সিন, মায় ডায়লগ টু ডায়লগ। শুধু শেষের দিকে মূল ঘটনাটি পরিষ্কার করে দেওয়া হয় না, ফলে অস্তিত্ববাদী মুখোশটা অটুট থাকে, আর দর্শক কিছুটা কনফিউজড অবস্থায় বাড়ি ফেরেন! একটা সত‍্যিকারের অস্তিত্ববাদী নাটক দর্শককে তার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে কনফিউজ করবে সেটাই কাম‍্য, কিন্তু এই নাটকের দর্শক শেষমেশ নাটকটিকে নিয়েই কনফিউশনে ভোগেন! আদৌ কি কোনো পরিষ্কার ধ‍্যানধারণা থেকে নাটকটি তৈরি, নাকি কিছু অস্পষ্ট জিনিসকে আরো অস্পষ্ট করে দিয়ে একধরনের ইন্টেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ‌ই লক্ষ‍্য? আগেই বলেছি মূল ছবিটি বেশ বোরিং। সিনেমায় নাটকীয়তাহীন দৃশ‍্য-পরিবর্তনের প্রয়োগ অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু সিনেমার অনুকরণে মঞ্চের উপরে ঐ এক‌ই ধরণের দৃশ্য-পরিবর্তন নাটকটিকে একধাপ বেশি বোরিং করে তুলেছে। মূল চরিত্র দুটিতে সৌম‍্য সেনগুপ্ত ও শৈবাল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় তাদের সীমিত ক্ষমতায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, কিন্তু নাটকটিকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন‍্য তা’ যথেষ্ট ছিলনা। হিরণ মিত্রর মঞ্চ কল্পনায় বাস্তব অবাস্তবের মিশ্রণের একটা স্বাদ রয়েছে। সৌমেন চক্রবর্তী কম আলোয় কাজ করার চেষ্টা করেছেন, সেটা প্রশংসনীয়; তবে আলোর বদলে আর‌ও বেশি করে অন্ধকার তৈরির প্রচেষ্টা হয়ত করা যেতে পারত। গৌতম ঘোষের আবহ ও অনিন্দ্য নন্দীর শব্দ বৃষ্টিমুখর রাতের অনুভূতিটি খুব কার্যকরীভাবে তৈরি করে, তবে পুরো স্কিমটি‌ই মূল ছবিটির অনুকরণে করা! সত‍্যি বলতে কি, এরকম একটা অনুকরণ সর্বস্ব নাটকে, নাটকের ক্রাফট নিয়ে আলাদা করে বিশেষ কিছু বলার থাকতে পারে না।

তবে অন‍্য কয়েকটি ব‍্যাপার নিয়ে কথোপকথন চলতে পারে। একটি বিদেশি সিনেমা বা নাটক ভাষান্তরের সময় নাট‍্যকারের কাছে কী কী বিষয় গুরুত্বপূর্ণ? নাটকের পরিবেশ, ঘটনাবলী, চরিত্রদের প্রতিক্রিয়া, সব‌ই কিন্তু স্থানকাল ভেদে পরিবর্তিত হ‌ওয়ার কথা! এই সমস‍্যার সহজ সমাধান হল, স্থান, কাল, পাত্র, সমস্ত কিছুকে বিদেশি‌ই রেখে দেওয়া, শুধু সংলাপের ভাষাটা বাংলা করে দেওয়া। দর্শক বুঝে নেবেন যে পুরো ব‍্যাপারটাই বিদেশি, শুধু সকলের সুবিধার্থে ভাষাটা পরিবর্তন করা হয়েছে! কিন্তু যে মুহূর্তে আপনি টেক্সটের ভারতীয়করণ করবেন, তখন কিন্তু আর শুধুমাত্র সংলাপ বা চরিত্রের নাম পরিবর্তন করলে চলবে না। পরিবেশ, চরিত্র, ঘটনাবলী, সবকিছুর‌ই ভারতীয়করণ করতে হবে, ন‌ইলে প্রতি পদে পদে বিশ্বাসযোগ‍্যতার অভাব তৈরি হবে। ‘জেরা’ নাটকটিতে এই হুবহু বঙ্গীকরণের নেতিবাচক ফলাফলটি প্রতি মুহূর্তে দেখা যায়। উদাহরণ স্বরূপ কল্পনা করুন বাংলাদেশের একটা থানা, সেখানে এক ব‍্যক্তিকে হাতকড়া পরিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে, তারপরে তাকে একগ্লাস গরম দুধ খেতে দেওয়া হচ্ছে!! স্পষ্টতই, এইসব প্র্যাক্টিকাল গরমিল নিয়ে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করা হয়েছে বলে মনে হয়না! ফলে নাটকের পরতে পরতে বোঝা যায় যে এটি একটি বিদেশি টেক্সট, জোর করে বাংলা বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে! এই ধরনের বিজাতীয় ছাপ মুছে ফেলে একটা সত‍্যিকারের বাংলা নাটক লিখতে গেলে আরও বেশি সময় বিনিয়োগ, বা আর‌ও বেশি পরিশ্রমের প্রয়োজন! নাট‍্যকারেরা, প্রকারান্তরে নাট‍্যনির্মাতারাও, সম্ভবত এই পরিশ্রমে আগ্রহী নন। এটা কি আধুনিক নাট‍্যকার ও নির্মাতাদের শৈল্পিক অক্ষমতা, নাকি পরিশ্রম বিমুখতা (এত খাটব কেন, সরকারি গ্রান্ট তো পেয়েই যাচ্ছি), নাকি দর্শক সম্পর্কে একধরণের ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ মনোভাব (যা দেখাব তাই দেখবে), সেটা তর্ক সাপেক্ষ। তবে দর্শকরা যতক্ষণ পর্যন্ত সচেতন না হচ্ছেন, নির্মাতাদের তরফ থেকে নিজেদের সৃষ্টির প্রতি আর‌ও বেশি মনোযোগ দাবি না করছেন, ততক্ষণ এই সমস‍্যা সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই মনেহয়।

Anahuta – A competent theatre production with overused storyline and formআর‌ও একটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। নাটকের বিজ্ঞাপনে লেখা আছে নাটকটি ‘জিসেপ তোর্ণাতোরে অবলম্বনে’! বাংলা নাটকের এ‌ও আরেক ট্রেন্ড – ‘চেকভ অনুপ্রাণিত’, ‘হেডলি চেজ অবলম্বনে’, ইত‍্যাদি। ঠিক কোন ধারণার বশবর্তী হয়ে নির্মাতারা একটা প্রপার অ্যাকনলেজমেন্ট এড়িয়ে যান, সেটা বোঝা দুষ্কর [১]। মূল টেক্সটির নাম বলতে সমস‍্যা কোথায়? কপিরাইট? বাংলা নাট‍্যজগতে কপিরাইটের তোয়াক্কা কবে করা হয়েছে? নাকি নির্মাতারা ভাবেন যে আসল নামটি জানিয়ে দিলে দর্শকরা সেটা দেখে বা পড়ে নিয়ে আসবেন? তাতে সমস‍্যা কোথায়? এমনিতেই বর্তমানে সস্তার ইন্টারনেটের যথেচ্ছ প্রসারের ফলে মূল টেক্সটটি খুঁজে বার করাটা এমন কিছু শ্রমসাধ্য ব‍্যাপার নয়! বরং এই ইন্টারনেটের দৌলতেই এখন বিদেশি সিনেমাগুলোও সাধারণের হাতের মুঠোয় এসে গেছে, যার সুবিধা পাচ্ছেন বাংলার ‘নাট‍্যকার’রা। একাধিক বিদেশি, অ-ইংরেজি, ভাষায় তৈরি ছবির নাট‍্যরূপ এই মুহূর্তে কলকাতার মঞ্চে দেখা যাচ্ছে। বাংলায় মৌলিক নাটকের, বা আর‌ও বেশি করে বলতে গেলে মৌলিক নাট‍্যকারের, অভাব পূরণের আশাটা যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে!

[১] কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ডক্টর সৈকত চক্রবর্তী (বিজ্ঞান গবেষক ও বাংলা নাটকের দর্শক) 

Anjan Nandi
A science student, postdoctoral researcher, writer-translator of science oriented popular literature and a dedicated audience of theatre for last two decades, he has observed many changes in Bengali theatre from a very close proximity. He is a regular contributor in Bengali Wikipedia and engages himself deeply in photography and cinema.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us