তারায় তারায় – প্রগাঢ় যোগাযোগের নাট্য

Posted by Kaahon Desk On August 13, 2018

স্বপ্নসন্ধানীর নতুন প্রযোজনা তারায় তারায় ’এর নাট্যরুপ দিয়েছেন কৌশিক সেন (যিনি নির্দেশকও নাট্যের), শ্রীজাত’র উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে। নাটকের আখ্যানে আমরা পাই ঋত্বিক’কে (অভিনয়ে, ঋদ্ধি সেন) –ঝকঝকে এক যুবক, যে দাঁড়িয়ে আছে জীবনে সাফল্য ছোঁয়ার দোরগোড়ায় তার কর্পোরেটে চাকরী, তার সুন্দরী স্ত্রী (অভিনয়ে, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়) নিয়ে। কিন্তু শুরুতেই যখন দেখা যায় এ হেন ঋত্বিক পৌঁছে গেছে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ রুকসারের (অভিনয়ে, রেশমী সেন) চেম্বারে তার একরাশ মানসিক সমস্যা নিয়ে, যার কেন্দ্রে থাকে হ্যালুসিনেশন, তখন বোঝা যায় ঋত্বিকের আপাত সুখী জীবন আসলে ভেতর থেকেই সমস্যাকীর্ণ। গল্প একটু এগোলেই প্রবেশ হয় শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গখের (অভিনয়ে, অঞ্জন দত্ত), যার নিদারুণ দৈন্য, প্রায় সকলের নিষ্ঠুর অবজ্ঞা ও নিজের চূড়ান্ত মনস্তত্ত্বিক অস্থিরতার মধ্যেও একের পর এক অবিস্মরণীয়, কালজয়ী ছবি এঁকে যাওয়ার অত্যাশ্চর্য ইতিহাস ঝালিয়ে নেওয়া হয়। তারপর একসময় পরিস্কার হয় যে বর্তমানের ঋত্বিকের ও অতীতের ভ্যান গখের সমান্তরাল আখ্যানদুটি আসলে সমান্তরাল নয়, বরং তা জড়িয়ে আছে একে অপরের সাথে। জড়িয়ে থাকার জায়গাগুলো পরিস্ফুট হয় – ঋত্বিক ও ভ্যান গখ্‌ দুজনেই বিপর্যস্ত হিসেব, হিংস্রতা, অসূয়া ভরপুর মাংসল জীবনের হাতে, তারা দুজনেই সন্ধানেচ্ছু সমাজ সংসারের চেনা বাস্তবতার ছাদের ওপারে এক আকাশ বিকল্প বাস্তবের, তাদের দুজনেরই তীব্র কামনায় থাকে জীবনের সরল অথচ শ্বাশত যে সুন্দর তাকে স্পর্শ করা। পাগলামি ও প্রকৃতিস্থতা, বাস্তব ও কল্পনা, বর্তমান ও অতীত – এসবের সীমারেখাগুলো আবছা করতে করতে ঋত্বিক ও ভ্যান গখের আলাদা অথচ এক আখ্যান এগোনোর পাশাপাশি সাবপ্লটে আরেকটি গল্পের জন্ম হয়, যে গল্পে আমরা পাই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ রুকসারের বাস্তব থেকে কল্পনায় চলে যাওয়া, তার রুগী ঋত্বিকের রোগে নিজে আক্রান্ত হয়ে একভাবে মুক্তি পাওয়া।

Previous Kaahon Theatre Review:

নাটক থেকে নাট্যের দিকে তাকালে যা পাওয়া যায়, ছোট করে বললে, তা এটাই যে তারায় তারায় আলো, সেট, মঞ্চসামগ্রী, আবহ এবং অবশ্যই মনোগ্রাহী অভিনয় সম্বলিত একটি জমজমাট নাট্য। নির্দেশক খুব সচেতনভাবেই তার হাতে থাকা প্রসেনিয়াম নাট্যের সম্ভাব্য সমস্ত উপাদান ও উপকরণ অকৃপণভাবে ব্যবহার করে দর্শকের কাছে হাজির করতে চেয়েছেন একটি ভরাট,audio-visually rich নাট্য অভিজ্ঞতা। খুব সহজেই মনে হতে পারত নির্দেশক মন মাতানোর জন্য আশ্রয় নিয়েছেন বিবিধ gimmick’এর; তা যে হয়নি, তার কারণ নাটকের বিষয়ের কেন্দ্রে যখন থেকেছে একদিকে এক শিল্পীর যন্ত্রণাময়, ঘটনাবহুল সুতীব্র বেঁচে থেকে রঙে, গল্পে পরিপূর্ণ অসংখ্য ছবি সৃষ্টি করা ও অন্যদিকে শিল্পী না হতে পারার দুঃখে জর্জরিত একটি সংবেদনশীল মানুষের মনের নানা স্তরের উন্মোচন, তখন এতকিছুকে নাট্যের ভাষায় প্রকাশ করার জন্য সঙ্গতভাবেই প্রয়োজন হয়েছে নাট্যের বহু উপাদান নিংড়ে অর্থ তৈরী করা। যে সব নাট্যে এক বা একাধিক অভিনেতা একটির বেশি চরিত্রে অভিনয় করেন, সেখানে অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় তার কোনো কারণ টেক্সট দিচ্ছে না। তবে, তারায় তারায় নাট্যে ঋদ্ধি সেন যখন ঋত্বিক চরিত্র’র পাশে ভ্যান গখের ভাই থিও’র চরিত্রেও অবতীর্ণ হন, বা কৌশিক সেন যখন ঋত্বিকের ও ভ্যান গখের বাবার চরিত্রে আসেন, অবশ্যই সূত্রধরের চরিত্রে অভিনয়ের সাথে সাথেই, তখন তাতে থাকে টেক্সট্যুয়াল অনুমোদন, কারণ ঋত্বিক ও ভ্যান গখের আখ্যানের ধারাদুটির সম্পৃক্ততা (যার কথা আগেই বলা হয়েছে) একের বহু অভিনয়ের যে নাট্য-পন্থা, তার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়।

মঞ্চে ব্যবহৃত হয়েছে বেশ কিছু চাকা লাগানো ত্রিভুজাকৃতি ধাতব ফ্রেম, যার একটা বাহু ছিটকে বেরিয়ে অন্য বাহুগুলোর তুলনায় লম্বা হয়ে কখনো যুদ্ধাস্ত্রের আভাস দেয়, কখনো যেন আকাশের তারা ছুঁতে চেষ্টা করে। এগুলো কখনো হয় ঈসেল, কখনো বা হ্যালুসিনেশনে দেখা মারণ কামান, কখনো বা কলকাতার রাস্তায় ঘড়ঘড় শব্দ তোলা ট্রাম। এটা ভাবতে মন্দ লাগে না যে নির্জীব এই মঞ্চসামগ্রীগুলো, জীবন্ত অভিনেতাদের মতই খানিকটা, আখ্যানের বিভিন্ন প্রবাহে বারংবার নানা অবতারে ঢুকে বেরিয়ে নাট্যটিকে দিচ্ছে গঠনগত একত্ব। সঞ্চয়ন ঘোষের মঞ্চ এবং সুদীপ সান্যালের আলো অত্যন্ত পরিণত, পরিশীলিত। কিছুদিন আগেই কলকাতায় দেখা সত্যব্রত রাউতের নির্দেশনায় হায়দ্রাবাদের রঙ্গকল্পের প্রযোজনাতুমহারা ভিন্সেন্ট যেভাবে নানা রঙের আলো ও প্রপস্‌ ব্যবহার করে একধরণের বর্ণাঢ্য ঔজ্জ্বল্যে সৃষ্টি করেছিল ভ্যান গখের জীবন দেখানোর জন্য (যা ওই নাট্যের ক্ষেত্রে ছিল সাযুজ্যপূর্ণ), তার থেকে একেবারেই অন্য ধরণের আলো ও মঞ্চ বিন্যাসের জন্য (যা তারায় তারায়’এর মূলত সংবিগ্ন, দুঃখময় মেজাজের পক্ষে সঙ্গত) সঞ্চয়ন এবং সুদীপ, এই দুই শিল্পীর নাট্যবোধের প্রশংসা আবশ্যিক। নীল দত্তের গীটার নির্ভর আবহ এই নাট্যের অন্যতম সম্পদ। তবে, নাট্যের শেষে ডন ম্যাকলীনের বিশ্ববন্দিত গান Starry Starry Night নীল যখন গাইলেন, তখন তা অতি-প্রত্যাশিতের ফাঁদে আটকে পড়ল, নাট্যের রেশটা যেন কেটে গেল এবং যেহেতু ভিনসেন্ট থাকলেও নাটকটি আসলে তার জীবনকাহিনী নয়, সেহেতু গানটি বেশ অপ্রয়োজনীয় ঠেকল।

Taray Taray: Theatre of deep emotional connect

ভিনসেন্ট ভ্যান গখের ভূমিকায় অঞ্জন দত্ত প্রমাণ রাখলেন তার অবিসংবাদিত অভিনয় ক্ষমতার। গোটা নাট্যে যেভাবে তার চোখ তার চরিত্রের বিভিন্ন মানসিক অবস্থা ও অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হয়ে থাকল, তা শিক্ষণীয়। কন্ঠের ওপর, অঙ্গসঞ্চালনার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকে অটুট নাট্য জুড়েই। চরিত্রের আবেগমথিত উচ্চারণ তিনি এমনভাবে প্রক্ষেপণ করেন, কন্ঠ খাদে নামিয়ে, যাতে তা কখনোই উচ্চকিত ঠেকে না, মনে হয় না তিনি দর্শকের সেন্টিমেন্টের কাছে রাখছেন তার চরিত্রের আবেদন। বর্তমান সমালোচকের নাট্যটি দু’বার দেখার অভিজ্ঞতা বলছে ঋদ্ধি সেন প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বার ঋত্বিকের চরিত্রটিকে কিছুটা কম ‘অভিনয়’ করে মূর্ত করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সঠিক। তাও, মাঝে মাঝে ঋত্বিকের অস্থিরতার জায়গাগুলো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি প্রকট হয়েছে; এর কারণ অবশ্য এটা হতে পারে যে ঋত্বিককে যে দুজন চরিত্রের পাশে পাওয়া যায় (ডঃ রুকসার ও শর্মিলা) তারা দজনেই বেশ কিছুটা চাপা। তাছাড়া, ঋদ্ধি হয়ত বেশি মাত্রায় সচেতন এটা নিয়ে নিয়ে যে তাকে ঋত্বিকে’কে আলাদা করতে হবে থিও’র থেকে। তবে নাট্যের শেষের দিকে যে দৃশ্যে একসাথে পাওয়া যায় ভ্যান গখ ও ঋত্বিকে’কে, সে দৃশ্যে অঞ্জনের সাথে ঋদ্ধি’র যুগলবন্দী অত্যন্ত মনোগ্রাহী (এই দৃশ্যে দুই চরিত্রের পোশাক একরকম হয়ে যাওয়াটাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ)। কৌশিক সেন তার একাধিক ভূমিকায় যে সাবলীলতা, যে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আসেন তা আসলে বহু বছেরর অধ্যাবসায়, সহজাত অভিনয় প্রতিভা আর অভিনয়ে অভিনয় না দেখানোর কুশলতার মিশ্রনে তৈরী হয়। রেশমী সেন যদিও তার চরিত্র মোটের ওপর দক্ষতার সাথে মূর্ত করেছেন, ডাক্তার থেকে রুগী হয়ে যাওয়ার যাত্রাটা যতটা তার সংলাপে এলো, ততটা তার শরীরের ভাষায় এলো না। নাট্যের প্রয়োজন মিটিয়েছেন সুরঙ্গনা, যদিও তার একাধিক অনুভূতি ও ভাবনা প্রকাশের সুযোগ কমই ছিল। যারা কোরাসে কাজ করেছেন,তারা অনেকেই অপরিণত ও অপ্রস্তুত; যে দৃশ্যে তাদের হতে হয় ডাক্তার থেকে শিল্পরসিক/শিল্পব্যবসায়ী, তাদের শিথিল হাঁটাচলা, অধিক অঙ্গভঙ্গি পীড়া দেয়।

যে থিয়েটার নানা উপকরণের সাহায্যে illusion ও spectacle তৈরী করার চেষ্টা করে সেই থিয়েটার আজ নানাভাবে ও নানাকারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবু বলতেই হচ্ছে, সঠিকভাবে করা হলে, সেই থিয়েটার এখনো সক্ষম অর্থবহভাবে দর্শকদের সাথে প্রগাঢ় আনুভূতিক যোগাযোগ স্থাপন করতে। এই কথাটাই মাথায় আসে নাট্যের সেই তুঙ্গ মুহূর্তে, যখন ঋত্বিক বাস্তবের দুনিয়া ছেড়ে মিলিয়ে যায় তারা ভরা রাতের আকাশে। শব্দ, আলো, কায়া, ছায়া, মঞ্চসামগ্রী দ্বারা নির্মিত এই দৃশ্যকাব্যের পেছনে থাকা directorial design’কে আন্তরিক বাহবা না দেওয়ার উপায় থাকে না।

Dipankar Sen
A student of theatre as an art practice, he is definitely a slow (but hopefully, steady) learner. He is a father, a husband and a teacher of English literature in the West Bengal Education Service. His other interests include literature in translation and detective fiction.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us