২৩.০৭.২০১৭, রবিবার সঙ্ঘারাম হাতিবাগান প্রযোজিত দু’টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটক অভিনীত হতে দেখলাম তৃপ্তি মিত্র সভাঘরে, উদরনীতি এবং হস্তগত । যারা জানেন, তারা অভিনয়ের অকুস্থলের এটুকু তথ্য থেকেই আন্দাজ করে নেবেন অন্তত দু’টি কথা – নাটক দু’টি প্রসেনিয়াম মঞ্চে করা কাজ নয় এবং সাকুল্যে তিরিশ/চল্লিশজন দর্শকই হবেন সভাঘর ভরিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। দু’টি নাটকেরই রচনাকার পোলিশ লেখক স্লাভোমির ম্রোজেক, এবং তার বুদ্ধিদীপ্ত, প্রাসঙ্গিক বাংলা অনুবাদ করেছেন প্রতীক দত্ত। প্রতীকের অনুবাদের মস্ত বড় গুণ যে তা কেবল ভাষান্তরেই আটকে না থেকে, সাংস্কৃতিক সমানতা (ইক্যুইভ্যালেন্স) হাজির করতে পারার ক্ষেত্রেও সফল। অন্যভাবে বললে, ইংরেজি ‘ট্র্যান্সলেট’ শব্দের আদি লাতিন অর্থ – ‘কোন কিছুকে বয়ে নিয়ে আসা, to carry across’। পোলিশ নাটক দু’টিকে সক্ষমভাবে বাংলায় বয়ে নিয়ে এসেছেন প্রতীক। কিন্তু একটা কথা – প্রতীক মূল পোলিশ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেননি, করেছেন ইংরেজি থেকে। কিন্তু কোন্ অনুবাদকের টেক্সট থেকে অনুবাদ করা হ’ল? যে কোন অনুবাদ’ই একটা পাঠ; সে অর্থে প্রতীক করেছেন পাঠের পাঠ। কিন্তু উল্লেখ থাকল না ইংরেজি অনুবাদের কথাটি। আমার বিশ্বাস পরবর্তী সময়ে এই ব্যতিরেক সঙ্ঘারাম শুধরে নেবে।
Kaahon Theatre Review
BUKJHIM EK BHALOBASHA – A NOVEL ENACTED
Read more : https://t.co/vsNnhOEQVK#bengalitheatre |#kaahontheatrereview pic.twitter.com/uDc4PXvKV2— kaahon (@kaahonwall) July 15, 2017
স্লাভোমির ম্রোজেকের নানা মিডিয়ামে করা বিবিধ কাজের আলোচনা এই লেখার পরিসরে তো সম্ভবই নয়, তার হদিশটুকু দেওয়াও অসাধ্য। যে দু’টি একাঙ্ক নাটক এখানে আলোচ্য, কেবল তার নিরিখেই বলা যায় ম্রোজেকের বিশেষ দক্ষতা ও পছন্দ ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্মাণের কৌশল, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অসম সম্পর্ক, আধুনিক সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির স্বাধীনতার অস্তিত্ব বা সীমা – এইসব বিষয়গুলির তির্যক বিশ্লেষণ করা, এক ধরণের ডার্ক হিউমার ব্যবহার করে, যা মনে করিয়ে দেয় পূর্ব ইউরোপিয় বেশ কিছু প্রখ্যাত লেখকদের – ভাক্লভ হাভেল, মিলান কুন্দেরা। উদরনীতি এবং হস্তগত, দু’টি নাটকই আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক রূপক, শৈলীগতভাবে কিছুটা এক্সপ্রেশনিস্ট, কিছুটা অ্যাবসার্ডধর্মী। প্রথম নাটকটিতে আমরা পাই তিনজন অতি সুসভ্য মানুষকে, যারা নিজেদের শৈল্পিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে জীর্ণ করে, নিঃশেষিত করে। তারা একভাবে ফিরে যায় ক্যানিবালিজমের আদিম প্রবৃত্তিতে, কিন্তু সভ্যতার ফিনফিনে আস্তরণটিকে অক্ষুণ্ণ রেখে। মোটা, মাঝারি ও রোগা – তিনজন কোন এক সমুদ্রে ভেলায় ভাসমান, কোন এক বিপর্যয়ের পরে। তীব্র খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলা করতে তারা আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে আসে – ঠিক হয় মোটা ও মাঝারি একজোট হয়ে রোগাকে খাবে, রোগার সম্মতিসাপেক্ষে। মাঝারি যেহেতু মোটাত্বে পৌঁছাতে সদাই প্রচেষ্ট এবং মোটা যেহেতু সবসময় রোগার চেয়ে মাঝারিকে নিজের কাছাকাছি ভাবে, তাই মোটা ও মাঝারির জোট তৈরী হয় সহজে। সময় একটু যা লাগে তা হল রোগাকে খাদ্য হতে রাজি করাতে। উদরনীতি তীব্র, দয়াহীন আলো ফেলে মরে হেজে যাওয়া মৃত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর, শ্রেনীবিভক্ত সমাজের নিহিত অন্যায়ের ওপর এবং সর্বোপরি আধুনিক উদার গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর, যা শুধু এই অন্যায় ঘোচানোয় ব্যর্থই নয়, যা আসলে সম্ভব করে ক্ষমতাবানদের উদরপূর্তিতে ক্ষমতাহীনদের বলিপ্রদত্ত হতে। অপরদিকে হস্তগত নাটকটি, যার বিষয় ব্যক্তির স্বাধীনতা, হাজির করে দু’টি চরিত্র যারা নিজেদের মত করে ভাবে তারা স্বাধীন। একজনের স্থির সিদ্ধান্ত সে স্বাধীন, কারণ সে ঠিক করে নিয়েছে যে সে কোন অবস্থাতেই কিছুই করবে না, কোন অবস্থানই নেবে না, আর অন্যজন ভাবে সে স্বাধীন কারণ সে রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় ও তার নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী আছে। তারা একটি ঘরে আটকে পড়ে এবং রাষ্ট্র সেখানে থেকে থেকে হানা দেয় একটি বৃহদাকার হাত হয়ে। এক এক করে হাত তাদের পোষাক খুলে নেয়, তাদেরকে করে দেয় সর্বার্থে নগ্ন – ভাবনায়, আদর্শে, বিশ্বাসে এবং স্বাধীনতায়। নাটকের শেষে দুজনকেই টেনে নিয়ে যায় অন্য একটি বৃহৎ হাত, যার গাঢ় লাল রঙ স্পষ্টই বলে দেয় স্থিতাবস্থাকামী ও পরিবর্তনকামী দুজনেরই জন্য অপেক্ষা করছে একই বীভৎস মৃত্যু। নাট্যের বিষয়বস্তু নিয়ে এত বিস্তারে বলার কারণ একটাই। আজকের দিনে পশ্চিম বাংলায় তথা ভারতে, বা বড় করে ভাবলে আজকের পৃথিবীতে বাস করে নাটকদু’টির বিষয়ের সাথে নিজেদের সামাজিক, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আন্তরিক অনুরণন না হওয়াটা হয় মুশকিল, নয় বিপজ্জনক। সঙ্ঘারাম হাতিবাগানকে অভিনন্দন থিয়েটারে রাজনীতি চর্চা করার জন্য, কোনরকম ইতস্ততা, আড়াল, ধরি মাছ না ছুঁই পানির আশ্রয় না নিয়ে।
তৃপ্তি মিত্র সভাঘরের সীমিত স্থান হস্তগত নাটকটির (পরিচালনা মধুরিমা গোস্বামী) জন্য যতটা উপযুক্ত, উদরনীতি নাটকটির (পরিচালনা অনির্বাণ ভট্টাচার্য) জন্য ততটা নয়। উদরনীতি প্রসেনিয়ামে হতেই পারত এবং এই নাট্যের মঞ্চ, আলো, আবহ বিন্যাস তথা অভিনয়শৈলী এমনই যে বড় থিয়েটার গৃহে এই নাট্য অক্লেশে মঞ্চস্থ করা সম্ভব। এই নাটকটিতে চরিত্রগুলোর চূড়ান্ত সঙ্কটময় বিচ্ছিন্নতা ব্যক্ত করতে মাঝসমুদ্রে ভাসমান ভেলা বোঝানোর জন্য চাইছিল একটা ছোট তক্তা বা ওইধরণের কোন একটা প্রপ। অসার অর্থহীন বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহ্যের সূচক সত্যজিৎ, রবীন্দ্রনাথ ও চে গুয়েভারার মলিন ছেঁড়াফাটা ছবি নাট্যের বেশির ভাগ সময়ে ব্যাকড্রপ হয়ে থাকে, পারফরম্যান্সের অন্তর্গত হয় না। কিন্তু, হস্তগত এমন ভাবে গঠিত, যে বড় জায়গায় নাট্যটি করা দুঃসাধ্য। নাট্যের শুরুতেই চরিত্রদ্বয় একটা ঘরে আটকে পড়ে, যেখান থেকে তাদের বেরোনো অসম্ভব। কালো দেওয়াল সম্বলিত সভাঘরটাই হয়ে যায় একটা কয়েদখানা, একধরণের কালো বাক্স। শুধু তাই নয়, এই ঘরের খুব ইন্টিমেট স্পেসের মধ্যে থাকা দর্শকও যেন নিজেদের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ে নাট্যের চরিত্রদের সাথে – একই বদ্ধ পরিবেশে আটকে থেকে তারাও যেন চরিত্রদের মতই শঙ্কিত হয়ে পড়ে স্বাধীনতা থাকা না থাকা নিয়ে। সাধারণত নিজেদের স্বস্তি বলয়ের মধ্যে থেকে নাটক উপভোগ করতে অভ্যস্ত দর্শকের মধ্যে এই অস্বস্তিকর শঙ্কাটা উস্কে দেওয়ার এই রাজনৈতিক অবশ্য কর্তব্য সম্পাদনের জন্য সঙ্ঘারাম হাতিবাগানকে আবার অভিনন্দন।
যারা অভিনয় করেছেন নাটকদু’টিতে তারা প্রত্যেকেই যে দীর্ঘ অনুশীলনে শাণিত, সুপ্রশিক্ষিত অভিনেতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না; বস্তুত, বর্তমানে কলকাতায় নাট্যচর্চা করা দল সমূহের মধ্যে সঙ্ঘারাম হাতিবাগান নিজেদের এমন একটা উজ্জ্বল পরিচয় নির্মাণ করেছে যে তাদের কাছ থেকে পরিশীলিত অভিনয় আশা নয়, দাবী করাটাই দস্তুর। সে দাবী উদরনীতি নাট্যে কৃপাবিন্দু চৌধুরী (মোটা), অরিত্র প্রতিম বিশ্বাস (মাঝারি), সুরজ বিশ্বাস (রোগা), সৌরভ পাল (পোস্টম্যান, ভৃত্য) এবং হস্তগতনাট্যে তথাগত চৌধুরী (বিপ্লবী), প্রসেনজিত বর্ধন (স্থিতাবস্থাকামী) সাফল্যের সাথে মিটিয়েছেন। কৃপাবিন্দু তার ধীর লয়ে, মাতব্বরি চালে নড়াচড়া, কথা বলা দিয়ে তার প্রমুখতা; অরিত্র তার আক্রমণাত্মক ছটফটানির মধ্যে দিয়ে তার সুরক্ষিত অবস্থানের খোঁজ এবং সুরজ তার প্রথমে চিৎকৃত পরে স্তিমিত হয়ে আসা শরীরী ভাষা দিয়ে তার ভবিতব্যকে মেনে নেওয়া প্রশংসনীয়ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সৌরভ তার স্বল্প সময়ের উপস্থিতিতে তার দুটো চরিত্র কথায় ও হাবেভাবে আলাদা করেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখ করব প্রসেনজিত বর্ধনের অভিনয়ের কথা। দর্শকদের সাথে স্থানিক নৈকট্যের সুযোগ নিয়ে তিনি তার গোটা অভিনয় জুড়ে করে গেছেন চোখ, মুখমন্ডল, আঙুল, পায়ের ছোট ছোট ব্যবহার, যা বড় নাট্যমঞ্চে হয়তো উপযুক্ত নয় কিন্তু এই ছোট পরিসরে অনিবার্য। অত্যুক্তি হবে না এটা বললে যে, অভিনেতা তার অভিনয়ের স্পেস কিভাবে ব্যবহার করবেন তার মাস্টার ক্লাস নিয়েছেন প্রসেনজিত। বিপ্লবে আস্থা রাখা চরিত্রে তথাগত তার বাচনে ও শরীরে যে ব্যঙ্গের অনুষঙ্গ যোগ করেছেন, নাটকের টেক্সট কি তা অনুমোদন করে?
এক একবারে অল্প কিছু দর্শকদের জন্য করা নাটক, নাছোড়ভাবে তমসাচ্ছন্ন নাটক যেখানে কোন আরোপিত আশার আলো নেই, সেরকম দুটি নাটক হাজির করে সঙ্ঘারাম হাতিবাগান বর্তমানের বাংলা নাট্যচর্চার (আসলে সামগ্রিকভাবে শিল্পচর্চার) আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতির বাইরে এসে দাঁড়ায়। এই লেখা প্রস্তুত হওয়ার সময় অব্দি এটা অজানা নাটক দুটি আবার কবে, কোথায় অভিনীত হবে। যেখানেই হোক, যবেই হোক দর্শক হিসেবে এই নাটক দু’টির সাথে ও পাশে এসে দাঁড়ানো বোধহয় জরুরী হয়ে পড়েছে।
দীপঙ্কর সেন