বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের মধ্যে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় একজন। তাঁর লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯সালে এবং এই উপন্যাসের জন্যে তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার পান। এই কাহিনীর ঐতিহাসিক তথ্য মূলত: ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Robert Sewell এর লেখা ১৯০০ সালে প্রকাশিত A Forgotten Empire গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। উপন্যাসের পটভূমিগত কারণে ঐতিহাসিক চরিত্রেরা স্থান পেয়েছে বটে, তবে এর কাহিনী অংশটি শরদিন্দুর মৌলিক ভাবনা, তিনি নিজে উপন্যাসটিকে Historical Fiction হিসাবে আখ্যা দিয়েছিলেন।
Previous Kaahon Theatre Review:
কৃষ্টি নাট্যদল ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসটিকে মঞ্চে এনেছে তাদের নবতম প্রযোজনা হিসাবে। নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় সিতাংশু খাটুয়া। নাটকটির অষ্টম অভিনয় মঞ্চস্থ হল মিনার্ভা থিয়েটারে গত 8ঠা সেপ্টেম্বর।এই কাহিনীর সময় কাল চর্তুদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, পটভূমি তুঙ্গভদ্রা নদীতীরে অবস্থিত তৎকালীন প্রভাবশালী হিন্দুরাজ্য বিজয়নগর। কাহিনীর শুরু কলিঙ্গ রাজকন্যা বিদ্যুতমালা (উপন্যাসের বিদ্যুন্মালা) তুঙ্গভদ্রায় নৌকা সহযোগে বিজয়নগরের উদ্দেশ্য যাত্রা করেছেন সেখানকার রাজা দেব রায়ের সাথে বিবাহের জন্য, সঙ্গে আছে তার বৈমাত্রেয় বোন মণিকঙ্কনা, মাতুল চিপিটক, দাসী মন্দোদরী, রাজবৈদ্যর সরাজ এবং তিন শত নৌসেনা। কলিঙ্গরাজ ভানুদেব বিজয় নগরের রাজা দেবরায়ের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হন এবং সন্ধির শর্তানুসারে রাজা দেবরায়ের সঙ্গে রাজকন্যা বিদ্যুতমালার বিবাহ স্থির হয়। বিবাহের উদ্দেশ্যই এই যাত্রা, কিন্তু বিদ্যুতমালার এই বিবাহে একদম ইচ্ছা নেই, তার কথায় ‘এতো বিবাহ নয়, এতো রাজনৈতিক দাবা খেলার চাল!’ যাত্রাপথে জলে ডুবতে থাকা অর্জুন বর্মাকে দেখতে পায় বিদ্যুতমালা, তার তৎপরতায় সৈন্যদলে থাকা বলরাম অর্জুনকে রক্ষা করে। অর্জুন বর্মা বিদেশী শাসকের অত্যাচার থেকে প্রাণ বাঁচাতে তুঙ্গভদ্রায় ঝাঁপ দেয় এবং ভাগ্যান্বেষাণে বিজয় নগরে পৌঁছতে চায়।রাজবৈদ্যর সরাজের ঔষধে অসুস্থ অর্জুন ক্রমে সুস্থ হয়ে ওঠে এবং নৌসেনা দলে স্থান পায়। যাত্রার প্রায় শেষের পর্বে, বিজয়নগর থেকে অল্পদূরে, প্রচন্ড ঝড়ে নৌকা উল্টে যায়। রাতের অন্ধকারে ডুবন্ত বিদ্যুত মালাকে উদ্ধার করে অর্জুন বর্মা এক দ্বীপে গিয়ে পৌঁছায়। তারা একে অপরকে নিজেদের অতীতের কথা বলে, রাজকন্যা অর্জুন বর্মার প্রতি আকৃষ্ট হন। পর দিন তারা সবাই কুশলে বিজয়নগর পৌঁছায়।বিদ্যুতমালা যেহেতু পরপুরুষের স্পর্শ লাভ করেছে, তাই রাজগুরু বিধান দেন আপাতত বিবাহ তিনমাস স্থগিত থাকবে এবং প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ রাজকন্যাকে প্রতিদিন তুঙ্গভদ্রায় স্নান করে পম্পাদেবীর মন্দিরে পুজো দিতে হবে। ইতিমধ্যে অর্জুন বর্মা তার গুপ্তবিদ্যা প্রদর্শন দ্বারা রাজার অনুগ্রহ লাভ করে এবং এরপর রাজাকে তার ভ্রাতা কম্পনদেবের হাত থেকে প্রাণে রক্ষা করে। রাজা তাকে সেনাপতি পদে নিযুক্ত করে।এদিকে বিদ্যুতমালা অর্জুন বর্মার সাথে বারবার সাক্ষাৎ করে নিজের মনের কথা বলে, এইভাবে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু এই সম্পর্ক রাজা কিছুতেই মেনে নেবেন না। তাই একদিন যখন রাজ্য ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করে রাজদাসী পিঙ্গলার হাতে ধরা পড়ে যায়, রাজা তাকে সেনাপতি পদ থেকে বরখাস্ত করে কিন্তু প্রাণে মারে না কারণ সে একবার রাজার প্রাণরক্ষা করে ছিল। বিদ্যুতমালার সাথে অর্জুন বর্মার বিবাহ দিয়ে, এই শর্তে তাদের গুহায় নির্বাসন দেয় যে বিদ্যুতমালার কথা যেন কেউ কোনদিন জানতে না পারে। এদিকে রাজা রাজ্যে রটিয়ে দেয় বিদ্যুতমালা তুঙ্গভদ্রায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কিছুদিন পর বিদ্যুতমালা গর্ভবতী হয়, এমন সময় বহমনী রাজ্য বিজয়নগর রাজ্য আক্রমণ করে, মন্ত্রীর পরামর্শে রাজা অর্জুন বর্মাকে যুদ্ধে যেতে অনুরোধ করে। বিজয়নগরকে রক্ষা করতে সে যুদ্ধে যায় এবং যুদ্ধজয় করে ফিরে এসে দেখে বিদ্যুতমালা পাগলের মতো আচরণ করছে, জানতে পারে রাজা তাদের সদ্যোজাত সন্তানকে হত্যা করেছে।ক্ষিপ্ত অর্জুন বর্মা রাজা দেবরায়ের কাছে ছুটে যায় এবং তার মুখোমুখি দাঁড়ায়…
উপন্যাসের লিখিত রূপকে মঞ্চে অভিনয় উপযোগী করে নাট্যরূপ দিতে যে দক্ষতার প্রয়োজন হয় এখানে নাট্যকার সিতাংশু খাটুয়া মোটামুটি ভাবে সে কাজে সফল হয়েছেন বলা যায়। তিনি নাটকের প্রথম দিকটা শরদিন্দুর উপন্যাসকে সম্পূর্ণ অনুসরণ করলেও শেষটা তিনি মূল কাহিনী থেকে সরে এসে নিজের ভাবনাকে মিশিয়ে দিয়েছেন, ফলে নাটকের আখ্যানটি মূল আখ্যান থেকে আলাদা রূপ পেয়েছে। তবে তিনি উপন্যাসের সব কটি চরিত্রকে তার নাটকে রেখেছেন। একজন নাট্যকার যখন কোন উপন্যাস বা গল্পের নাট্যরূপ দেন তখন তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে নিজের ভাবনাকে প্রয়োগ করার, তবে মূল কাহিনী কতটা পরিবর্তন হল তার মাত্রানুসারে তাকে নাট্যরূপ নাকি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে বলা হবে তা তর্কসাপেক্ষ বিষয়। এখানে তিনি উপন্যাসের মূলভাবটি অক্ষুণ্ণ রেখে শেষ অংশে এসে এক চিরন্তন সত্যকে, যা কিনা বর্তমান সময়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, আর একবার আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। কাহিনী সাতশো বছর আগের হলেও শাসকের রূপ আজও একই আছে যা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা বেশ ভালই অনুভব করতে পারি। নাট্যকার সিতাংশু খাটুয়া কাহিনী পরিবর্তনের মাধ্যমে বেশ কিছুটা নাটকীয় উপাদান যোগ করতে পেরেছেন যা মঞ্চাভিনয়ের জন্য বেশ জরুরি। তিনি নিজেই যেহেতু নাটকের নির্দেশক তাই নাট্য উপাদান, যা বিশেষ নাট্যমুহূর্ত তৈরি করতে পারে, সেইভাবনা লিখবার সময়ই তার মাথায় ছিল বলেই মনে হয়। শুধুমাত্র নাট্যকার নয় নির্দেশক হিসেবও তার কাজ প্রশংসার যোগ্য। বহু চরিত্র সম্বলিত উপন্যাসকে মাত্র দেড়ঘন্টা সময় কালের মধ্যে সুন্দর ভাবে গ্রথিত করেছেন, ছোট ছোট সংলাপ ও দৃশ্যভাবনার মধ্যে দিয়ে তিনি কম সময়ে অনেকটা বিষয় উপস্থাপন করতে পেরেছেন। উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য, যে ঐসময়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রচলন ছিল, এই তথ্যটি তিনি দু-তিনটি সংলাপও একটি ছোট দৃশ্যের মাধ্যমে সুন্দরভাবে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ছোটছোট দৃশ্য দিয়ে নাটকটি সাজিয়েছেন এবং দ্রুত দৃশ্যান্তর ঘটিয়ে নাটকের গতিকে কখনো শ্লথ হতে দেননি। উপন্যাসের নাট্যরূপ ও তাকে সফল ভাবে মঞ্চে প্রয়োগ, এইদুটি কাজই নাট্যকার ও নির্দেশক হিসেবে সিতাংশু খাটুয়া সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন বলা চলে।
অভিনয়ের কথা বলতে গেলে দু-একজন ছাড়া সকলের অভিনয়ে সামগ্রিকভাবে একটা নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড বজায় ছিল। তবে এই স্ট্যান্ডার্ডটি যে খুব উচ্চপর্যায়ের, তা বলা যায় না। সিতাংশু খাটুয়া রাজা দেবরায় চরিত্রটি সুন্দর ভাবে উতরে দিয়েছেন, তবে একথা বলব যে অভিনেতা সিতাংশুর অবস্থান নাট্যকার ও নির্দেশক সিতাংশুর থেকে একধাপ নিচে। বিদ্যুতমালার চরিত্রে গান্ধর্বী খাটুয়া ও অর্জুন বর্মার চরিত্রে সুজয় রাজমৈত্রের অভিনয় চরিত্রের প্রতি মর্যাদা প্রদান করেছে, দুজনের অভিনয়ের মধ্যে একটা রসায়ন ছিল, তা তাদের চোখের চাহনি, অভিব্যক্তি, ও শরীরী ভাষায় লক্ষ্য করা গেছে। মণিকঙ্কনার ভূমিকায় ঐন্দ্রীলা ঘোষের অভিনয় বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে। বলরাম কর্মকারের চরিত্রে অভিজ্ঞান খাটুয়াকে মানানসই লাগলেও কন্ঠস্বরটি বিশ্বাসযোগ্য তার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। মাতুল চিপিটক ও মন্দোদরীর কৌতুক অভিনয় মন্দ লাগেনা, তবে রাজপন্ডিতের অভিনয় কৌতুকের বদলে হাস্যকর লাগে।
এই নাটকের মঞ্চভাবনা গুরুত্বপূর্ণ। নীল কৌশিকের মঞ্চ ভাবনাটি চমৎকার, ছোটছোট কাট আউটের মাধ্যমে নৌকা, মন্দির, রাজসভা, ইত্যাদি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। দ্রুত দৃশ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এরকম ভাবনা অত্যন্ত কার্যকরী। পর্দা ওঠার সাথে সাথে দুটি কাটআউটও দুখন্ড কাপড়ের সাহায্যে যে ময়ূরপঙ্খী নৌকাটি দেখা যায়, তা নাটকের পরিবেশ এমন সৃষ্টি করে যে দর্শকদের মনে হয় তারাও এ যাত্রার সহযাত্রী, এখানে আলো (বাবলু সরকার) বিশেষভাবে সহযোগিতা করে। অভিজ্ঞান খাটুয়ার সঙ্গীত বেশ উল্লেখযোগ্য কাজ, প্রারম্ভিক সঙ্গীতে জলের আওয়াজের সাথে বাঁশিও সরোদের যুগলবন্দি নাটকের মূল সুরটি সহজেই ধরিয়ে দেয়। অভিজ্ঞান বয়সে নবীন তাই ভবিষ্যতে ওর কাছে আরো ভালো কাজের প্রত্যাশা রইল। ঐতিহাসিক নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে রূপসজ্জাও পোশাক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, রূপসজ্জায় মহম্মদ আলী এবং পোশাক পরিকল্পনায় গান্ধর্বী খাটুয়ার কাজ বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে।
কৃষ্টি দলটি বয়সে নবীন, তুঙ্গভদ্রার তীরের মতো একটি বিখ্যাত উপন্যাসকে মঞ্চে আনার যে সাহস দেখিয়েছেন তা সত্যিই কুর্ণিশ করার মত। প্রযোজনাটির সফলতার পিছনে দলগত প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ কাজটি মন দিয়ে করবার চেষ্টা করেছেন।ভবিষ্যতে এদের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেল।