২০.০১.২০১৮ তারিখে তৃপ্তি মিত্র সভাঘরে তোতা কাহিনী’র (উত্তরপাড়া ব্রাত্যজন) প্রযোজনান্তে নির্দেশক কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজী ক’টা কথা বলতে মঞ্চে অবতীর্ণ হন; তার উল্লিখিত একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথার সূত্র ধরেই এই আলোচনা শুরু করা যায়। তিনি বললেন যে নাট্যটি মঞ্চ ও অন্তরঙ্গ এই দুই অভিনয় স্থলের জন্যেই সৃষ্ট। এই বিষয়টি নিয়ে মনে হয় একটু তলিয়ে ভাবা দরকার।
কৃষ্ণেন্দু ছোট করে যা বললেন তার যদি একটু সম্প্রসারণ ঘটাই তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায় – তারা এমনভাবে একটা নাট্য বিন্যাস করেছেন যে প্রসেনিয়াম মঞ্চে পারফর্ম্যান্সের নিরিখে যেমনভাবে তা হাজির হবে, অন্তরঙ্গ স্পেসেও ঠিক সেভাবেই হবে। কিন্তু তা হয় কি? হওয়াটা কি সম্ভব? কল্পনা করা যাক,তোতা কাহিনী হচ্ছে একাডেমীর মঞ্চে – ঠিক যেভাবে এই নাট্যটি সেখানে পারফর্ম করা হবে, ঠিক সেভাবেই কি করা হবে তৃপ্তি মিত্র সভাঘরে? নিশ্চিতভাবে না। আর এটাও আমরা জানি যে পারফর্মারের দিক থেকে যেমন, দর্শকের দিক থেকেও তেমনি নাট্যায়নের স্থান বদলে যাওয়ার সাথে সাথে তার দেখা, তার বোঝা, তার অনুভব বদলে যায়। অর্থাৎ, তোতা কাহিনী প্রসেনিয়ামে যে পারফর্মড টেক্সট ও রিসিভড টেক্সট হবে, অন্তরঙ্গ স্থানে কখনই তা হবে না। অন্যভাবে বললে, অভিনয়ের জায়গা পাল্টে গেলেতোতা কাহিনী-কেও নিজেকে পাল্টে ফেলতে হবে সেই স্থানের পারফর্ম্যান্সগত যে দাবী তা মেনে, আর তা না হলে ব্যাপারটা দাঁড়াবে যাকে বলে a square peg in a round hole। সেদিনের সেই প্রযোজনার প্রায় গোটাটা জুড়ে ছিল এই সমস্যাটাই যে পাল্টে ফেলার কাজটা যথোচিতভাবে হয়ে ওঠেনি। এ নিয়ে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলার আগে চট করে সেরে নেওয়া দরকার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা।
Previous Kaahon Theatre Review:
Kaahon Theatre Festival Review: Nandikar’s 34th National Theatre Festival
Read in English@https://goo.gl/RbKANJ#bengalitheatre | #theatre | #theatrereview | #kaahontheatrereview | #KaahonPerformingArts pic.twitter.com/srB9Sxs38Y— kaahon (@kaahonwall) January 9, 2018
‘এ নাট্য প্রসেনিয়ামেও হতে পারে আবার অন্তরঙ্গেও হতে পারে’ এ যেন কিছুটা ঘোলাটে করে দেয় থিয়েটারের রাজনীতির বিষয়টা। রাজনীতি বলতে যদি নানান আদানপ্রদানে লিপ্ত থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার অসম বন্টন বুঝি, তাহলে থিয়েটারের রাজনীতির খুব বড় একটা জায়গা জুড়ে থাকবে পারফর্মার এবং দর্শকের সম্পর্কের মধ্যে থাকা অননুরূপ ক্ষমতার বিষয়টি। প্রসেনিয়াম থিয়েটারে পারফর্মার বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত –তিনি বিরাজ করেন আলোকিত উচ্চ মঞ্চে, তিনি একাই সবাক ও সচল, তিনিই নির্মাণ করেন সকল অর্থ। দর্শক অন্ধকারে থাকেন, তৈরী করা অর্থের প্রায় নিষ্ক্রিয় ভোক্তা হয়ে। এই থিয়েটারে পারফর্মার ও দর্শকের মধ্যে দূরত্ব’ও অনেকটাই। অন্তরঙ্গ থিয়েটার কিন্তু সচেতনভাবে এই রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় – এখানে পারফর্মার ও দর্শক থাকেন সমতলীয় নৈকট্যে, দর্শক সংখ্যা অল্প হওয়ার কারণে পারফর্মারের থাকে তাদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করার সুযোগ এবং সব চেয়ে বড় কথা, থাকে দর্শককে পারফর্ম্যান্সের অন্তর্গত করে নিয়ে তাকেও অর্থ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সামিল করানোর এই থিয়েটারের ফর্মগত দাবী। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে পারফর্মার/দর্শকের সম্পর্কের মধ্যে ক্ষমতার অসমানতাকে কিছুটা কমানোটাই অন্তরঙ্গ থিয়েটারের রাজনীতি। এখন একই নাটক যদি প্রসেনিয়ামেও হয় এবং অন্তরঙ্গেও হয়, তাহলে হয় তাকে দুটো নাটক হয়ে দুই জায়গায় আসতে হবে, নয়ত রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্ত একটি নাটক হিসেবে থাকতে হবে।
এতক্ষণ যা আলোচনা করা হল, তার আলোকে সেদিনকারতোতা কাহিনী’র যে পারফর্ম্যান্স আমরা দেখলাম তার কিছু সমস্যার কথা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করব। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অভিনয়রীতি। সেদিন যারা অভিনয় করলেন তারা প্রত্যেকে যথেষ্ট ভালো অভিনয় করলেন এটা যেমন অনস্বীকার্য, তেমন এটাও ঠিক তারা আগাগোড়া অভিনয় করলেন প্রসেনিয়ামের। সংলাপ তারা যে ভল্যুমে ও পিচে বললেন তা অন্তরঙ্গ স্পেসে মাঝে মধ্যে প্রবল চিৎকার এবং প্রায় সবসময় বেশ জোরালো শব্দ হয়ে পৌঁছালো আমাদের কাছে। প্রসেনিয়াম অভিনয়রীতির একটি প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য যে দর্শকের দিকে তাকিয়ে অভিনয় করার সময় অভিনেতা দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবেন খুব উঁচুতেও নয় আবার নীচুতেও নয় – অর্থাৎ তিনি হয় শুধু ব্যালকনির নয় কেবল প্রথম তিনটে সারির দিকে তাকাবেন তা যেন না হয়। সমস্যা হচ্ছে, অন্তরঙ্গ স্পেসে প্রসেনিয়াম-মানানসই উচ্চতায় দৃষ্টি রাখলে তা ভেসে থাকে চেয়ারে আসীন দর্শকের মাথার এক হাত ওপরের শূন্যতায়– এর ফলে দর্শক যুক্ত হতে পারেন না নাট্যের সাথে। দ্বিতীয়, আলোর বিন্যাস। তৃপ্তি মিত্র সভাঘরের অর্ধেক অংশ অন্ধকারে রাখা (দর্শকাসন) এবং বাকি অর্ধেক অংশ আলোতে (অভিনয় স্থল) আদতে প্রসেনিয়ামেরই আলো বিন্যাস – এই বিভাজন যেন পরিস্কার বলে দেয় দর্শককে, ‘আপনি অন্ধকারে বসে নাটক দেখুন, আপনাকে নাট্যের ভেতরে আমরা ডাকছি না’। এটি বেশ বিড়ম্বনাময় পরিস্থিতি, যেখানে অন্তরঙ্গ স্পেসে এসেও কাছে আসা যায় না। তৃতীয়, অন্তরঙ্গ স্পেসটিকে কিভাবে পারফর্ম্যান্সের অঙ্গ করে তোলা যায় সে নিয়ে আরো গভীর ও তীক্ষ্ণ ভাবনার অবকাশ আছে। খুব খোলসা না করে একটা কথা এখানে ইঙ্গিতাকারে বলাই যায় – কালো দেয়ালের ছোট্ট অন্ধকার ঘরটি’ই কি একটা খাঁচা নয়, যে খাঁচায় আটকা পড়তে পারে পাখির সাথে সাথে সমস্ত দর্শক ও পারফর্মার?
এছাড়া আরো দুটি বিষয়। এক, বই ছাড়া অন্য কোন প্রপ ব্যবহার না করা ও থেকে থেকে কন্ঠ ব্যবহার করে কখনো বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি, কখনো পাখির কলতান সৃষ্টি করা নিঃসন্দেহে অন্তরঙ্গ থিয়েটারের আপেক্ষিকভাবে নিরাভরণ মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই প্রযোজনায় রেকর্ড করা আবহসঙ্গীত কি খুব আবশ্যিক? একবার দুবার আবহ কানে বেশ জোরে বেজেছে। এই প্রসঙ্গে বলা থাক যে Sound of Music ছবির সঙ্গীতের একটা ছোট্ট টুকরো ব্যবহার করা যতটা অর্থবহভাবে সফল আয়রনি সৃষ্টি করতে পারার জন্য, আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’র ব্যবহার ততটাই অসঙ্গত; কারণ বগার ফাঁদ আর তোতার ফাঁদ সম্পূর্ণ আলাদা। দুই, রবীন্দ্রনাথের মূল আখ্যান নাট্যকার জহর দাশগুপ্তের দ্বারা পরিবর্তন, পরিবর্ধন নিয়ে কয়েকটা পর্যবেক্ষণ। রবীন্দ্রনাথের রচনার রাজা কোন বিশেষ ব্যক্তি নন, তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থার, শাসনব্যবস্থার প্রতীক এবং তাই তার লিঙ্গ পরিচয় জরুরি নয়। কিন্তু সেই রাজা যখন এখানে রানী হয়ে যান, তখন প্রশ্ন জাগে এই লিঙ্গ বদলের কি বিশেষ কোন তাৎপর্য আছে? এই পরিবর্তন ক্ষমতায় আসীন বিশেষ কোন ব্যক্তিকে ইঙ্গিত করছে কি না তা যথেষ্ট পরিস্কার না করার মধ্যে যে ধরি মাছ না ছুঁই পানি মানসিকতা কাজ করছে তা আমাদের নজর এড়াচ্ছে না। নাট্যকার যে জায়গায় জায়গায় রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধের অংশবিশেষ সূত্রধরের মাধ্যমে হাজির করেছেন তা মোটের ওপর মন্দ লাগে না, যদিও একটা সময়ের পর রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বুঝিয়ে বলার এই প্রবণতাটা নাট্যগৃহকে ক্লাসঘরে পরিণত করে। প্রান্তিক ও শোষিত একদল চরিত্রের সৃষ্টি কিছু প্রয়োজনীয় বক্তব্য সরাসরি বলার রাস্তা খুলে দেয়। আমার মতে যে পরিবর্তনটি শুধু অনাবশ্যক নয়, যা টেক্সটের নিদারুণ ক্ষতি করে তা হল একদম শেষের লেজুড়টি যেখানে ‘ফিরে চল মাটির টানে…’ গানটি আবহে রেখে শোনানো হয় আশার বাণী। এই আশার বাণী কোনভাবেই রবীন্দ্রনাথের রচনা বা এমনকি নাট্যের আখ্যানও অনুমোদন করে না। মৃত পাখির পেটে “পুঁথির শুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্” করার ভয়াবহ শব্দ ও “নববসন্তের দক্ষিণহাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল” করে দেওয়ার হাহাকারময় ছবি– এই দুইয়ের ভীষণ অভিঘাত লঘু করে দেওয়া ওই শেষাংশটি অবশ্য বর্জনীয়।
বেশ কয়েকটি composition যেভাবে নাট্যের কিছু বিষয় পারফর্ম্যান্সের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপনা করে তা প্রশংসনীয়, যেমন বইয়ের পাতা ওল্টানো দিয়ে পাখির ডানা ঝাপটানো নির্দেশ করা, বই দাঁতে কামড়ে যান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্য ও পড়ুয়ার সম্পর্ক বোঝানো, কাটা-কাটা অঙ্গসঞ্চালনের মধ্যে দিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার যান্ত্রিক প্রাণহীনতা তুলে ধরা। অভিনেতাদের কাজে নাট্য-শিক্ষার ছাপ স্পষ্ট, যেমন স্পষ্ট শৃঙ্খলাবদ্ধ অনুশীলন, যার ফলে বেশ কিছু সমস্যা থাকা সত্ত্বেও নাট্যটি চলাকালীন মোটের ওপর উপভোগ্য।
বর্তমানে বাংলা থিয়েটারের এক বিচিত্র পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যেখানে নাটকের দলগুলি নাট্যমঞ্চ পাচ্ছে না, প্রসেনিয়াম প্রযোজনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে, সরকারি গ্র্যান্টের পরিমাণ কমছে। এমতাবস্থায় অনান্য অনেক নাট্যদলের মতই উত্তরপাড়া ব্রাত্যজন ঝুঁকছেন অন্তরঙ্গ থিয়েটারের দিকে। আশা রাখব তারা তাদের কাজে অন্তরঙ্গ ফর্মটির পারফর্ম্যান্সগত দাবীসমূহ মেটানোর আন্তরিক ও সুচিন্তিত প্রচেষ্টা করবেন যা তাদের নাট্যচর্চাকে ঋদ্ধই করবে।