অন্তর্জাল বিপ্লবের ঢেউ যে নাটককে শুধুমাত্র মাধ্যম হিসাবে আলোড়িত করেছে তাই নয়, নাটকের দর্শকদের মানসিকতাতেও বড়সড় পরিবর্তন এনেছে। তবে এই নতুন যুগে দাঁড়িয়ে থিয়েটার যখন তার নান্দনিক অতীতের ধ্বংসাবশেষ হয়ে টিঁকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, লাইভ পারফরমেন্সের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনার নতুন একটা উদ্যোগও কিন্তু চোখ এড়াচ্ছে না।
কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের প্রযোজনায়, কিশোর সেনগুপ্ত রূপান্তরিত, সম্পাদিত, ও নির্দেশিত “তোমার কোনো সত্য নেই” নাটকের মধুসূদন মঞ্চে ২০শে জানুয়ারি, ২০১৯ তারিখের মঞ্চায়নটি সেই ধারণারই উদযাপন করল, যে থিয়েটারই একমাত্র শিল্প মাধ্যম যা কিনা শুধুমাত্র প্রকৃত ঘটমান সময়ে (real time) অভিনেতা ও দর্শকের সরাসরি সংযোগের শক্তিকে অবলম্বন করে টিঁকে থাকতে পারে, এমনকি প্রযুক্তির পরিবর্তনকে অগ্রাহ্য করেও।
Previous Kaahon Theatre Review:
এই নাটকটি বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক আগাথা ক্রিস্টির ছোটগল্প ও পরবর্তীকালে নাটক “The witness for the prosecution” অবলম্বনে লেখা। গল্পটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় একটি সাপ্তাহিক ‘পাল্প’ ম্যাগাজিন “The Flynn’s” তে, ১৯২৫সালে। নাটকটি একটি হত্যা রহস্য উণ্মোচনকে ঘিরে, তাই এই রিভিউটি পাঠককে নাটকের কাহিনীর কোনো আভাস দেবে না কারণ তা দর্শকের অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করতে পারে।এই নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে আলাদা করে বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই – নাটকটি একটি আদর্শ বিচার ব্যবস্থার প্রতিফলন যা নিজেরই সাংগঠনিক জালে জড়িয়ে গিয়ে মানুষের মনস্তত্ত্ব ও সম্পর্কের অন্তর্নিহিত ছায়াচ্ছন্ন পথে হারিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় – বিষয়টি প্রাসঙ্গিক এবং স্থানকাল উত্তীর্ণ।
প্রায় সর্বত্রই শোনা যায় যে থিয়েটার হল অভিনেতার মাধ্যম। সেখানে দাঁড়িয়ে “তোমার কোনো সত্য নেই” নাটকটি এই কারণে আরও তাৎপর্যপূর্ণ যে এখানে পরিচালকের ভূমিকাটি প্রবল ভাবে দৃশ্যমান। আগেই বলা হয়েছে যে নাটকটি একটি হত্যারহস্য কেন্দ্রিক। যখন বাংলার প্রায় প্রত্যেকটি মূল ধারার প্রসেনিয়াম থিয়েটার প্রতিটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে চলেছে, অন্যান্য দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের পরিবর্তনগুলোকে অঙ্গীভূত করতে চাইছে, তখন কল্যাণী নাট্য চর্চা কেন্দ্রের এই প্রযোজনা সেই প্রবণতার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়। সহজ ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি – মোবাইল ফোন, ডিজিটাল ক্যামেরা, আইপড, ইত্যাদি এবং তার সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ ও সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় থিয়েটার দর্শকের অভিজ্ঞতায় এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে, দর্শক সহজেই লাইভ স্পেস আর প্রযুক্তিক স্পেসের মধ্যে যাতায়াত করতে পারেন, এমনকি থিয়েটার চলাকালীনও। দর্শক আর অভিনেতার মধ্যে তৈরি হওয়া এই নতুন সম্পর্ককে বাজিয়ে দেখার সুযোগটা লেখক-নির্দশক কিশোর সেনগুপ্ত সাদরে গ্রহণ করেন, আর তিনি কাজটা করেন বেশ সুদক্ষ ভাবে- মিউজিক, লাইট, সেট, কস্টিউম, এবংঅভিনয়কলা, সমস্ত উপাদানগুলোকে একাত্ম করে নিয়ে। তার কাজের সুবিধাও হয়ে যায় এইরকম হত্যারহস্যের মতো একটা শক্তিশালী বিষয়বস্তু হাতে পেয়ে গিয়ে। তিনি রহস্যটা বর্ণনা করেন খুব যৎসামান্য উপায় অবলম্বন করে, সমস্ত প্রলোভন এড়িয়ে। হিরণ মিত্রের সরল প্রতীকী সেট দর্শককে নাটকের প্রেক্ষাপট কল্পনা করে নিতে সাহায্য করে। দীপক মুখোপাধ্যায়ের চমকহীন আলোকভাবনা দর্শকের চিত্ত একবারের জন্যও বিক্ষিপ্ত হতে দেয় না, বোঝা যায় যে এই চমকহীনতা আসলে একটা সামগ্রিক ভাবনারই অঙ্গ। শক্তিশালী নাট্যের কৃতিত্ব অবশ্যই আগাথা ক্রিস্টির, কিন্তু নাট্যকারের বুদ্ধিদীপ্ত বঙ্গানুবাদও দেশীয় রূপান্তর, এবং তার সঠিক মঞ্চায়নের ফলেই দর্শকরা এই রোমাঞ্চকর কাহিনীর রোমাঞ্চটা পুরোমাত্রায় উপভোগ করতে পারেন। নাটকের অভিনেতৃবর্গ গণমাধ্যমের, বিশেষ করে টেলিভিশনের প্রতিনিধিত্ব করেন না, তারা সাধারণ নাট্যোৎসাহী। সকলেই যে খুব প্রতিভাধর তা হয়তো নয়, কিন্তু প্রতিনিয়ত অনুশীলনের মাধ্যমে সকলেই কম বেশি দক্ষ, যা তাদের অভিনয়ে স্পষ্ট। কিশোর সেনগুপ্ত একটি অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন, আর জ্ঞানতই নিজের অভিনয়কে একটু চড়া মাত্রায় বেঁধে রাখেন যা পুরো দলটির বাস্তবানুগ অভিনয়ের পর্দার মধ্যে সমতা রক্ষা করে।
নাটকটিকে দেশীয়করণ করা হলেও ক্রিস্টির নাটকের চরিত্রের নামগুলি অপরিবর্তিত রয়ে যায়। কিন্তু নাটকটির চরিত্রগত গুণের জন্য এবং অভিনেতাদের প্রাণশক্তিতে ভরপুর অভিনয়ের জন্য নাটকটি যত এগোয়, এইসব ত্রুটি অলক্ষিতই থেকে যায়। পরিচালক বেছে নিয়েছেন চিরায়ত ইউরোপীয় প্রসেনিয়াম থিয়েটারের স্টাইল যা প্রধানত স্ক্রিপ্টের প্রতি আস্থা এবং জোরালো অভিনয়ের গুণে নাট্য-অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর হয়েছে।
ডিজিটাল দুনিয়ার বাস্তবতা আর তার সঙ্গে থিয়েটারে যথেচ্ছ মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার যখন দর্শক মনের নান্দনিক প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে, তখন উল্টো পথে হেঁটে সরল সাধাসিধে কলাকৌশলবিহীন থিয়েটারের দুনিয়ায় প্রবেশ করা খুবই কষ্ট সাধ্য। এই সারল্য হয়ত বর্তমানের অস্থির দর্শকের মনোযোগ টেনে রাখতে ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু এইক্ষেত্রে অন্তত সেটা হয়নি। নাটক যত এগোয়, দর্শক মন ততই কাহিনী বর্ণনার পদ্ধতির গ্রাসে পড়ে যেতে থাকে এবং হত্যাকারীর পরিচয় জানতে পারার উৎকন্ঠায় আঙ্গুলের শেষ নখটি পর্যন্ত চিবিয়ে ফেলে।
কল্যাণী নাট্য চর্চা কেন্দ্র-কে অভিনন্দন, তারা মাধ্যম হিসাবে থিয়েটারের ক্ষমতার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। সেই থিয়েটার, যা কিনা প্রযুক্তির সণ্মোহন ব্যতিরেকে শুধুমাত্র লাইভ অভিনয় এবং ধারণার আদান প্রদানে বিশ্বাসী। নাটকটিতে সামান্য কিছু বিরুদ্ধ সমালোচনার জায়গা আছে, যেমন শেষ দৃশ্যটি – আদালতকক্ষে শুনানির ঠিক পরেই একটি সম্পূর্ণ হত্যা দৃশ্য সঙ্ঘটিত হয় যা কিনা এই সময়ে বেশ অবিশ্বাস্য। সামান্য অদল বদলেই দৃশ্যটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
“তোমার কোনো সত্য নেই” জাতীয় নাটকগুলোকে স্থানীয় এবং শহরের বাইরের বড় নাট্য-উৎসবগুলোতে বেশি করে আমন্ত্রণ জানালে সাধারণ মানুষও আরো বেশি করে থিয়েটার মাধ্যমের প্রকৃত ক্ষমতার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারবেন।