সোনাই বিবি – সমকালের আয়নায় একটি উপভোগ্য ঐতিহাসিক পালানাট্য

Posted by Kaahon Desk On July 6, 2019

রঙরূপ নাট্যগোষ্ঠীর নতুন নাটক ‘সোনাই বিবি’ বর্তমানে নিয়মিত অভিনয় হয়ে চলেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ইতিহাসাশ্রয়ী গল্প ‘কীর্তিনাশার এপারে ওপারে’ অবলম্বনে নাটকটি লিখেছেন সৌনাভ বসু, নির্দেশনায় জয়ন্ত মিত্র, আর সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে রঙরূপ নাট্যগোষ্ঠীর প্রধান, প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব সীমা মুখোপাধ্যায়। বর্তমান সমালোচনাটি গত ১৫ই মার্চ, ২০১৯, তারিখে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের লেডি রাণু মুখোপাধ্যায় মঞ্চে অভিনয়ের ভিত্তিতে লেখা।

সময়টা ষোড়শ শতকের শেষভাগ, বাংলা ও অসম জুড়ে স্থানীয় জমিদারেরা তখন প্রায় স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করছেন। সমরশক্তিতে বলীয়ান এই স্বশাসিত জমিদারেরা ইতিহাসের পাতায় ‘বারো ভূইঞা’ বলে খ‍্যাত (‘বারো’ শব্দটি এখানে ‘অনেক’ অর্থে ব্যবহৃত)। প্রায় তিনশো বছর ধরে চলে আসা জমিদারি তখন বহিঃশত্রুর আক্রমণের সামনে সঙ্কটাপন্ন, প্রায় পতনের মুখে। ইতিহাসের ঐ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে দক্ষিণবঙ্গের ভাটি অঞ্চলের প্রধান দুই ভূইঞা ঈশা খাঁ ও কেদার রায়, এবং তাদের সাধারণ যোগসূত্র, সোনাই বিবিকে নিয়ে গল্পটি লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। গল্পের মূল বিষয় ছিল সনাতন ধর্মের অচলায়তনিক লোকাচার ও গোঁড়ামি, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, এবং বিভেদের কারণে বাংলার স্বাধীনতার অবসান। কেদার রায়ের বালবিধবা ভগিনী স্বর্ণময়ী নিষ্ঠাভরে লোকাচার পালন করেন, ঈশা খাঁ তার প্রতি অনুরক্ত হন, কিন্তু কেদার তার ভগিনীর পুনর্বিবাহে সম্মত হন না! তখন ঈশা স্বর্ণময়ীর সম্মতিতেই তাকে হরণ করে বিবাহ করেন, স্বর্ণময়ী হয়ে ওঠেন ‘সোনাই বিবি।’ কেদার ও ঈশার মধ‍্যে সামরিক সমঝোতা ভেঙ্গে যায়, সেই সুযোগে মুঘল সেনা ঢুকে আসে বাংলায়! যেহেতু এইসময়ের বাংলা সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য সীমিত, ঘটনা ও চরিত্রচিত্রণে সুনীল অনেকটাই স্বাধীনতা নিয়ে ছিলেন। নাট্যকার সৌনাভ বসু‌ও অনেক স্বাধীনতা নিয়েছেন, নাট্যরূপান্তরের জন্য তা’ এমনিতেই জরুরী। এছাড়াও তিনি কয়েকটি ক্ষেত্রে গল্পের গুণগত পরিবর্তন করেছেন, তার বেশিরভাগই যথোপযুক্ত, বিশেষ করে নারীস্বাধীনতার দৃষ্টিকোণটিকে গভীর করে নাটকটিকে তিনি নতুন মাত্রা দিয়েছেন। কেদার রায়ের স্ত্রী বিভা চরিত্রটির সৃষ্টি তার বিশেষ কৃতিত্ব। চরিত্রটি শুধুমাত্র একটি অবদমিত, কিন্তু আধুনিক মনস্ক, নারীসত্তার প্রতীক হিসাবে থেকে যায়নি, নাটকের শেষের দিকে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে বিভার আগমন চরিত্রটিকে নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। প্রাথমিক দৃশ্যাবলীতে স্বামীহারা স্বর্ণময়ীর যৌন অতৃপ্তির ঈঙ্গিত দেওয়াটাও প্রশংসাযোগ্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা সংলাপ এমনিতেই বেশ প্রাঞ্জল, গল্পে যেটুকু সংলাপ ছিল তা’র অনেকটাই প্রায় অবিকৃতভাবে নাটকে উঠে এসেছে; তবে স্বর্ণময়ী ও ঈশা খাঁর প্রশ্নোত্তর পর্বে যেটুকু পরিবর্তন নাট‍্যকার করেছেন তা’ দৃশ‍্যটিকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু ঈশা খাঁর বিপদসঙ্কুল নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার অংশটি নাটকে যুক্ত করায়, বা অন্তিম যুদ্ধে ঈশার গৃহীত কূটকৌশলের অংশটি নাটকে বর্জন করায়, চরিত্রটি রক্তমাংসের মানুষের বদলে একমাত্রিক ‘নায়ক’-এ পরিণত হয়েছে, যা একেবারেই কাম‍্য ছিল না। অন‍্যদিকে, প্রতাপাদিত্যের আমন্ত্রণে বারো ভূইঞাদের মৈত্রী বৈঠকের দৃশ‍্যটি ইতিহাসের নিরিখে কষ্টকল্পিত, ঐরকম কোনও ঐক‍্যের ধারণার তখন জন্ম হয়নিই বলা চলে। আবার ইতিহাস অনুযায়ী ঈশা খাঁর মৃত‍্যু হয় সত্তর বছর বয়সে, নাটকে তিনি যুবকই থেকে যান। তবে যেহেতু গল্প এবং নাটক, দুইক্ষেত্রেই একটা আধুনিক ‘কিংবদন্তীর নির্মাণ’ ধরণের আহ্বান রয়েছে, তাই হয়ত জ্ঞাত ইতিহাস থেকে এই বিচ্যুতি কিছুটা প্রশ্রয় পেতেই পারে!

Previous Kaahon Theatre Review:

নির্দেশক জয়ন্ত মিত্র নাটকটিকে সাবেক বাংলার পালাগানের মতো করে সাজিয়েছেন, কিন্তু সঙ্গে আধুনিক নাট‍্যভাষার প্রয়োগ‌ও করেছেন। সন্দীপ সুমন ভট্টাচার্যের মঞ্চপরিকল্পনাও পরিচালকের সেই ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ; মূলতঃ কয়েকটি বেদী বা রস্ট্রাম, সঙ্গে কয়েকটি সংকেতসমৃদ্ধ দণ্ড, যেগুলি একেকটি দৃশ‍্যে একেকভাবে ব‍্যবহার করা হয়। নাটকের অভিনব সূচনাপর্ব নাটকটি সম্পর্কে দর্শকমনে আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। সুখশ্রাব্য নৃত্যগীতের মাধ্যমে প্রাথমিক ঘটনাবলী বর্ণিত, শুভেন্দু মাইতি কৃত সঙ্গীত ও আবহ খুবই সুসঙ্গত, বিশেষ নাট্যমুহূর্তে বাঁশির ব‍্যবহার যথাযোগ্য। তরুণ প্রধানের সঠিক সমন্বয়সাধ্য কোরিওগ্রাফিও দৃষ্টিনন্দন। পৌলমী তালুকদারের পোশাক পরিকল্পনা ঐ সময়কালীন পোশাক-আশাক সম্পর্কে সাধারণ ধ‍্যানধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাদল দাসের আলোও নাটকের কল্পকাহিনীর মেজাজটিকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। তবে ঐ প্রাথমিক পর্বটি নাটকের সঙ্গীতধর্মী চলন সম্পর্কে যে প্রত্যাশা তৈরি করে তা’ পুরোপুরি পূর্ণ হয় না, নাটকে গানের ব্যবহার চোখে পড়ে আবার একেবারে শেষে গিয়ে। এই বিষয়টি একটু ভারসাম্যের অভাব তৈরি করলেও দর্শক কিন্তু নাটকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান একেবারে প্রথম থেকেই। কাহিনীর দ্রুততা, আকর্ষক দৃশ্যভাবনা, মঞ্চে একাধিক চরিত্রের অনুশীলন লব্ধ চলাফেরা, সব কিছু মিলে দর্শক একেবারে মজে থাকেন। দর্শক অনুভব করতে পারেন ধর্মীয় বিভেদের অসারতা, ঐক্যের তাৎপর্য, পারস্পরিক সম্পর্কে আস্থার গুরুত্ব, ব‍্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী সামাজিক তথা ধর্মীয় আচার উপেক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা, নারী-পুরুষ উভয়েরই সমাজ নির্দিষ্ট ভূমিকার গন্ডী ছেড়ে বেরিয়ে আসার আবশ্যকতা – আর এখানেই একটা ঐতিহাসিক নাটক তার নিজস্বকালের গন্ডী ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে চিরকালীন।

নাটকের একটি দুর্বল জায়গা অবশ্যই অভিনয়। পালাগান শৈলীর নাটক বলে অভিনয় সামান্য উচ্চকিত, সেটা প্রত্যাশিত‌ও, এবং সেটা কখনোই মাত্রাতিরিক্ত নয়; কিন্তু সামগ্রিক অভিনয়ের গড়পড়তা মান বেশ সাধারণ! একমাত্র কেদার রায় চরিত্রে অনন্য শঙ্কর দেবভূতি-ই চরিত্রের দ্বন্দ্ব, হতাশা, স্নেহ ও ক্রোধের মিশ্রণটি সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। পার্শ্বচরিত্রগুলির মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি কেদার রায়ের অমাত্যরূপী জগন্নাথ চক্রবর্তী এবং কিছুটা হলেও ঈশা খাঁর বন্ধু দায়ুদ-রূপী সৌনাভ বসুর। তবে দায়ুদ ও সোনাই-এর যৌথ অসিচালনার দৃশ্যের বিস্তার করতালি-আকর্ষক হয়ে পড়েছে! দর্শক যদি নাটকের সুপরিকল্পিত গুরুত্বপূর্ণ নাট্যমুহূর্তগুলির বদলে অসিচালনার মতো ‘স্টান্ট’দৃশ্যে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েন, তো দৃশ্যটি নিয়ে অবশ্যই ভাবনা চিন্তার অবকাশ আছে। ঈশা খাঁর চরিত্রটি একমাত্রিকতার কারণে এমনিতেই দুর্বল, তারও পর অপূর্ব কুমার সাহা তার কোমল বাচনভঙ্গির মাধ্যমে চরিত্রটিকে আর‌ও বেশি করে রোমান্টিক নায়কে পরিণত করেছেন – এই চরিত্রটি আর‌ও দর্প ও বলিষ্ঠতা দাবী করে। অন্যতম মুখ্যচরিত্র সোনাই বিবিতে অমৃতা মুখোপাধ্যায়ের প্রচুর সুযোগ ছিল, কিন্তু তার অভিনয় সাধারণত্বের সীমা অতিক্রম করতে পারেনি, বরং স্বর্ণময়ীর দাসীর চরিত্রাভিনেত্রী নিজের কাজটি নিপুণভাবে সম্পন্ন করেন।Mahabharata 2 – Practicing the incult package & shallow tricks in Mahabharata’s Udyoga Parva

তবে সব মিলিয়ে নাটকটি উপভোগ্য, বাংলা নাটকের এই দুর্দিনে কিঞ্চিৎ আশা জাগায়! সমকালের আয়নায় ইতিহাসকে ফিরে দেখা, তাও আবার বাংলার সুপ্রাচীন পালাগানের ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে – বিষয়টি অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। রঙরূপ নাট্যগোষ্ঠী বহুদিন যাবৎ নাটক প্রযোজনা করে আসছেন, তবু আজও যেন ‘রঙরূপ’ বলতেই বোঝায় সেই নব্বই দশকের ‘বিকল্প’, ‘ভাঙা বনেদ’, বা ‘যে জন আছে মাঝখানে’ নাটকগুলির কথা। আশা করব, জয়ন্ত মিত্রর হাত ধরে রঙরূপ আবার তার স্বমহিমায় ফিরতে পারবে।

+

 

Anjan Nandi
A science student, postdoctoral researcher, writer-translator of science oriented popular literature and a dedicated audience of theatre for last two decades, he has observed many changes in Bengali theatre from a very close proximity. He is a regular contributor in Bengali Wikipedia and engages himself deeply in photography and cinema.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us