রক্ত উপাখ্যান – প্রসেনিয়ামের পরিবর্তে মুক্ত প্রাঙ্গনের আহ্বান

Posted by Kaahon Desk On January 3, 2019

‘অনীক’ আয়োজিত ‘গঙ্গা-যমুনা’ নাট্যোৎসবে গত ২২শে ডিসেম্বর তপন থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হল শান্তিপুর সাংস্কৃতিক প্রযোজিত নাটক ‘রক্ত উপাখ্যান’, নাটক ও নির্দেশনা কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। অনীক গোষ্ঠী অনেক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই উৎসবের আয়োজন করে আসছে যা বর্তমানে কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিভিন্ন জেলা শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, ফলে সেখানকার মানুষেরা বিভিন্ন নাটক দেখার সুযোগ পাচ্ছেন, আবার জেলার দলগুলিকে কলকাতার মঞ্চে আমন্ত্রণ জানাবার কারণে কলকাতার দর্শকেরাও জেলার নাট্যচর্চা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবার সুযোগ পাচ্ছেন। পারস্পরিক এই আদান প্রদানের মাধ্যমে সামগ্রিক নাট্যচর্চা সমৃদ্ধ হচ্ছে, তাই অনীকের এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।

এবার আসা যাক আজকের আলোচ্য নাটক ‘রক্তউপাখ্যান’এর কথায়। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে নাট‍্যকার বেশ কয়েক বছর আগেই নাটকটি লিখেছিলেন কিন্তু মঞ্চস্থ হয়ে ওঠেনি, সেইটিকেই কিছু সংযোজন ও পরিমার্জন করে ২০১৮তে আমাদের সামনে যে নাট্য আয়েজন উপস্থিত করলেন তা ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক এবং এই পরিবেশন বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি মনে হয়েছে। নাটকটি আমাদের ঘুমিয়ে থাকা বিবেক, স্থবির বোধকে দারুণ ভাবে নাড়া দেয়, আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা যা মনুষ্যত্বকে প্রতিনিয়ত অপমান করে কিন্তু আমরা দেখেও না দেখার অভিনয় করি, সেই না দেখাগুলোকে নির্দেশক আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, আমাদের যন্ত্রণাগুলোকে অনুভব করান, বহু আস্তরনে চাপা পড়া দীর্ঘ মৌনতা সব বাধা ভেদ করে গগনভেদী আর্তনাদে বেড়িয়ে আসতে চায়!

Previous Kaahon Theatre Review:

অনেক বিষয় আছে যা সহজে প্রকাশ করা যায় না, সেগুলি নাট্য পরিবেশনের দক্ষতায় সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এখানে নাট্যকার তথা নির্দেশক কোন নির্দিষ্ট কাহিনীকে আধার না করেই শুধুমাত্র তথ্য ও আবেগের সমন্বয়ে বিষয়বস্তুর সুচারু উপস্থাপনার মাধ্যমে তার বক্তব্যকে দর্শকদের মধ্যে সহজেই পৌঁছে দিতে পেরেছেন। নাটকের শুরুতে সূত্রধাররূপে নির্দেশক নাটকের মুখবন্ধ উপস্থাপনের মাধ্যমে মঞ্চ ও দর্শকাসনের ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলে দর্শকদের নাটকের অংশ হিসেবে সামিল করে নেন।অতীত ইতিহাস আর বর্তমান কোথাও যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। হিংসা, বিবাদ, রাজনৈতিক চক্রান্ত, জাতিবিদ্বেষ, দাঙ্গা, নৃশংসতা, ইত্যাদির ধারাবাহিকতাই যেন আমাদের জীবনের উপাখ্যান। এই উপাখ্যান এতটাই যন্ত্রণার আর আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত যে তাই তা হয়ে উঠেছে রক্ত উপাখ্যান।

স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণে ছেচল্লিশের দাঙ্গা আর ২০০২ সালের গোধরাকাণ্ড বা দেশভাগের ফলে উদ্ভুত উদ্বাস্তু সমস্যা আর নাগরিকপঞ্জী তৈরীর নামে এক নিমেষে আসামের কয়েক লক্ষ মানুষকে বাদ দিয়ে দেওয়া, কিভাবে যেন একাকার হয়ে যায়। এইসব ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে সময়ের অন্তরে রূপবদল করে করে, আর যুগ যুগ ধরে মানুষকেই নীরবে বয়ে যেতে হয় যন্ত্রণার জগদ্ল পাথর।

কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার ক্ষমতা লাভের ইচ্ছাকে চরিতার্থ করার জন্য দেশের মাঝেখান দিয়ে সীমারেখা টেনে দিয়ে বলা হল এটা ‘আমাদের’ ওটা ‘তোমাদের’। আমার জন্মস্থান আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল কিছু অপরিচিত মানুষ, কিন্তু কেন? কী অধিকার ছিল তাদের?এ প্রশ্ন করবার অবকাশ ছিল না, কান্না বুকের মধ্যে চেপে এক বস্ত্রে চলে আসতে হয়েছিল অন্য পারে। তাদের নতুন পরিচয় হল উদ্বাস্তু।চরম কষ্টের মধ্যে দিন কাটতে হয়েছে উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। এ শুধুমাত্র অতীতের বেদনাময় স্মৃতিই নয়, বর্তমানের দর্পণে এছবি ভীষণভাবে জীবন্ত। বর্তমান রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের মতকে জোর করে সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চালাচ্ছে। মানুষের স্বাধীন চিন্তার উপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। আর মতের সাথে মিল না হলেই দেগে দেওয়া হচ্ছে তুমি দেশদ্রোহী বলে। দেশের মানুষ ধর্মকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পেরে, তাকে ভালোবাসতে না শিখে, শুধুই ভয় পেয়েছে চিরকাল, আর তার সুযোগ নিয়ে একদল মনুষ ভগবানের দোহাই দিয়ে মারামারি, দাঙ্গা, ধর্ষণ, হত্যার মত জঘন্য কাজ করে চলে অবলীলায়। সাধারণ মানুষ চিরকাল সবকিছু মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তাই বিবেক, চিন্তা, চেতনা, সব‌ই মগজ নামক আধারে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। এ নাটক মানুষের বিবেক, চিন্তা, চেতনাকে, সেই বন্ধন থেকে মুক্তির ডাক দিয়েছে। ক্রমশ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বোবা মানুষদের উচ্চকন্ঠে সমবেত চিৎকার করবার উৎসাহ জুগিয়েছে। তবে এ নাটক দেখবার জন্য প্রেক্ষাগৃহে হাতে গোনা অল্প কয়েকজন দর্শকের উপস্থিতি মন খারাপ করে দেয়। এ নাটকটি যে ফরম্যাটে তৈরি (স্থির আলো আর নিরাভরন মঞ্চ), অনায়াসেই এটি প্রসেনিয়ামের বদলে মুক্তপ্রাঙ্গনে পরিবেশিত হতে পারে, তাতে মানুষের কাছে এর অভিঘাত অনেক বেশী হবে এবং সহজে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছোনো যাবে।

নাটকের কোরিওগ্রাফির ভাবনা সুপরিকল্পিত, ফলে বেশ কিছু সুন্দর নাট্যমুহূর্ত তৈরি হয়েছে। সুচারু কম্পোজিসনে সৃষ্ট দৃশ্যগুলি সহজে অনেক কথা বলে দিয়েছে। শুধুমাত্র টুপি বদল করে একজনকে দিয়েই নেহেরু ও জিন্নার অভিনয়, বা লাঠির ডগায় কাটআউটে মহত্মাগান্ধীর ছবি দিয়ে গান্ধীজীর অভিনয় করানো বুদ্ধিদৃপ্ত প্রয়োগ। উপযুক্ত স্থানে রবীন্দ্রনাথ বা শঙ্খ ঘোষের রচনার ব্যবহার নাটককে সমৃদ্ধ করেছে।জনা কুড়ি ছেলে মেয়ে, তার মধ্যে অধিকাংশই অল্প বয়সী, তাদের দলগত অভিনয়কে নির্দেশক সুশৃঙ্খল ভাবে দক্ষতার সাথে কজে লাগিয়ে নাট্য নির্মাণ করেছেন। একদল তরুণ তরুণীর নিয়মানুবর্তিতা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও পেশাদারিত্ব চোখে পড়ার মতো। নাটকে উজান চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ড্রাম, ঢোল, ও অনান্য বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে যে উচ্চকিত সঙ্গীত সৃষ্টি করা হয় তা আমাদের হৃদয়ে এসে ধাক্কা দেয়। বলা বাহুল্য এ নাটকে লাইভ মিউজিকের ব্যবহার হয়েছে। উজানের গানের কন্ঠটি বেশ ভালো লাগে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়েজন, সঙ্গীত বেশ কিছু জায়গায় সংলাপের উপর দিয়ে গেছে। ফলে সংলাপ শুনতে বাধা সৃষ্টি হয়, এব্যাপারে যত্নবান হওয়া দরকার।

নাটকের শেষে আগুন ও জল পাশাপাশি রেখে সুন্দরভাবে ঘৃণা এবং ভালোবাসার সহাবস্থানকে ইঙ্গিত করেছেন। ঘৃণা না ভালোবাসা সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদেরকেই, নাটকে এই আহ্বানই জানানো হয়েছে।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us