পিরানদেল্লো ও পাপেটিয়ার – ঐতিহাসিক জীবনের আয়নায় সমকালকে মিলিয়ে নেওয়ার নাট্য

Posted by Kaahon Desk On July 12, 2019

বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক আলোচিত ও বিতর্কিত নাট্যকার লুইজি পিরানদেল্লো, তবুও তাঁর জীবনযাত্রা সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। ইতালির এই নাট্যকার, কবি, ঔপন্যাসিককে অজানার অন্ধকার থেকে আলোয় প্রকাশ এবং তৎকালীন সময়ের আয়নায় সমকালকে দেখার প্রয়াস হল চন্দন সেনের নাটক ‘পিরানদেল্লো ও পাপেটিয়ার’। অরূপ রায়ের নির্দেশনায় নাটকটি প্রযোজনা করেছেন অনীক নাট্যদল। গত ৪ঠা জুলাই মঞ্চস্থ হল আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস মঞ্চে। যদিও এই রিভিউ ১লা এপ্রিলের অভিনয়ের উপর আধারিত।

Previous Kaahon Theatre Review:

এই নাটকে পিরানদেল্লোর জীবনের এক সম্পূর্ণ ছবি আমাদের সামনে তুলে ধ‍রা হয়েছে এবং তার পাশাপাশি তৎকালীন ইতালির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার ছবি ও সুন্দ‍রভাবে ফুটে উঠেছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এ নাটক অত্যন্ত জরুরী ছিল তা’ নাটকটি দেখতে বসে বেশ অনুভব করা যায়। নাট্য-দর্পণে যেন এই সময়ের এক টুকরো ছবি।মুসোলিনির দেখানো অলীক স্বপ্নে বিভোর হয়ে তাঁর সাথে হাত মিলিয়েছেন পিরানদেল্লো। শুধু পিরানদেল্লোই নয়, সেই সময় বিশ্বের অনেক বুদ্ধিজীবীই মুসোলিনির মোহে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন, এমনকি রবীন্দ্রনাথও বাদ যাননি‌। ১৯২৬ সালের ১৩ই জুন রবীন্দ্রনাথের সাথে মুসোলিনির যে সাক্ষাৎ হয়েছিল সেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন ‘আপনিই পৃথিবীতে সর্বাধিক ভুল-বোঝা মানুষ, আপনার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ায় আমি খুবই আনন্দিত কারণ তাতে অনেক ভ্রান্ত ধারণা অপসারিত হয়েছে।’ তবে অচিরেই রবীন্দ্রনাথ ভুল বুঝতে পারেন তাঁর বন্ধু রমাঁ রলাঁর পরামর্শে। কিন্তু পিরানদেল্লোর ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য তাঁর পাশে রমাঁ রলাঁর মতো কোন বন্ধু ছিলেন না। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন জীবনের কঠোর ও নির্মম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। তবে তাঁর এই উপলব্ধি বড় দেরিতে হয়। শেষ জীবনে তিনি অনুশোচনা ও আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়েছেন।

পিরানদেল্লো ছোটবেলা থেকেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছেন।সালফার খনির মালিক তার ধনী বাবা স্তেফানো ছিলেন রাগী ও বদমেজাজি, আর সর্বদা তিনি স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের দাবিয়ে রাখতেন‌। এছাড়া বহুগামিতার জন্য সমাজে যেমন ছিল তার অখ্যাতি তেমনি সাংসারিক জীবন ছিল অশান্তিময়। এসব নিয়ে কিশোর কাল থেকেই জেরবার হয়েছেন পিরানদেল্লো। তাঁর একমাত্র আশ্রয় ছিল মা ক্যাটরিনা। বাবাকে যতটাই ঘৃণা করতেন মাকে ততটাই ভালোবাসতেন তিনি। পিরানদেল্লোর লোভী বাবা বিশাল অঙ্কের বরপণ নিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ মারিয়া পর্তুলানোর সঙ্গে পিরানদেল্লোর বিয়ে দিয়ে দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ইতালির দেশবাসীকে তখন নতুন ইতালি গড়বার স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন মুসোলিনি, সাংস্কৃতিক নবজাগরণের স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন তিনি। পিরানদেল্লো চেয়েছিলেন রাশিয়ান ন্যাশনাল আর্টথিয়েটারের আদলে ইতালিতেও একটি জাতীয় নাট্যশালাও সংগ্রহালয় গড়ে তুলবেন। তাঁকে সহযোগিতার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফ্যাসিবাদের প্রতি তাঁর সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন মুসোলিনি‌। কথা রাখেননি স্বৈরাচারী এই শাসক। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ থেকে সরে এলেও আজীবন নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি পিরানদেল্লো।ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে বিপ‍র্যস্ত পিরানদেল্লোর আটান্ন বছর বয়সে, ১৯২৫সালে সাক্ষাৎ হল পঁচিশ বছর বয়সী ইতালিয় অভিনেত্রী মার্তা আব্বার সাথে।এর পূর্বে তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ছাড়া রচনা করেছিলেন মাত্র দু’একটি নাটক।এরপর তার সকল রচনার প্রেরণা হয়ে উঠলেন মার্তা। কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার পিরানদেল্লো হয়ে উঠলেন পুরোপুরি নাট্যকার পিরানদেল্লো। তাঁর লেখা নাটকে একের পর এক অভিনয় করলেন মার্তা আব্বা। ৮৮বছরের বৃদ্ধা মার্তা মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তার ভাবনায় ডেকে আনলেন তার স্যার পিরানদেল্লোকে, বললেন ফ্যাসিস্ট ইতালির ভয়াবহতার কথা‌।পিরানদেল্লো যখন পৃথিবী ছেড়ে চলেগেছিলেন(১৯৩৬) তখন তিনি দেখে গেছিলেন ফ্যাসিবাদের শিশুকাল। পিরানদেল্লো পরবর্তী ইতালি সাক্ষী হয়েছে মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির ভয়াবহ ধ্বংসলীলার। নাটকে বর্ণিত পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেকাংশে মিল লক্ষ্য করা যায়। বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশকে শাসক যেভাবে প্রলোভন দেখিয়ে বা ভীতি প্রদর্শন দ্বারা নিজেদের সমর্থক করে তোলে তা’ চিরকালীন। যুগযুগ ধরেই শাসকের অদৃশ্য হাত সমাজের গুণী ও প্রতিষ্ঠিত মানুষদের নাচাতে চায় তাদের ইচ্ছে মতো, নিজেদের ক্ষমতা কায়েম রাখার জন্য। এ নাটক দেখতে দেখতে আমরা চলে আসি আজকের পৃথিবীতে, বর্তমান ভারতবর্ষে, এই বাংলায়, যেখানে ফ্যাসিবাদের করাল ছায়া প্রতিনিয়ত সভ্যতাও সংস্কৃতির দিগন্তকে ঢেকে ফেলছে। সৃষ্টিকামী, মননশীল মানুষদের প্রতি এক সতর্ক বাণী শোনায় এই নাটক। পিরেনেদেল্লোর আত্মগ্লানি, অনুশোচনা সামান্য হলেও প্রেরণা যোগাবে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামে‌। সভ্যতার এই সংকটকালে অনীকের সময়োপযোগী প্রযোজনা সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা আরো একবার প্রমাণ করল।

এ নাটকে তিনজন পিরানদেল্লো। তাঁর জীবনের তিনটি পর্ব তিনজন ভিন্ন অভিনেতা অভিনয় করছেন। কৈশোরে কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী, মাঝবয়সে দিলীপ মজুমদার ও পরিণত বয়সে অরূপ রায়। তিনজনই তাদের হৃদয়ের পরশে পর্বগুলিকে আলোকিত করে তুলেছেন। অরূপ রায় তার সুন্দর সাবলীল মার্জিত কিন্তু দৃপ্তঅভিনয়ের মাধ্যমে পিরানদেল্লোকে দর্শকদের দৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য এবং জীবন্ত করে তুলেছেন‌। মার্তা আব্বার চরিত্রে তপতী ভট্টাচার্যের অভিনয় দর্শকদের মনে ছাপ রেখে যাবে। তার পূর্ববর্তী অভিনয়গুলির সাথে তুলনা করলে বোঝা যায় যে তিনি প্রতি বার নিজেকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়ে চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।অংশুমান দাশগুপ্ত কঠোর, বদমেজাজি, অসহিষ্ণু স্তেফানো চরিত্রটি সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ক্যাটরিনা চরিত্রটিকে সুচিত্রিতা ঘোষ অবদমিত নারীসত্তার প্রতীক হিসেবে উপস্থিত করেছেন তার অভিনয় দিয়ে। সামগ্রিকভাবে অভিনয়ের মান বেশ উন্নত। উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, অভিব্যক্তি, সবকিছুর মধ্যে একটা সুশিক্ষিত অনুশীলনের ছাপ আছে‌।

Sonai Bibi – An enjoyable historical folk ballad reflecting the contemporary time

নীল কৌশিকের মঞ্চ খুব ছিমছাম কিন্তু অর্থপূর্ণ। মঞ্চের মাঝ বরাবর ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সাদা পর্দা ,কয়েকটা টুল, বুকসেল্ফ, আর মধ্য মঞ্চে একটি অনুচ্চবেদি। পর্দার উপরে বাঁকা কলমের ছবি এবং মঞ্চের বাঁদিকে বিশালাকার ঝুলন্ত হাত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শশাঙ্ক মন্ডলের আলো আঁধারের সুপ্রযুক্ত ব্যবহারে পিরানদেল্লোর মানসিক সংঘাত ও তৎকালীন অস্থির সময় ধরা পড়েছে। পুরো নাটক জুড়ে অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার এবং শেষ দৃশ্যে মঞ্চ জুড়ে উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি এক নতুন মাত্রা যোগ করে। নগেন দত্তের আবহে নৈঃশব্দের উপস্থিতি আরো একটু প্রয়োজন ছিল। কয়েক জায়গায় আবহের দীর্ঘস্থায়িত্ব সংলাপ শ্রবণে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। সময় বিশেষে শব্দহীনতাই শব্দের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

এ নাটক শুধুমাত্র কোনো ব্যক্তির আত্মজীবনী নয়, এ এক উত্তাল সয়য়ের দলিল চিত্র। ঘাড় ফিরিয়ে ইতিহাসকে দেখে, সমকালকে মিলিয়ে নেওয়ার নাটক। অনীকের প্রযোজনা তালিকায় আরো একটি উজ্জ্বল সংযোজন ‘পিরানদেল্লোও পাপেটিয়ার’। বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সকলেই যেখানে ‘নিরাপদ’ নাট্যচর্চায় ব্যস্ত, সেখানে এরকম একটি সাহসী এবং প্রয়োজনীয় প্রযোজনা দ‍র্শকদের উপহার দেবার জন্য নির্দেশক অরূপ রায় ও নাট্যদল অনীককে আন্তরিক অভিনন্দন।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us