থিয়েটার শাইনের নাটক ‘Nothing 2 Say’ অভিনীত হল গত ১০ই সেপ্টেম্বর তপন থিয়েটারের মঞ্চে। হলে ঢোকার আগে নাট্যদলের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট হাতে ধরিয়ে দিলেন একজন, পড়া হল। কারণ, তখনও শো শুরু হতে অনেকটা সময় ছিল। লিফলেটে ঘোষণা করা হয়েছে এই নাটক একটি উত্তর আধুনিক প্রতিপাদক, মানে postmodern performance এবং দলের পক্ষ থেকে অন্যত্র আরও বলা হয়েছে যে, এটি একটি non-verbal production. সে ‘postmodern’ বা ‘non-verbal’ কতটা তার শর্ত পূরণ করেছে তার বিচার করার কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। এপ্রসঙ্গে, Dr. Marry Klages (Department of English, University of Colorado) Postmodernism কে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলছেন, “Postmodern is a complicated term, or set of ideas. it’s hard to define, because it’s a concept that appears in a wide variety of disciplines or areas of study, including arts.” etc.
সে যাই হোক, নাটকে কি পাওয়া গেল সেটা নিয়ে কথা বলা যাক।
প্রায় দেড় ঘন্টার উপস্থাপনে একঝাঁক তরুণ প্রজন্ম (বোধ হয় ১৩ জন) মিলে গোটা স্পেসটাকে যেভাবে প্রাণবন্ত করে তুলল,তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল এই collective energy টাই থিয়েটারের দলগত অবস্থানের মূল চালিকাশক্তি। প্রত্যেক কলাকুশলী তাঁদের সেরাটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরেছে এবং তাতে কোনো ফাঁকিবাজি নেই। যতটুকু তাদের আয়ত্তে এসেছে ততটুকুই তারা শরীরের ভাষায় গল্পটাকে narrate করেছে।
Previous Kaahon Theatre Review:
মানব জন্মমুহূর্ত থেকে শুরু হয়ে শিক্ষা ও অন্তে ডিগ্রিলাভ এবং চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরার মাঝখানে জায়গা করে বন্ধুতা ও প্রেমের সংকেত। তারপর জীবন গড়ায় অংক কষে। আস্তে আস্তে জীবন ও চলন শুধুমাত্র ব্যক্তির চাওয়া পাওয়ার মধ্যে সীমিত থাকে না। সমাজনীতি,রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি প্রভাবিত করতে থাকে তাঁর জীবনকে। আরেক বহুধা বিন্যাসে ন্যস্ত হতে থাকে যাপন। এরই মধ্যে বন্ধুতাকে, বিশ্বাসকে, প্রেমকে সহিষ্ণুতাকে ভেঙে দেবার জন্য যাত্রাপালার বিবেকের মতো উদয় হয় এক চরিত্র বা এক আগ্রাসনের মেটাফর। চাহিদা ও যোগানের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে লড়িয়ে দেয় বন্ধুদের, ভাইদের বা ভালবাসাদের এবং রাষ্ট্রকে আরেক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। মানব চিরকেলে বেঁধে বেঁধে থাকার উদাহরণকে উপেক্ষা করে ওঠে। ব্যক্তির ক্রাইসিস ও রাষ্ট্রের ক্রাইসিসকে অভিন্ন রূপে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে এ নাটকে। চেষ্টাটা ভালো। কিন্তু, এখানেই প্রশ্ন উঠে আসছে। থিয়েটারে বিশেষ করে বাংলা থিয়েটারে কিছু নাটককার বা পরিচালকের এখনও এক উদ্ভট চিন্তা মাথায় ঘোরে, পৃথিবীর যাবতীয় ইস্যু একটি নাটকের মধ্যেই তুলে ধরা! তাঁদের কাজ দেখলে মনে হয়, এটাই তাঁদের শেষ নাট্য উপস্থাপন। এ নাটক দেখার পর তেমনি মনে হলো। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, এঙ্গেলস বলছেন যে,মানবসভ্যতায় ব্যক্তি পরিবার ও রাষ্ট্র একটি আরেকটির সাথে অঙ্গীভূত এবং বিজ্ঞানসম্মত সম্পর্কযুক্ত (সূত্র: the origin of the family, private property and the state, -Friedrich Engels)। কিন্তু নাট্য উপস্থাপনা শুধুমাত্র দর্শন আওড়ানোর জায়গা নয়। তা দর্শনের একটি নান্দনিক ও সুসংহত শৈল্পিক পরিবেশনের দাবি রাখে। এ নাটকে সেই দিকটা অবহেলিত। একটা নাটকে ব্যক্তি, সমাজ, শিক্ষার প্রকৃতি,প্রেম, হতাশা থেকে দেশভাগ ও শোষণ ইত্যাদি প্রভৃতি ঠুঁসে দেওয়া হয়েছে । এবং এ সবের পিছনে রয়েছে ‘সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন’এর হা-হুতাশ বামপন্থী মনোভাব। সবকিছুর পিছনে সাম্রাজ্যবাদের হাত দেখতে চাওয়ার অভ্যাস এত এত করে ব্যবহার হয়েছে যে সেটা এখন অজুহাতের নামান্তর। স্বাধীনতার ৭২ বছর পরও ঔপনিবেশিক বঞ্চনার তকমা বুকে পিঠে লাগিয়ে ঘোরা আসলে যে অক্ষমের বিলাপ, সেটা অনেকেই বুঝতে পারছেন না। যাই হোক, এসব নিয়ে ২২ লক্ষ শব্দ খরচ করা যায়। নাট্য আলোচনায় ফিরি।
এক নাটকে সব ইস্যু ধরার চেষ্টা নাটককে অকারণে দীর্ঘ করেছে। পরিচালক যে, সে একজন দক্ষ এডিটরও। এ নাটকে এক একটি দৃশ্য এত দীর্ঘ যে একঘেঁয়েমি লাগছিল। চাইলেই এডিট করে সুসংহত রূপ দেয়া যেত। কোন একটি কর্ম তখনই শিল্প হিসেবে আখ্যায়িত হয় যখন সেটি পরিমিত ও নন্দনতত্ত্ব অনুসারী হয়ে সুসংহত রূপ দেয়। পরিচালক তিনি যিনি মঞ্চে একটি চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার দৃশ্যে collective efforts গুলো এমনভাবে inner discipline দিয়ে বেঁধে পরিবেশন করেন যে তা একই সাথে বিশৃঙ্খল ও সংহত দৃশ্য হয়ে ওঠে। Text-এর visual narration সৃষ্টি করা দৃশ্য-নির্ভর শিল্পের অন্যতম শর্ত। এক্ষেত্রে এই নাটকের পরিচালক তা করে উঠতে পারলেন না। তাই non-verbal বলে যে gibberish স্টাইলটি তিনি প্রয়োগ করলেন তা পরিমিত মাত্রায় এডিট না করার কারণে দীর্ঘ ও ক্লান্তি সৃষ্টি করে। এ কথা হলপ করে বলতে পারি,এতগুলো তরতাজা উচ্ছ্বল তরুণদের এনার্জি লেভেল কে ঠিক মত চালনা ও এডিট করতে পারলে ফর্ম এর জায়গা থেকে এ নাটক অবশ্যই এসময়ে এক বিশেষ জায়গা করে নিতে পারত।
বাংলায় একটা চালু কথা আছে,”আমার পাঁঠা আমি ল্যাজে কাটব না মাথায় সেটা আমার ব্যাপার”; কিন্তু একজন দর্শক হিসেবে আমাদের যা যা মনে হল –
– 3:30 মিনিটে শুরু করার কথা বলে দেরিতে শুরু করা একটা চূড়ান্ত অপেশাদারি মনোভাব।
– নাটকটা মঞ্চে না করে অন্য যেকোনো জায়গায় করা যেত। এমনকি রাস্তায়ও। কারণ আলো এখানে আলাদা করে কোনো চরিত্র হয়ে উঠল না।
– দু-একবার মঞ্চ থেকে নেমে এসে যে সব দৃশ্য সৃষ্টির চেষ্টা করা হল তাতে আলাদা করে কিছু পাওয়া গেল না। Horizontal, Vertical বা Upper, Lower space এর ব্যবহার নিয়ে আরও নিরীক্ষণ প্রয়োজন তাহলে বোধহয় একটি জোরালো experimental নাটক হয়ে উঠতে পারত। নইলে এটা একটা কথার কথা বা তথাকথিত শ্লোগান হয়েই থাকবে। এ নাট্যে সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার যথেষ্ট অবকাশ আছে।
– ম্যাক্সিমাম প্রপস্ সাজেস্টিভ, কিন্তু হঠাৎ করে সত্যি সিগারেট ও কেকের উপস্থিতি, বেশ বেমানান।
– সাউন্ড অ্যাপ্লিকেশনে কিছু হিন্দি গানের ব্যবহার ও মঞ্চে দৃশ্য স্থাপন আলাদা মাত্রা তো যোগ করেইনি বরং অক্ষম অনুকরণের তা আরেক উত্তর-আধুনিক গিমিকের মতো লাগল।
– আলোর পরিকল্পনা একটু গোলানো, কোন বিশেষ মাত্রা তৈরী করে না।
– প্রথম থেকেই পোষাকের যে uniformity ছিল সেটার ওপর অন্য কিছু না চাপালেও চলত। কারণ,এ নাটকের চলনে পোষাকের খুব একটা ভূমিকা নেই।
-প্যান্টোমাইমের আদল ও জিবরিস ব্যবহার করার মানসিকতাকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু সমস্যা ঐ একটি জায়গায়- পরিমিতি বোধ ও সঠিক এডিটিং ।
– যেহেতু এটা নন্-ভারবাল,তাই কোরিওগ্রাফ এনাটকের মূলশক্তি। এই নাট্য আরেক দৃশ্যকাব্য হয়ে উঠতে পারত যদি আরেকটু সময় দিয়ে, আরও নিবিড় অনুশীলনে গোটা টিমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত।
তবুও বলব, এতগুলো টাটকা প্রাণের নাটকের প্রতি প্রেম, ডেডিকেশান ও নিষ্ঠা এবং এসি হলের মধ্যেও অবিরাম ঘাম ঝরানোর দুর্নিবার উদ্দীপনাকে স্যালুট জানাতেই হবে। তাই রামপ্রসাদ বলেন, “এমন মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা”। থিয়েটার শাইন দলে এমন সোনা ফলানো জমিন প্রচুর,দরকার একটু আবাদের, তাহলেই ‘শাইন’ করবে থিয়েটার ।