নির্ভয়া – ব্রেশট আবার, কিছুটা অন্যরকমভাবে

Posted by Kaahon Desk On October 22, 2017

গত পঁচিশ বছর ধরে কাজ করে যাওয়া স্বপ্নসন্ধানী বাংলা নাট্যজগতে দল হিসেবে এতটাই বিশিষ্ট জায়গা তৈরী করে নিয়েছে যে তারা যখন বেরটোল্ট ব্রেশটের মাদার কারেজ  নাটক নিয়ে কাজ করতে যায়, তা আমাদের মধ্যে একটি বিশেষ প্রত্যাশা তৈরী করে। প্রত্যাশা এটাই যে ২০১৭ সালে এসে স্বপ্নসন্ধানী ব্রেশটকে কিছুটা হলেও অন্যরকমভাবে হাজির করবে দর্শকদের কাছে, কারণ এই সময় দাবী করে টেস্কটের অন্যতর পাঠ। তবে আশঙ্কাও থাকে, যে ব্রেশটের সেরা নাটক বলে চিহ্নিত এই নাটকটির মঞ্চায়ন মোটেই সহজ নয়, যা এই নাটকের বিশ্বব্যাপী মঞ্চায়ন-ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যায়। তবে নির্ভয়া নাম দিয়ে যে প্রযোজনা স্বপ্নসন্ধানী প্রস্তুত করল তা প্রত্যাশাপূরণ ও আশঙ্কা নিরসন করতে মোটের ওপর সফল।

Previous Kaahon Theatre Review:

রতন কুমার দাসের লেখা নির্ভয়া  নাটকটি অনুবাদ ও অভিযোজনের মাঝামাঝি অবস্থান করে – মূল নাটকের বেশির ভাগ উপাদান এখানে অক্ষুণ্ণ, তবে নতুন কিছু উপাদানও উপস্থিত। সবচেয়ে নজরকাড়া এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ব্রেশট (কৌশিক সেন) ও তার সঙ্গিনী রুথ বেরলউ-র (দেবাঞ্জলি দাস) নাটকে চরিত্র হিসেবে প্রবেশ। এর ফলে ব্রেশটীয় এলিয়েনেশনের সাথে সাথে নাটক লাভ করে উত্তরআধুনিক সেল্ফরিফ্লেক্সিভিটি এবং সুযোগ তৈরী হয় ব্রেশটকে ইতিহাসের চরিত্র হিসেবে নিরীক্ষণ করার। সেই নিরীক্ষণ কিছুটা হয় কারণ কৌশিক ও দেবাঞ্জলি ব্রেশট ও রুথ হওয়ার পাশাপাশি পর্যবেক্ষকের মত করে মূলত ব্রেশটকে নিয়ে কিছু আলোচনা, কিছু তির্যক মন্তব্য করেন। ১৯৪৭ সালে ব্রেশটের House Committee on Un-American Activities-এর সামনে হাজিরা দিয়ে পরের দিনই আমেরিকা থেকে পলায়ন করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জীবন ও শিল্পের বিভাজনরেখা মুছে কিছুটা যেন একসূত্রে গাঁথা হয়ে যায় ব্রেশটের সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি ও নাটকের মূল চরিত্র নির্ভয়ার বেঁচে থাকার জন্য ছল, চাতুরী, কপটতার মত নানা পন্থা অবলম্বন করা। তবে রুথকে মঞ্চে নিয়ে এসেও ব্রেশটের জীবনে ও কাজে নারীর সমস্যাকীর্ণ অবস্থান নিয়ে একদম নীরব থেকে যাওয়া মানে হল পারফরম্যান্সের মাধ্যমে বিষয়গুলির নারীবাদী পুনঃপাঠের (যা নিয়ে একাডেমিয়ায় বিস্তর গবেষণা, চর্চা হয়ে গেছে) একটা সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা। মূল নাটক থেকে সরে আসা এখানেও যে নির্ভয়া- পটভূমি কাশ্মীর, কিন্তু নির্ভয়া চরিত্রটি এমনভাবে ছেয়ে থাকে সারা নাটক জুড়ে যে কাশ্মীর ও তার সমস্যা চাপা পড়ে যায়, কেবলমাত্র একটি দুটি রেফারেন্স হিসেবে জেগে থাকা ছাড়া। আর যে যুদ্ধ আমরা পাই, তা নির্দিষ্টভাবে কাশ্মীরে চলা যুদ্ধ না হয়ে অন্য যে কোন জায়গার যুদ্ধ হিসেবেই প্রতিভাত হয়।

নির্দেশক কৌশিক সেন সচেতনভাবে নির্ভয়া  নাটকটিকে সাজিয়েছেন গান দিয়ে, মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে, চাকা লাগানো ধাতব ফ্রেমে ব্রেশট ও রুথের ছবি ব্যবহার করে, ব্রেশটের অন্য নাটকের বিখ্যাত সংলাপ এই নাটকে ব্যবহার করে। নানাভাবে এলিয়েনেশনের ভাব তৈরী করে নাট্যকে ব্রেশটিয় এপিক থিয়েটারে পরিণত করার প্রয়াস খুবই লক্ষণীয়। তার এই প্রয়াস যে বহুলাংশে সফল তা বোঝা যায় দর্শকরা যেভাবে নাট্যটি গ্রহণ করছেন তার দিকে নজর করলে। খেয়াল করেছি, খুব মনোযোগী দর্শকও আবেগমথিত হয়ে নাট্যের চরিত্রদের সাথে একাত্ম হয়ে পড়ছিলেন না – বরং বলা ভালো সে সুযোগ তাদের নির্দেশক দেন নি। মঞ্চ পরিকল্পনা (সঞ্চয়ন ঘোষ) ও নির্মাণ (মদন শর্মা ও বিকাশ দাস) বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে – নির্ভয়ার মালপত্রে ঠাসা ঠেলাগাড়িটা তার প্রকান্ড আয়তনে ও স্লথ চালে জীবন ও জীবনযন্ত্রণার মঞ্চজোড়া প্রতীক হয়ে থাকে। সুদীপ সান্যালের আলো (প্রেক্ষাপণে সুমিত চক্রবর্তী), গৌতম ঘোষের আবহ (প্রেক্ষাপণে জয়ন্ত পাল), সাবর্ণি দাসের পোশাক (বানিয়েছেন মহম্মদ জাকির হুসেন) এবং মহম্মদ আলির রূপসজ্জা (সরকারী শেখর অধিকারী এবং ভুলু ওয়াহিদ) নাট্যের দাবী মেটাতে সক্ষম হয়েছে।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে যারা অপেক্ষাকৃত কম মঞ্চ সময়ের ও কম সংলাপ বলার চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তাদের নিজেদের কাজের প্রতি আরো দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে। বেশ কিছু সময়েই দেখা গেছে মঞ্চে ভিড়ের মধ্যে একজন দু’জন বাকিদের সাথে তাল রাখছেন না – এটা শুধু দৃষ্টিকটু নয়, এটা গোটা দৃশ্যকল্পের ক্ষতি করে। যে দৃশ্যে আলিফকে গ্রেফতার করা হয়, একজন গ্রেফতারকারী এতটাই অন্যমনস্ক থাকেন যে আলিফ প্রায় নিজেকে নিজেই গ্রেফতার করাতে বাধ্য হন। অভিনেতাদের মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় যাদের কথা তারা হচ্ছেন অশোক ঘোষ (রাঁধুনি), নবনীতা বসু মজুমদার (ইমন) এবং সৌম্য মজুমদার (পুরোহিত)। এরা প্রত্যেকেই তাদের চরিত্রদের বিশেষ একেকটি বৈশিষ্টকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের চরিত্র নির্মাণ করেছেন (যেমন রাঁধুনির অশিষ্ট অসূয়া বা ইমনের স্থূল শারীরিকতা), যা ব্রেশটিয় নাটকে খাটে ভালো। মোনালিসা পালের কাজটা ছিল বেশ শক্ত, কারণ কাতুর ভূমিকায় শুধু একজন মূক অথচ খুব সংবেদনশীল কিশোরীকে ফুটিয়ে তোলাই নয়, যৌনতাবোধ জন্মানোর মধ্যে দিয়ে সেই কিশোরীর যুবতী হওয়া এবং নাটকের শেষে নিজের বলিদানে অনেকের প্রাণ বাঁচানোর মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে যাওয়াটাও প্রস্তুত করার দায়িত্ব তার ছিল। তিনি এই অত্যন্ত গুরু দায়িত্বের সবটাই পালন করতে পেরেছেন এমনটা বলা যাচ্ছে না, তবে সারা নাটক জুড়ে তিনি যেভাবে তার চরিত্রে প্রবিষ্ট ছিলেন তা প্রশংসনীয়। রুথের ভূমিকায় দেবাঞ্জলি সাবলীল, যেমন সাবলীল তাদের চরিত্রে শঙ্কর মালাকার (আলিফ), আলি আক্রাম পারভেজ (চায়না), রবীন্দ্রনাথ জানা (সেনানায়ক)। কৌশিক সেনের অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই; দক্ষ শিল্পী যেমন কয়েকটা আঁচড়ে একটা ছবি এঁকে দেন, খুব স্বল্প করেও তিনি তার ব্রেশটকে জীবন্ত করেছেন। যদিও স্বল্পই করেছেন, কৌশিক তার করাটা স্থাপন করেছেন বহু দশকের অভিজ্ঞতার আর সহজাত অভিনয় ক্ষমতার শক্ত ভিতে। তবে এই নাটক যিনি নিজের কাঁধে বয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, অনেকটা তার ঠেলাগাড়ির মত, তিনি নাম ভূমিকায় রেশমি সেন। কখনো সাহসী ব্যবসায়ী, কখনো ভীত মা, কখনো বা পুরুষদের ব্যবহার করা কৌশলী মহিলা – রেশমি তার শরীরে ও মনে এই চরিত্রের জটিল বহুস্তর ধারণ করে অতি যত্নে নির্ভয়ার চরিত্র নির্মাণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে তার হাঁটাচলার গতি ও ভঙ্গি হেরফের করে, নিপুণতার সাথে কখনো ক্ষনিকের স্তব্ধতা কখনো চটজলদি হাজিরজবাব ব্যবহার করে, অন্য চরিত্রদের সংলাপ শুনে সেই মুহূর্তে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার বিশ্বাসযোগ্য illusion তৈরী করে রেশমি একটি অবিস্মরণীয় নির্ভয়া/মাদার কারেজ উপস্থাপনা করেছেন। একটা ভয় থাকে, শেষে এসে এই চরিত্রটিকে ভালোবেসে একধরণের ট্র্যাজিক হিরোইনের স্তরে উন্নীত না করে দেওয়া হয় ও গোটা ব্রেশটিয় রাজনীতিই নস্যাৎ হয়ে যায়। সে পথে নির্দেশক রেশমিকে যে নিয়ে যাননি তা অভিনন্দনযোগ্য। তাই শেষ দৃশ্যে যখন মেয়ের শেষকৃত্যের জন্য টাকা দিয়ে তারপর কি মনে করে সেখান থেকে একটু টাকা আবার নিজের জন্য ফেরত নিয়ে নির্ভয়া টানতে শুরু করে তার গাড়ি, আমরা পাই ব্রেশটিয় কল্পনার একজন সাধারণ মানুষকে যে মোটেও হিরোইন নয়, বরং যুদ্ধের বাজারে মুনাফা করতে যাওয়া একজন দারুণভাবে পরাজিত মানুষ, যে থামতে জানে না, যার থামার উপায় নেই।

নির্ভয়া  নামটি নিয়ে আমার একটু আপত্তি আছে। আপত্তির কারণ এটাই যে নির্ভয়া নামের মধ্যে দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে একটা বীভৎস ঘটনার স্মৃতি উস্কে দেওয়া ছাড়া এই নাটক কোনভাবেই সেই ঘটনাকে নিজের পরিধির মধ্যে ঢোকাতে পারে না, সম্ভাবনা থাকা স্বত্ত্বেও। চাই বা না চাই, নির্ভয়া নামটি এখন আরেকটি যুদ্ধের সূচক হয়ে গেছে যে যুদ্ধ আমাদের দেশের মেয়েরা নিরন্তর লড়ে যাচ্ছেন। কোন টেক্সট যখন এই নামটি উচ্চারণ করে, সেই টেক্সটের ওপর দায় বর্তে যায় কেবল একটি অনাবশ্যক ইশারা হিসেবে নামটি ব্যবহার না করে সরাসরি সেই যুদ্ধের ময়দানে ঢুকে পড়ারযা এই নাটক করে না।

Dipankar Sen
A student of theatre as an art practice, he is definitely a slow (but hopefully, steady) learner. He is a father, a husband and a teacher of English literature in the West Bengal Education Service. His other interests include literature in translation and detective fiction.

 

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us