‘নয়ে নাটুয়া’ তাদের সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা ‘মাটির গাড়ি মৃচ্ছকটিক’ পরিবেশন করলেন আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস মঞ্চে গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি। মূল সংস্কৃত নাটক ‘মৃচ্ছকটিক’, রচয়িতা শূদ্রক। বাংলা রূপান্তর, সম্পাদনা, সঙ্গীত, ও নির্দেশনা গৌতম হালদার।
নাটকটির বিষয়বস্তু, চরিত্রচিত্রন ও নাট্য বিন্যাসের মধ্যে একটি চিরকালীন আবেদন আছে তাই জন্য এটি বহু দেশে বিশেষ করে পাশ্চাত্য দেশে বহু ভাষায় বারবার অনুদিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে জনপ্রিয়তার সাথে। বাংলাতেও ইতিপূর্বে একাধিক প্রযোজনা হয়েছে তারমধ্যে বহুরূপী ও সমীক্ষণের প্রযোজনা দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৪ সালে গিরিশ কারনাড় পরিচালিত হিন্দি চলচ্চিত্র রূপটিও (Utsav) বেশ প্রশংসিত ও জনপ্রিয় হয়েছিল।
Previous Kaahon Theatre Review:
নাটকের নায়ক চারুদত্ত উজ্জ্বয়িনীর একজন বিত্তশালী বণিক। কিন্তু তার মহানুভবতা ও দানশীলতার জন্য সমস্ত সম্পত্তি দান করে বর্তমানে সে দারিদ্রের মধ্যে দিনযাপন করছে। চারুদত্তের স্বভাব ও সদগুণের কারণে নগরবাসীর কাছে সে বিশেষ প্রিয় পাত্র ছিল। নগরীর সুন্দরী গণিকা বসন্তসেনাও তার কাহিনী শুনে তাকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তার প্রতি আকৃষ্টও ছিলেন। অন্যদিকে দেশের দুষ্ট ও অত্যাচারী রাজা পালকের শ্যালক সংস্থানক নটী বসন্তসেনাকে পেতে চায় তার যৌনকামনা পূরণের জন্য। কিন্তু গণিকা হওয়া সত্বেও সংস্থানকের কাছে সে নিজেকে সমর্পণ করতে নারাজ। সংস্থানক সর্বদা বসন্তসেনাকে নিজের দখলে আনার জন্য নানা কৌশল করতে থাকে। একদিন সংস্থানকের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে বসন্তসেনা চারুদত্তের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাড়ি ফেরার সময় নিজের বহুমূল্য অলংকারগুলি চারুদত্তের কাছে গচ্ছিত রেখে যান। শার্বিলক নামক একজন চোর বসন্তসেনার প্রধানা দাসী মদনিকাকে দাসত্ব থেকে উদ্ধার করবার জন্য চারুদত্তের বাড়ি থেকে গচ্ছিত অলংকার গুলি চুরি করে। কিন্তু ঘটনাক্রমে সেগুলি আবার বসন্তসেনার হাতে এসে পৌঁছয়। চারুদত্তের শিশুপুত্র রোহসেন এক প্রতিবেশী পুত্রের সোনার খেলনা গাড়ি দেখে সেও সোনার গাড়ির জন্য বায়না ধরে কিন্তু সোনার গাড়ি কেনার ক্ষমতা না থাকায় তাকে মাটির খেলনা গাড়ি দেওয়া হয়। তাতে রোহসেনের মন ওঠে না সে কাঁদতে থাকে। বসন্তসেনা একথা জানতে পেরে ভীষণ কষ্ট পায় এবং সোনার গাড়ি তৈরির জন্য সমস্ত অলংকার খুলে মাটির খেলনা গাড়িটি সাজিয়ে দেয়। বসন্তসেনার এই স্নেহপ্রবণতা ও উদার মানসিকতা চারুদত্তকে স্পর্শ করে এবং তারা পরষ্পরের প্রতি আরো আকৃষ্ট হয়ে ওঠে। সংস্থানক জানতে পারে বসন্তসেনা চারুদত্তের প্রতি অনুরক্ত। সুতরাং পথের কাঁটা চারুদত্তকে সরাতে না পারলে বসন্তসেনাকে সে পাবে না।বহুবার চেষ্টা করেও যখন তাকে বাগে পেল না তখন সে কন্ঠরোধ করে বসন্তসেনাকে মেরে ফেলতে চাইল। সে মারা গেছে মনে করে হত্যার মিথ্যা অভিযোগ চারুদত্তের উপর আরোপ করা হয় এবং মিথ্যা মামলা সাজানো হয়। বিচারে চারুদত্তের প্রাণদন্ডের আদেশ হয়। সেই দন্ড কার্যকর করবার জন্য যখন তার শিরোচ্ছেদ করতে উদ্যত হয় তখন হঠাৎ করেই বসন্তসেনা সেখানে উপস্থিত হয়। সে প্রকৃত অপরাধীর কথা জানালে চারুদত্ত প্রাণদন্ড থেকে মুক্তি পায়। ইতিমধ্যে দুষ্ট রাজা পালককে পরাজিত ও নিহত করে আর্যক নতুন রাজা হন। তার আদেশে চারুদত্ত ও বসন্তসেনার বিবাহ স্থির হয়। এভাবে বসন্তসেনা গণিকা থেকে বধূর মর্যাদা লাভ করে। চারুদত্ত তার স্বভাবগুণে অপরাধী সংস্থানককে তার শাস্তি থেকে মুক্তি দেয়।
এ নাটকের কাহিনী থেকে বোঝা যায় শূদ্রক প্রাচীন সংস্কৃত নাটকের গতানুগতিকতার থেকে বেরিয়ে এসে একটি বাস্তবধর্মী সামাজিক নাটক রচনা করেছিলেন। সাধারণ মানুষের জীবন ও সমাজের বাস্তবতা উপস্থাপনে শূদ্রক বিশেষ দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। তৎকালীন সমাজের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঠিক চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে এ নাটকে। সমাজে তখন ধনী ও দরিদ্রের শ্রেণীবৈষম্য ছিল ভীষণভাবে। নগরে সুখে ও স্বাচ্ছন্দে দিন কাটাত ধনী বিলাসী ভোগী সম্প্রদায়। ক্ষমতাশালীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশেষ সুবিধা ভোগ করত। অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও শেষে তাকে সরিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে আর্যকের সিংহাসনে আরোহণের অর্থ হল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের চেষ্টায় রাষ্ট্রবিপ্লবের মাধ্যমে অন্যায় রাষ্ট্রক্ষমতার অবসান ঘটিয়ে এক সৎ ও বীর রাষ্ট্রনায়কের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা! তৎকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্তমান সময়ের সাথে ভীষণ সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
নির্দেশক গৌতম হালদার নাটকটিকে লোক আঙ্গিকে (folk style) পরিবেশন করেছেন। অভিনেতা, অভিনেত্রী, গায়ক, বাদক সবাই একই সাথে মঞ্চে অবস্থান করে। এধরনের ফর্মে এবং বহু চরিত্র সম্বলিত এরকম নাটকে একজন অভিনেতাকে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। সামান্য পোষাক বা সহযোগী উপাদানের পরিবর্তন করে এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে সহজে যাতায়াত করে তাতে দর্শকদের বিশ্বাসযোগ্যতায় কোনো অসুবিধা হয় না। মঞ্চ প্রায় নিরাভরণ, দুপাশে দুটি গোল বেদী এবং মাঝখানে তিন ধাপে উচ্চ একটি বেদী। নাটকের দৃশ্যাবলী যেমন গাছপালা, প্রাচীর, ইত্যাদি সবকিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী দ্বারা তৈরী হয়। নৃত্য পরিকল্পনা বা কোরিওগ্রাফি সুন্দর। Classical নৃত্য ছাড়াও অন্যান্য নৃত্য পরিকল্পনা বিশেষ করে গরুর গাড়ি চলার দৃশ্য দুটি বুদ্ধিদৃপ্ত ভাবনার পরিচায়ক।
অভিনয়ের কথা বলতে গেলে প্রথমে বলা দরকার নাটকটিতে নানা চরিত্রের মুখে নানা আঞ্চলিক উচ্চারণ শোনা যায়। নাটকটি মূলত হাস্যরসকেই ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়েছে, ফলে চারুদত্ত ও বসন্তসেনা ছাড়া প্রায় সবকটি চরিত্রকেই কৌতুক অভিনয় করতে দেখা যায়। তবে সবার অভিনয় যে সমমানের তা নয়, এরমধ্যে শান্তনু ঘোষের মৈত্রেয় বেশ ভালো লাগে। সংস্থানক চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হলো তার অসংলগ্ন উক্তি, অত্যধিক ঘৃণ্য কাম এবং ধ্বংসের মধ্যে আনন্দ পাওয়া। এই চরিত্রটিকে তার সকল বৈশিষ্ট্য সমণ্বয়ে গৌতম হালদার চমৎকারভাবে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে তার অভিনয় অত্যন্ত চটুল ও ভাঁড়ামো মনে হলেও আসলে এই চরিত্রের লাম্পট্য, নিষ্ঠুরতা, শঠতা, নীচতা প্রভৃতি এই ধরনের অভিনয়ের মাধ্যমেই সঠিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। চরিত্রটির প্রতি দর্শকদের এক ধরনের রাগ ও বিরক্তির উদ্রেক হয়, এবং তারমধ্যে থেকেই হাস্যরস উদ্ভূত হয়। সংস্থানকের উচ্চারণে তালব্য শ এর আকারের আধিক্য থাকায় তাকে শকার বলা হয় – অভিনয়ের মধ্যে সেটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তবে তার সংলাপে কয়েকটি ইংরেজি শব্দের সচেতন প্রয়োগ বেমানান ও বিস্ময় জাগায়।
বসন্তসেনার ভূমিকায় দ্যুতি ঘোষ হালদার নাচ, গান, ও অভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রটিকে প্রাণবন্ত করে রাখে। চারুদত্তের চরিত্রে নীরজ কুমার মন্ডল খুবই সাদামাটা। নাটকের লাইভ মিউজিক খুব প্রাণবন্ত যা নাটকের গতিকে সচল রাখে। গৌতম হালদারের কন্ঠে গীত গানগুলি বরাবরের মতই বেশ সুন্দর লাগে যা নাট্য প্রযোজনাকে সমৃদ্ধ করে। পোশাক পরিকল্পনার (দ্যুতি ঘোষ হালদার) ক্ষেত্রে পুরুষদের পোষাক সময়কে সুন্দরভাবে চিহ্নিত করতে পারে তবে মহিলাদের পোষাকের ক্ষেত্রে আরেকটু ভাবনার অবকাশ থেকে যায়। আলো (দেবাশিষ চক্রবর্তী) নাটককে চলার পথে সঠিক ও সুচারুভাবে সংগত করেছে। দুই চন্ডালের (সৈনিক) মাথায় আধুনিক হেলমেট দেখে সংস্থানকের মুখে ইংরাজি শব্দের ব্যবহারের মতই বিস্ময় লাগে। আরেকটি কথা, রোহসেনকে পুতুলের মাধ্যমে উপস্থিত করে নেপথ্যে তার সংলাপ বলার ব্যাপারটা মন্দ লাগে না তবে প্রশ্ন হল যে শিশুশিল্পীর অভাব বা তাকে দিয়ে অভিনয় করানোর পরিশ্রম থেকে বিরত থাকার জন্যই কি এই পদ্ধতির ব্যবহার?
নাটকটির মধ্যে আমরা দেখতে পাই শুভ ও অশুভের দ্বন্দ্ব। নানা ঘটনা পরম্পরার মধ্যে দিয়ে শেষে শুভ শক্তির কাছে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটে, এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হয়। নাটকে আমরা অসংখ্য সাধারণ ও জীবন্ত চরিত্রের সমাবেশ দেখতে পাই ফলে নাটকটির মধ্যে একটি চিরন্তন ও সর্বকালীন আবেদন লক্ষ্য করা যায়। এরমধ্যে একটি বাস্তবধর্মী বৈশিষ্ট্য আছে যা সমকালেও সমানভাবে প্রযোজ্য, ফলে অতি প্রাচীন এই নাটকটির বর্তমানে উপস্থাপনা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক এব্যাপারে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই।