‘কথাকৃতি’ গোষ্ঠীর প্রযোজনায় বাংলা নাটক ‘নয়ন কবিরের পালা’-র প্রথম মঞ্চায়ন হল কলকাতার মিনার্ভা থিয়েটার রঙ্গমঞ্চে, ৯ই মার্চ, ২০১৯, তারিখে। নভেন্দু সেনের লেখা এই নাটকটি পরিচালনা করেছেন সঞ্জীব রায়।
‘নয়ন কবিরের পালা’ নাটকটির একটি বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিত আছে। নাটকটি বাংলা ভাষায় The Theatre of the Absurd বা ‘অ্যাবসার্ড নাট্য ধারা’র একটা প্রামাণ্য প্রয়োগ বলে ধরে নেওয়া হয়। মানুষের জীবনে অন্তর্গ্রথিত যুক্তিহীন অবিন্যস্ততা, ভাবহীন ও অর্থহীন অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তিকে উপজীব্য করে পঞ্চাশের দশকে প্যারিসে বসবাসকারী কয়েকজন নাট্যকার কিছু নাটক লেখেন (যথাঃস্যামুয়েল বেকেট, ইউজিন ইয়োনেস্কো, আর্থার আদামভ, জাঁ জেনে), দৃষ্টিভঙ্গির সাযুজ্যর কারণে তাদের কাজগুলিকে একত্রে একটি বিশেষ নাট্যরীতির অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করা হয় এবং ‘অ্যাবসার্ড থিয়েটার’ বলে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীকালে এই নাট্যধারা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে (উল্লেখযোগ্য অবদান-হ্যারল্ড পিন্টার)। এমনকি বাংলা নাট্যজগতেও সেই তরঙ্গ অনুভূত হয়, আর তারই প্রভাবে নভেন্দু সেন ১৯৬৮ সালে রচনা করেন এই নাটক, ‘নয়ন কবিরের পালা’।
Previous Kaahon Theatre Review:
এই নাটকটির মধ্যে অ্যাবসার্ড নাটকের সমস্ত বিশেষত্বই পুরোমাত্রায় বর্তমান, উপরন্তু নাটকটির মধ্যে দেশীয় রোমান্টিক চেতনাও উপস্থিত। নয়ন ও কবির দুই অসমবয়স্ক নাট্যাভিনেতা, কিন্তু দর্শকরুচির পরিবর্তনের কারণে তাদের অভিনয়শৈলী এখন ব্রাত্য। তারা দর্শকদের সামনে একটা নাটক গড়ে তোলার চেষ্টা করে, এবং যেহেতু তাদের জীবনে কোন ‘বলার মতো ঘটনা’ নেই, তাই তারা চেষ্টা করে নয়নের দেখা একটা দুঃস্বপ্নকেই নাটকের আকারে প্রকাশ করতে। সেই স্বপ্নে নয়নের সঙ্গে দেখা করতে আসে এক ব্যক্তি, আর অদ্ভুত সমস্ত যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে থাকে যে সেই নয়নের পিতা। নাটকের অগ্রগতি নিয়ে নয়ন ও কবিরের মধ্যে মতান্তর হয় এবং বারে বারে একই দৃশ্যের পুনরাভিনয় হতে থাকে। তারা একমত হয় যে নাটকের শেষ দৃশ্যে চিরাচরিত নাটক শৈলী অনুযায়ী হত্যা ও তদ্জনিত অনুতাপ থাকবে। কিন্তু কে কাকে হত্যা করবে সেই নিয়েও মতান্তর হয়, এবং ঐ শেষ দৃশ্যটিও একাধিকবার অভিনীত হয়। শেষে একটা নাটকও ঠিক করে গড়ে তুলতে না পারার গ্লানি ও হতাশা নিয়ে তারা মঞ্চ ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
‘নয়ন কবিরের পালা’ নাটকটির কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের অ্যাবসার্ড থিয়েটারের প্রকরণ পদ্ধতির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর ধ্বংস, হতাশা, ও অবক্ষয়ের পরিমণ্ডলে অ্যাবসার্ড থিয়েটারের জন্ম। Existentialism বা অস্তিত্ববাদী দর্শনের কাছে ঋণী হলেও, অ্যাবসার্ড থিয়েটারের মূলসূত্রটি কিন্তু নিহিত ছিল ১৯৪২ সালে প্রকাশিত আলবেয়ার কাম্যুর The Myth of Sisyphus গ্রন্থে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং অযৌক্তিক, অসঙ্গত, ও অসম্ভব ঘটনাবলীর ঘেরাটোপে বন্দী, গ্রীক পৌরাণিক চরিত্র সিসিফাসের ঠেলে তোলা প্রস্তরখণ্ডের মতোই অর্থহীন পৌণপুনিকতায় আবদ্ধ। এই নাট্যকারেরা মনে করেন, যেই অস্থির সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মানুষ পরস্পরের থেকে বিযুক্ত, ভাষা মানসিক সংযোগ সাধনে ব্যর্থ, যুক্তিকে মনে হয় অবোধ্য প্রলাপ মাত্র, সেই পরিমণ্ডলে জীবনের সত্যস্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য চিরাচরিত বর্ণনামূলক প্রথার নাটকের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। তাই তারা নাট্যশিল্প সম্পর্কিত যাবতীয় প্রচলিত পূর্বশর্ত ও নিয়মশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে গিয়ে, নাটকের বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক উভয়ক্ষেত্রেই, সম্পূর্ণ নতুন পথে হাঁটতে চেয়েছেন। প্রচলিত নিয়মে লিখিত ভালো নাটকে থাকে সুগঠিত কাহিনী, সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত বিষয়বস্তুর পরিকল্পিত বিন্যাস, বুদ্ধিদীপ্ত ও জোরালো সংলাপ, এবং সূক্ষ্ম চরিত্রায়ন; এর বিপরীতে অ্যাবসার্ড নাটকে প্রায় কোনও গল্পই থাকে না, কোনও সুস্পষ্ট আদি, মধ্য, অন্ত থাকে না, অস্ফুট, অসংলগ্ন সংলাপ কখনো কখনো পুনরাবৃত্ত হতে থাকে, আর চরিত্রায়ন হয় যান্ত্রিক। ভালো নাটক যদি হয় সমাজের দর্পণ, অ্যাবসার্ড নাটকে দেখা যায় আতঙ্ক ও দুঃস্বপ্নের প্রতিফলন।
এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমরা যখন ‘নয়ন কবিরের পালা’ নাটকটি দেখি, তখন এর লঘু, হাস্যরসাত্মক ও আপাত সঙ্গতিহীন বহিরাঙ্গের অন্তর্নিহিত ভাবনাগুলি আমাদের কাছে পরিস্ফুট হতে থাকে। নাটকটি একটি সার্কাসের পটভূমিতে অভিনীত হয়, নয়ন এবং কবির সেখানে ক্লাউনের সাজে সজ্জিত। তারা আবেগ তাড়িত ও ভঙ্গুর মানুষ, উপেক্ষিত ও নিঃসঙ্গ, তাদের জীবন বেদনা বিধুর, অকিঞ্চিৎকর, ও পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন। রঞ্জিত মুখাবয়ব তাদের ভিন্নতাকেও আড়াল করে দেয়, আর তাদের আত্মপরিচয়ের সংকটটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তাদের দুঃস্বপ্নের নাটকটিতে, কবিরকে নয়নের ভূমিকায়, আর নয়নকে আগন্তুকের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যায়। তাদের ঐ নাটকে ধরা পড়ে অসার যুক্তির বিজয়ঘোষ আর অর্থহীন কর্মের পুনরাবৃত্তি! নাটক-বহির্ভূত কথোপকথনেও উঠে আসে নৈরাশ্য ও শূণ্যতার বোধ, সান্ত্বনাহীন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রার সংকেত। অন্যদিকে আঙ্গিকগত ভাবেও প্রচলিত ধারার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে, নাটকের মাঝেই একবার পর্দা পড়ে যায়, মঞ্চ সজ্জা ও আলোক সম্পাতের দায়িত্বে থাকা কলাকুশলীরা মঞ্চে উঠে আসেন।
নির্দেশক সঞ্জীব রায় ১৯৬৮ সালের নাটকটিকে মঞ্চে তুলে এনেছেন প্রায় অবিকৃতভাবেই, জোর করে সমসাময়িকতা আরোপ করতে চাননি। এমনিতেই মূলনাটকে সময়ের প্রসঙ্গ আসে পরোক্ষভাবে, ‘গেল যুদ্ধ’ আর বর্মায় বসবাসের উল্লেখে এবং নাটকে স্বতন্ত্র বিদূষক চরিত্রের প্রয়োগ প্রসঙ্গে। বস্তুত, অ্যাবসার্ড নাটক একটা অস্পষ্ট পরিমণ্ডল বা অন্তর্বিশ্ব নির্মাণ করে, যেখানে স্থান-কাল সঠিক সংজ্ঞায়িত হয় না। নাটকের মঞ্চ ও পোশাক ভাবনা স্বয়ং পরিচালকের, সার্কাসের পরিবেশটি তিনি বেশ বর্ণময় করে তৈরি করেছেন, অ্যাবসার্ডিটির ব্যাঞ্জনা হিসাবে ব্যবহার করেছেন ছুরিকালাঞ্ছিত একটি খাড়া ক্রুশ-সদৃশ বস্তুকে। আলোক ভাবনায় সাধন পাড়ুই আলো আঁধারির জগৎটিকে যত্ন সহকারে নির্মাণ করেছেন, তবে কখনো কখনো তিনি চিরাচরিত নাট্যরীতিই অনুসরণ করে ফেলেন, যেমন নয়নের ‘ছাগল ঢুকল বাগানে’ অংশে ক্রমান্বয়ে তিনটি আলোর স্পট ব্যবহার বড়ই পরিশীলিত। দেবরাজ ভট্টাচার্য-এর সঙ্গীত ভাবনাও পরিপূরক হিসাবে যথার্থ কাজ করে গেছে। মঞ্চ জুড়ে দাপিয়ে অভিনয় করেছেন নয়নের চরিত্রে দেবরাজ ভট্টাচার্য্য এবং কবিরের চরিত্রে প্রসেনজিৎ বর্ধন। তাদের সক্রিয় কর্মচাঞ্চল্যে এমন একটি কাহিনী বর্জিত, তাত্ত্বিক নাটকও দর্শক-উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আর সেখানেই থেকে যায় নাটকের একটি বিরুদ্ধ সমালোচনার জায়গা। তাদের ঐ প্রচণ্ড তৎপরতার আড়ালে কিছুটা হলেও ঢাকা পড়ে যায় চরিত্রের হতাশা ও শূণ্যতা বোধ। আর তাই হয়ত কিছু দর্শকের কাছে নাটকটি শুধুমাত্র ‘ভালো অভিনয় সর্বস্ব কৌতুকনাট্য’ হিসাবে প্রতিভাত হয়। বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়ার অনুরোধ রইল।
‘নয়ন কবিরের পালা’ নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয় ঠিক পঞ্চাশ বছর পূর্বে, ১৯৬৯ সালে, ‘নক্ষত্র’ নাট্য গোষ্ঠীর প্রয়াত শ্যামল ঘোষের হাত ধরে। ‘কথাকৃতি’ গোষ্ঠীকে অসংখ্য ধন্যবাদ নাটকটিকে এই সময়ের দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। সম্প্রতি নাট্যকার নভেন্দু সেনকে নিয়ে বাংলা নাট্যজগতে নতুন উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাঁর লেখা অন্যান্য নাটকগুলিও সামনে আসবে বলে আশা করা যায়। অ্যাবসার্ড নাটকের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও নতুন করে তাত্ত্বিক আলোচনা কাম্য। নৈরাশ্য ও শূণ্যতাবোধ চিরকালীন, কিন্তু তাছাড়া অন্য সমস্যাও কি অ্যাবসার্ড নাটকের উপজীব্য হতে পারে? বর্তমান সময়ের বিশেষ সমস্যাগুলিকে কি অ্যাবসার্ড ধারায় প্রকাশ করা সঙ্গত? হয়ত এই আলোচনা থেকেই উঠে আসবে নতুন কোনও নাট্যধারা, যা হবে একান্তই ভারতীয়।