নাসিকা পুরাণ। একঝাঁক তরুন অভিনেতাদের নিয়ে মিনার্ভা রেপর্টরির নতুন নাটক। নিষ্ঠা, চর্চা এবং একাগ্রতা যে অভিনেতার কাজকে পসিটিভ্লি প্রভাবিত করবেই তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ নাসিকা পুরাণ। প্রত্যেক অভিনেতাই শরীর-গত এবং স্বর-গত ভাবে তৈরি করেছেন নিজেকে। প্রত্যেকে মানে প্রত্যেকেই, শুধু মূলচরিত্রেরা নন। গোটা নাটক জুড়ে তাঁরা সকলে মিলে প্রমাণ করেন থিয়েটার একটা জীবন্ত মাধ্যম এবং থিয়েটার থেকে দর্শক হিসেবে যা পাওয়া সম্ভব, তা আর কোন মাধ্যম থেকেই পাওয়া সম্ভবনা।
কিন্তু থিয়েটার একটা কম্পোসিট আর্ট। দুর্দান্ত অভিনেতা ছাড়াও আরও অনেক কিছুর সঠিক মেলবন্ধন হলে তবেই একটা থিয়েটার ভাল থিয়েটার বা একটা কাজের কাজ হয়ে ওঠে। এখানে এসেই নাসিকা পুরাণ দর্শকের নাসিকা কুঞ্চিত করে তোলে।
Previous Kaahon Theatre Review:
নাটকটি ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত ফরাশি নাট্যকার এডমন্ড রঁস্তার ততোধিক বিখ্যাত হিরোয়িক কমেডি “সারানো দে বারজারাক” এর বঙ্গীকরণ। নাটককার অশোক মুখোপাধ্যায় প্যারিস থেকে তুলে এনে নাটকটি ফেলেছেন সপ্তম শতকের গৌড়বঙ্গে। মূলনাটকের সাথে সাদৃশ্য রেখে তৈরি করার চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধের পরিবেশ।
কিন্তু সৃষ্টি হয় অন্য পরিবেশ। পোশাক, ল্যাম্পশেডের আলোকসজ্জা,লেসার লাইটের অনবরত আক্রমণ,ভাষার ব্যবহার, ব্যবহারের ভাষা,কাগজে লেখা চিঠি,প্রজেক্টরের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার এ সমস্ত মিলিয়ে নাটকটা দিশাহীন হয়ে পড়ে। ভাষার বিবর্তনও সকলের বোধগম্যতার কথা ভেবে শব্দও ভাষার ব্যবহারের দিকটি না হয় এড়িয়ে যাওয়া গেল কিন্তু সপ্তম শতকে কেমন পোশাক ব্যবহার হত, তার মেটিরিয়াল কি হতে পারে, কেমন রঙ ব্যবহার হত, দরজা জানলা কেমন দেখতে হত, কাগজ ব্যবহার হত কিনা, শাঁখা-সিঁদুর ব্যবহার হত কিনা… এগুলো নিয়ে রিসার্চ একটু কম করা হয়েছে বলে মনে হয়।
এইনাটকটি একটি সহজ সুন্দর প্রেমের গল্প যার মূল দ্বন্দ্ব হল প্রেমের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য এবং গুণের লড়াই। নাটকের হিরোইন রঞ্জাবতী শারীরিক সৌন্দর্য দেখে বীর কনকবর্মার প্রেমে পড়ে। নাটকের হিরো শশধর প্রচলিত ধারনা অনুযায়ী দেখতে কুৎসিত। তার নাকটি বিশাল, কিন্তু সে অনবদ্য কবিত্ব শক্তির অধিকারী। সুন্দর কনকবর্মা এবং কুৎসিত শশধর দুজনেই রঞ্জাবতীকে চায়। কিন্তু রঞ্জাবতী কাকে চায়? তাঁর বাইরের সৌন্দর্য এবং কাব্যময় প্রেমের প্রকাশ দুইই ষোল আনা চাই। শশধর রঞ্জাবতীকে প্রেম নিবেদন করার আগেই রঞ্জাবতী তাকে জানিয়ে দেয় সে কনকবর্মাকে ভালোবাসে এবং শশধরকেই সে দায়িত্ব দিতে চায় কনকবর্মাকে রক্ষা করার। শশধর নিজের কাব্য প্রতিভা দিয়ে কনকবর্মার বকলমে রঞ্জাবতীকে চিঠি লিখতে থাকে, রঞ্জাবতী ভাবতে থাকে তাঁর সুন্দর কনকই সেই কাব্য প্রতিভার অধিকারী। কনকবর্মা এই ব্যাপারটায় একটু আপত্তি জানালেও অচিরেই বুঝে যায় কাব্য প্রতিভা ছাড়া রঞ্জাবতীর কাছে বিশেষ দাম পাওয়া যাবে না। অগত্যা এই দ্বৈত প্রেমের কমপ্লিট প্যাকেজ চলতে থাকে ততদিন পর্যন্ত যত দিন না কনকবর্মা যুদ্ধে নিহত হয়। কনকবর্মার মৃত্যুর পরে শশধর নিজের কাব্যময় প্রেম প্রকাশ করার সুন্দর চেহারাটি হারায়। কনকবর্মা এবং তাঁর বকলমে শশধরকেও হারিয়ে ফেলে বৈরাগ্যের জীবন কাটাতে শুরু করে রঞ্জাবতী। তবে শেষ পর্যন্ত বোধহয় “আমার ভালটা চাই” ধরণের মানসিকতাই জয়ী হয়। রঞ্জাবতী সারাজীবন ধরেও বুঝতে পারে না সে আসলে কার সাথে প্রেম করছিল বা বলা যায় কমপ্লিট প্যাকেজে সে এততাই সন্তুষ্ট ছিল সে এ সব নিয়ে বিশদে জানার চেষ্টাই করে না। শেষ পর্যন্ত শশধর মৃত্যুর আগে যখন তাকে পুরো ব্যাপারটা জানায় তখন সে এক মুহূর্তে কনকের বিচ্ছেদে দীর্ঘদিনের বিশাদ-যাপন ভুলে গিয়ে শশধরকে নিয়ে বিলাপ করতে থাকে। শেষের দিকে যখন রঞ্জাবতী বরমাল্যখানি কনকবর্মা ও শশধরের মধ্যে দ্বিতীয়ের গলায় পরিয়ে তাকে প্রেমের যুদ্ধে বিজয়ী ঘোষণা করে তখন আসলে তার প্রেমের প্রতি ইন্টিগ্রিটি নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়।
নাটকের চরিত্ররা অভিনেতা হিসেবে দারুন তৈরি হলেও নির্দেশক বিপ্লব বন্দ্যপাধ্যায় বা নাটককার অশোক মুখোপাধ্যায় তাঁদের কোন চরিত্র হিসেবে তৈরি করতে পারেননি। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এঁদের অবস্থান, পরস্পরের প্রতি এঁদের মানসিকতা… এসব নিয়ে দারুন দারুন চরিত্র তৈরির অবকাশ ছিল। নাটকটা অনাবশ্যক লম্বা এবং শুরুর দিকে হঠাৎ হঠাৎ নর্তকীদের নাচ ও গানের ব্যবহার বেশ বিরক্তিকর। অর্থ প্রচুর তাই অপ্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবহার বিশেষত অপ্রাসঙ্গিক প্রজেক্টর, অ্যানিমেশন ইত্যাদির জন্য… খুবই চোখে লাগে। কিন্তু অভিনেতারা এত প্রাণ দিয়ে কাজ করেছেন, এসমস্ত ত্রুটি সরিয়ে রেখেও তাঁদের কাজ দেখা যায়।
পরিশেষে বলতেই হয়, মিনার্ভা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, বাংলা নাটকের অর্থের অভাব, অভিনেতা এবং কলাকুশলিদের যথাযথ পারিশ্রমিকের অভাব- এসব মিনার্ভায় নেই। অর্থাৎ যথেষ্ট অর্থ এবং শুধু কাজেই মগ্ন হয়ে থাকার যথার্থ অবকাশ এঁদের রয়েছে। তাই এঁদের কাছ থেকে এর থেকে আরও অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক এবং ভাল কাজ আমরা দেখতে চাই।
পুনশ্চঃ পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ, প্রেমের উপগ্রহও চাঁদ। প্রেম সাধারণত নিজের চাহিদাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কিন্তু চাঁদ নিজের অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরতে পারেনা। চাঁদ স্থির হয়ে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সূর্যের আলো চাঁদের একটা দিকেই পড়ছে এবং ওই একটা দিকেই কিউরিওসিটি সেলফি তুলে পাঠাচ্ছে। এসব কেন বলছি সেটা জানতে কিউরিয়াস ফিল করলে নাটকটা শেষ অবধি দেখুন।