এক্সিস্টেনশিয়ালিজম বা অস্তিত্ত্ববাদী দর্শনের জিজ্ঞাসাগুলো মূলত এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড তথা মানুষের উৎপত্তি ও অস্তিত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইউরোপীয় সাহিত্যে এই দর্শনের প্রভূত প্রভাব লক্ষ্য করা যায়; বিশেষ করে জাঁ পল সার্ত্র, ফ্রাঞ্জ কাফকা, বা আলবেয়ার কাম্যু প্রমুখ শক্তিশালী লেখকদের হাতে অস্তিত্ত্ববাদ নিয়ে নতুন একটা সাহিত্য ধারাই তৈরী হয়ে গেছে। অনিশ্চিত এই পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের জীবন নানা রকম সামাজিক ঘেরাটোপ, নিয়মনীতি, দুঃখকষ্ট ও নিপীড়নের মধ্যে আটকে থাকে, আর এই দুঃসহ যন্ত্রণার অবসান হয় একমাত্র মৃত্যুতে! এই বিষাদময় জীবনকে সাহিত্যের পাতায় নিয়ে আসতে গিয়ে, এই লেখকেরা, কাহিনীর বাস্তববাদী বর্ণনাত্মক কাঠামোর মধ্যেই কখনো কখনো প্রয়োগ করেন অ্যালিগরি বা রূপকধর্মী বর্ণনা, যা ক্রমে এই ধারার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।
Previous Kaahon Theatre Review:
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যখন ভারতীয় লেখকদের রচনার দিকে তাকাই, আমরা পাই অনিতা দেশাই বা অরুণ যোশীর মতো লেখকদের। সার্ত্রর বিখ্যাত অস্তিত্ত্ববাদী প্রস্তাবনা Existence precedes Essence এর পথ ধরে এই লেখকদের রচনাতেও উঠে এসেছে সমকালীন ভারতীয় মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ, অর্থহীন ও অকিঞ্চিৎকর জীবনযাত্রার কাহিনী। তবে এরা সবাই লিখেছেন ইংরিজি ভাষায়। ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষায়, বিশেষ করে বাংলাতেও কিন্তু অস্তিত্ত্ববাদী রচনা বিশেষ অপ্রতুল নয়। কিন্তু বাঙালির দুর্ভাগ্য যে আমরা পাশ্চাত্যকে অনুকরণ করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ! তাই আধুনিক ভারতীয় মননের সংকটকে তুলে ধরতে গিয়ে বাঙালি সবসময় ছুটে যায় ইউরোপীয় সাহিত্যের কাছে, দ্বারস্থ হয় অনুবাদ বা অ্যাডাপ্টেশনের। সেইদিক থেকে ‘অশোকনগর প্রতিবিম্ব’ দলটির একটি আন্তরিক অভিনন্দন প্রাপ্য, মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘মৃত্যুসংবাদ’ নাটকটিকে নির্বাচন করার জন্য!
প্রাসঙ্গিক কয়েকটি রূপক চরিত্রের মাধ্যমে এই নাটকটি মধ্যবিত্ত জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতাকেই ফুটিয়ে তোলে। মানুষ এখন আর সুসংহত, সম্পূর্ণ নেই, বরং অবক্ষয়িত এবং খণ্ডিত, তার মানমর্যাদা আজ ভূলুন্ঠিত! এমনকি নিজের কৃতকর্মের ফলাফল বা দায়িত্বও তার নিজের আয়ত্তে নেই! কৃষ্ণেন্দু অধিকারীর সুঅভিনীত চরিত্রটি দাবি করে যে সে নিজেই নিজের পিতাকে হত্যা করেছে (এই কর্মটির সম্পাদনই তার অস্তিত্ত্বকে অর্থবহ করে তুলছে)। তার এই কর্মটিকে বৈপ্লবিক বলে গণ্য করছে তার প্রেমিকা এবং তার আত্মীয় বন্ধুরা (মুক্ত মানুষ)! কিন্তু বাস্তবে চরিত্রটি স্কিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত, আর তার পক্ষে নিজের পিতাকে হত্যা করা সম্ভব হয় না (আসলে ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা সম্ভবই নয়)! শান্তনু নাথ কৃত চরিত্রটি ঐ একই নারীকে ভালোবাসে, কিন্তু সে নিজের অক্ষমতাকে স্বীকার করতে ভয় পায়। যেন, যে মুহূর্তে সে উপলদ্ধি করবে যে সে আসলে নিজের ইচ্ছাধীন নয়, তখনই সে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলবে!
নির্দেশক পার্থসারথি রাহা খুব কঠোরভাবেই নাটকে কোনোরকম ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণাত্মক উপাদান যোগ করেননি, নাটকের বর্ণনামূলক অংশটিকেই অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন! এখানে এই প্রশ্নটি ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে তাহলে কেনই বা দর্শক নিভৃতে নাটকটি পাঠ না করে এতটা পরিশ্রম করে অভিনয় দেখতে প্রেক্ষাগৃহে আসবেন! হয়ত নির্দেশক দর্শকদের নাট্যবোধের ওপর আস্থা রেখেছেন যে তারা নিজেরাই নাটকটির রূপকধর্মী চলনটিকে উপলব্ধি করতে পারবেন। নির্দেশক চাইলে মঞ্চসজ্জা ও আলোক সম্পাতকে বিশেষভাবে ব্যবহার করে কাহিনীর বর্ণনাত্মক চলনকে ভেঙ্গে দিয়ে রূপকধর্মী চলনের ইঙ্গিত দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেই পথে হাঁটেননি। এর ফলে অধিকাংশ দর্শকই গল্পের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়ে ফেলেন, আর নাটকটি তাদের কাছে শুধু এক মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন কাহিনী হিসেবেই থেকে যায়। শান্তনু নাথ নিজের চরিত্রটি এতটাই সরলীকৃত করে ফেলেন যে দর্শক তাকে একটা কৌতুকচরিত্র হিসেবে ধরে নেন, যদিও আসলে চরিত্রটির নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দর্শক নিজেকে খুঁজে পাবেন, এমনটাই কাম্য ছিল। হত্যার উদযাপন দৃশ্যটিতে একটি চমৎকার নাট্যমুহূর্ত তৈরী হবার সুযোগ ছিল, কিন্তু সেখানেও সে ভাবে কোনো সার্বিক উত্তরণ অনুভূত হয় না। সংলাপের মধ্যে যে স্বপদৃশ্যের বর্ণনা ছিল সেটি অভিনীত না হওয়ায় আরেকটি প্রতীকী দৃশ্য নির্মাণের সুযোগ হাতছাড়া হয়। যদিও নীল কৌশিকের মঞ্চ, সৌমেন চক্রবর্তীর আলো, এবং উজান চট্টোপাধ্যায়ের আবহ, সবকিছুর মধ্যেই সেই ঈঙ্গিতময়তা বর্তমান ছিল, কিন্তু পরিচালকের সামগ্রিক পরিকল্পনার অভাবে সেগুলো কোনো পূর্ণতায় পৌঁছায় না!
সব মিলিয়ে দেখতে গেলে, এই প্রযোজনাটিতে মৃত্যুসংবাদ নাটকটি একটি টেক্সট হিসেবেই থেকে যায়, সচেতন দর্শক যাকে দৃশ্যশ্রাব্য ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করলেও করতে পারেন, কিন্তু সাধারণভাবে একটি নাট্য গড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে! তবে প্রযোজনাটি নাট্যকার হিসেবে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের রচনাগুলির প্রতি নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষিত করে; হয়ত বাঙালি পাঠকপাঠিকা আবার নতুন করে নাটকগুলি পাঠ করবেন, আর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন নিজেদের সংকটময় অস্তিত্বকে!
বাংলায় অনুবাদ – অঞ্জন নন্দী