‘রিখ’ এবং কলকাতার ‘পদাতিক থিয়েটার’ সংস্থার যৌথ উদ্যোগে গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, তারিখে পদাতিক লিটল থিয়েটার অন্তরঙ্গ মঞ্চে অভিনীত হয়ে গেল কানাডার নাট্যকার Gabriel Emanuel রচিত ইংরাজি নাটক ‘Mark Twain: Live in Bombay!’, নির্দেশনা এবং একক অভিনয়ে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ত্ব শ্রী বিনয় শর্মা।
রসজ্ঞ মার্কিন লেখক মার্কটোয়েন (১৮৩৫-১৯১০) ভারতীয় পাঠকদের কাছেও অতি পরিচিত প্রধানত ‘The Adventures of Tom Sawyer’ এবং তার সিক্যুয়েল ‘Adventures of Huckleberry Finn’ এর রচয়িতা হিসাবে। কিন্তু তিনি যে বক্তা হিসাবেও বেশ আকর্ষণীয় ছিলেন, দেশে দেশে তার বক্তৃতা মালার আয়োজন করা হত, এমনকি ভারতেও যে তিনি বেশ কিছুদিন কাটিয়ে গেছেন – এসব তথ্যাদি কিছুটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিল। এই নাটকটার বিশেষত্ব এখানেই যে নাটকটা ব্যক্তি মার্ক টোয়েনের এই স্বল্প পরিচিত দিকটা দর্শকদের চোখের সামনে নিয়ে আসে, আর সেই সূত্রে দর্শক সমসাময়িক ইতিহাসের একটা স্বাদ পেয়ে যান।
Previous Kaahon Theatre Review:
১৮৯৬ সালে তৎকালীন বোম্বাই এর একটি প্রেক্ষাগৃহে মার্ক টোয়েন একটি ‘পাবলিক লেকচার’ দেন, নাটকটি সেই বক্তৃতারই পুনর্গঠন বা পুনর্নির্মাণ। নাটকে আর অন্য কোনও কাহিনী নেই, ঐ বক্তৃতাটিই সম্পূর্ণ নাটক! বক্তৃতায় তিনি ঠিক কী বলেছিলেন তার সঠিক বিবরণ কোথাও লিপিবদ্ধ নেই, প্রধানত তার লেখালেখি, আত্মজীবনী, ভ্রমণ-বিবরণ, ও খবরের কাগজের অংশত সংরক্ষিত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে নাট্যকার গাব্রিয়েল এই বক্তৃতাটি কল্পনা করেছেন। নাটকটিকে এপিসোডিক বা পর্বভিত্তিক বলা চলে; বক্তৃতা শুরু হয় বোম্বাই তথা ভারতবর্ষ সম্পর্কে মার্ক টোয়েনের কিছু পূর্বকল্পিত ধ্যাণ ধারণা এবং কিছু সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বর্ণনার মধ্যে দিয়ে, এই অংশটি প্রধানত তার ট্রাভেলগ ‘Following the Equator’ থেকে নেওয়া। পরবর্তী পর্বে আসে তার ছেলেবেলা, মিসিসিপি নদীর অববাহিকায় তাঁর বেড়ে ওঠা, স্কুলে নিয়ম ভঙ্গের প্রথম পাঠ, স্টিম-মোটরবোট চালক হওয়ার স্বপ্ন দেখা – সবই মোটামুটি তার আত্মজীবনী ‘Life on the Mississippi’ কে অবলম্বন করে। এইভাবে একের পর এক পর্বে আসে উঠে আসে মার্কের জীবনের আরও কিছু অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি – কখনও তার উপকরণ নীতিভ্রষ্ট রাজনীতি, কখনও অসৎ সাংবাদিকতা, আবার কখনো বা শিল্পীর স্বাধীনতা ও সেন্সরশিপ, এবং সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় গোঁড়ামি! হ্যাকেলবেরি ফিন থেকে একটা বড় অংশ পাঠের মধ্যে দিয়ে উঠে আসে সমসাময়িক মার্কিন জীবনযাত্রা, দাসপ্রথার অমানবিকতা, বর্ণবিদ্বেষ, এবং নৈতিক টানাপোড়েন। আর এসবই পরিবেশিত হয় মার্ক টোয়েনের স্বভাবসিদ্ধ বৈদগ্ধ, কৌতুকবোধ, এবং শ্লেষের সমণ্বয়ে, যা কিনা তার লেখার ও প্রধান বৈশিষ্ট্য।
মঞ্চে রক্তমাংসের মার্কটোয়েনকে জীবন্ত করে তোলার কাজটি সুচারু রূপে সম্পন্ন করেন একাধারে পরিচালক ও অভিনেতা বিনয় শর্মা। শুধু বহিরঙ্গের বা অবয়ব গত মিলই নয়, চলনে বলনে, আচার আচরণে, শরীরী ভাষায়, কৌতুক ও বিদগ্ধতার যুগপৎ প্রকাশে, তিনি সত্যিই দেড় ঘন্টার জন্য মার্ক টোয়েনে পরিণত হন। অন্তত মার্ক টোয়েন সম্পর্কে লভ্য তথ্যাদির সঙ্গে তার সাদৃশ্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। পদাতিক লিটল থিয়েটারের অন্তরঙ্গ স্পেসে খুব দ্রুতই তিনি দর্শকদের ইমোশনাল কন্ট্রোলটা নিজের হাতে নিয়ে নেন। তিনি দর্শকদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, কখনো দর্শকাসন থেকে কাউকে মঞ্চে ডেকে নেন। দর্শক তার সঙ্গেই হাসেন, তার সঙ্গেই ভাবেন – আর এইভাবেই তিনি দর্শকদের সঙ্গে একেবারে অন্তরঙ্গ হয়ে পড়েন। নাটক শেষে একটা অপূর্ণতার রেশ থেকে যায়, যেন আরও কিছুক্ষণ চললে ভালো হত! নিরাভরণ মঞ্চসজ্জা, শুধুমাত্র একটি টেবিল-চেয়ারই সম্বল। সুদীপ সান্যালের আলো সেখানে যোগ্য সঙ্গত করে, কোনও চমক প্রার্থিতও ছিল না। বক্তৃতার পর্বগুলোর ফাঁকে ফাঁকে জ্যাজ ও ব্লুজ সঙ্গীতের প্রয়োগ নাটকের মার্কিনি মেজাজটি ধরে রাখতে সাহায্য করে। সব মিলিয়ে, একশো বছরেরও বেশি সময়ের পুরোনো সেই লাইভ লেকচারটির সত্যিই যেন পুনরাবৃত্তি হয়ে যায় এখানে।
তবে চমৎকার পেশাদারী প্রযোজনা এবং ঝকঝকে পারফর্মেন্স সত্ত্বেও নাটকটি কিছু প্রশ্ন রেখেই যায়, যা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়! নাটকটি যে ঘটনাটি তুলে ধরে, অর্থাৎ বোম্বাইএর নভেলটি থিয়েটারে মার্কটোয়েনের সেই লেকচার – তার উপভোক্তা ছিলেন প্রধানত ব্রিটিশ ভারতের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা এবং দেশীয় রাজন্য ও ধনী ব্যক্তিবর্গ! আজ প্রায় একশো বছরের ও বেশি সময় পরে, পদাতিক লিটল থিয়েটারের অন্তরঙ্গ মঞ্চে যারা ঐ লেকচারে পুনরাভিনয় দেখলেন, তারাও কিন্তু প্রধানত শহরের একটি বিশেষ উচ্চবিত্ত শ্রেণীরই প্রতিনিধি, আর নাটকটিও যেন ঐ বিশেষ শ্রেণীর মনোরঞ্জনের জন্যই নির্মিত! আর সেই কারণেই হয়ত নাটকটি এমনভাবে পরিবেশিত, যাতে দর্শকরা মার্ক টোয়েনের বৈদগ্ধ ও কৌতুক উপভোগ করতে পারেন, সঙ্গে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য জানতে পারেন, আর সমকালীন ঘটনাবলীর সঙ্গে তৎকালীন রাজনৈতিক অসাধুতা, শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, নীতিহীন সাংবাদিকতা, ইত্যাদি বিষয়গুলোর সাযুজ্য খুঁজে পেয়ে আমোদিত হতে পারেন! এলিট এন্টারটেইনমেন্টের রীতিনীতি অনুসরণ করেই নাটকটি কিন্তু কখনোই সেই বিশেষ গণ্ডীটি অতিক্রম করতে চায় না যেখানে নাটকের বিষয়বস্তু দর্শককে বিচলিত বা আলোড়িত করবে! অতীতে পদাতিকের প্রযোজনায়, এমনকি শ্রী বিনয় শর্মার সক্রিয় অংশগ্রহণেও আমরা অসংখ্য দেশী, বিদেশী ক্লাসিক নাটক দেখেছি যা কিনা অন্যভাষায় হলে ও চরিত্রগত দিক থেকে বাংলার নাট্যসংস্কৃতিরই প্রতিনিধিত্ব করত। কিন্তু এই নাটকটি এমন এক এলিট থিয়েটার কালচারকে রিপ্রেজেন্ট করে, বাংলার নাট্যজগত থেকে যার অবস্থান শতযোজন দূরে! নাট্যকার গাব্রিয়েল অবশ্য এই ধরণের নাট্য রচনায় সিদ্ধ হস্ত, তার লিখিত তারকা খচিত নাটক ‘আইনস্টাইন’এর কথা আমরা শুনেছি। এই নাটকটি ও নাট্যকারের ঐ বিশেষ ধরণের নাট্য চিন্তারই সম্প্রসারণ! অবশ্য বর্তমানে, পরিবর্তিত আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে, এই ধরণের এলিট থিয়েটারের একটা বিশেষ চাহিদা নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে, আর সেই শূণ্যস্থান পূরণ করতে বিদেশ থেকে ছুটে আসছেন গাব্রিয়েলের মতো নাট্যকারেরা, তবে তারা বাংলা তথা ভারতীয় নাটকের মূলধারাটিকে কতটুকু সমৃদ্ধ করছেন বা আদৌ সমৃদ্ধ করছেন কিনা, এই নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেল!