গত ছ’ দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং সফলতার সঙ্গে কলকাতা রঙ্গমঞ্চে একটি নাট্যদল কাজ করে চলেছে, এ বড় কম কথা নয়। অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় ও অসিত বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ১৯৬০ সালে দলটির পথচলা শুরু হয়েছিল, এ বছর তারা ষাটে পা দিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, দলটির নাম অবশ্যই ‘নান্দীকার’। ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’, ‘শের আফগান’, ‘মঞ্জরি আমের মঞ্জরি’, ‘তিন পয়সার পালা’, প্রভৃতি নাট্য প্রযোজনার মাধ্যমে নান্দীকার বাংলার থিয়েটার দর্শকদের উপহার দিয়েছিলেন এক নতুন ধরনের নাট্যোপলব্ধি। সত্তরের দশকের শেষের দিকে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের হাত ধরে শুরু হয় নান্দীকার এর নতুন করে পথচলা। ‘ফুটবল’, ‘শেষ সাক্ষাৎকার’, ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’, ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’ প্রভৃতি নাট্য প্রযোজনার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে জাতীয় নাট্য উৎসব, নাট্য প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন এবং থিয়েটারের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজকর্মে নান্দীকার নিজেদের যুক্ত রেখেছে। সময়ের অন্তরে বর্তমানে নান্দীকার পরিচালনার ভার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। এই নতুন প্রজন্মের প্রয়াসে নান্দীকার তাদের ষাটতম জন্মদিন উপলক্ষে প্রযোজনা করেছে নতুন নাটক ‘মানুষ’। এটি একটি দ্বিভাষিক (বাংলা ও হিন্দি) নাটক। প্রফুল্ল রায়ের ছোটগল্প থেকে এর নাট্যরূপ দিয়েছেন অনিন্দিতা চক্রবর্তী ও সপ্তর্ষি মৌলিক, এবং নির্দেশনায় সোহিনী সেনগুপ্ত। এই নাটকের চতুর্থ অভিনয় অনুষ্ঠিত হলো গত ৮ই আগস্ট, ২০১৯, আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস মঞ্চে।
Previous Kaahon Theatre Review:
প্রফুল্ল রায়ের ছোটগল্প ‘মানুষ’কে কিছুটা পরিবর্তন, কিছু সংযোজন করে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এনে নাট্যরূপ দিয়েছেন নাট্যকার। ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারী হতদরিদ্র প্রান্তিক কিছু মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, তাদের মানবিক মূল্যবোধ, এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ফাঁদে তাদের চরম বঞ্চনার ছবি নাটকে তুলে ধরা হয়েছে। এ কাহিনীর মূল চরিত্র ভরোসালাল একজন ‘জঙ্গল হাঁকোয়া’। তার কাজ হলো জঙ্গলে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে আর চিৎকার করে বাঘ, ভাল্লুকের মতো হিংস্র জন্তু জনোয়ারদের শিকারীদের বন্দুকের মুখে নিয়ে যাওয়া। গ্রামের কয়েকজন মানুষ গ্রাম থেকে শহরে পৌঁছোতে চায় কাজের সন্ধানে। কাজ জুটলে একটু ভালোভাবে বাঁচাতে পারবে তারা। কিন্তু শহরে পৌঁছোনোর পথে বাধা হিসাবে দাঁড়িয়ে আছেন আছে ঘন জঙ্গলে ঘেরা শেরমুন্ডি পাহাড়। হঠাৎ করেই তাদের এই যাত্রায় যোগ দেয় এক গর্ভবতী মহিলা। সেও শহরে যেতে চায় তার স্বামীর খোঁজে। চলার পথে এই অসহায় একা মহিলার দায়িত্ব নিতে সকলেই অস্বীকার করে। ভরোসা দায়িত্ব নেয় মেয়েটিকে পাহাড় পার করে শহরে পৌঁছে দেবার। ভরোসার মানবিকতা আর অসহায়তার প্রতি কর্তব্যবোধ এই কাজে ভরসা জোগায় তাকে। কিন্তু শহরে পৌঁছে কি পূরণ হবে তাদের স্বপ্ন? আত্মকেন্দ্রিকতায় ভরা মানুষের শহরে আশ্রয় মিলবে কি এই পরিচয়হীন গরীব মানুষগুলোর? ভরোসা কি পারবে মেয়েটিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে? সে কি পারবে নারীপুরুষের আদিম আবেগকে অতিক্রম করে মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্যে অবিচল থাকতে? এসবের উত্তর পেতে হলে নাটকটা অবশ্যই দেখতে হবে।
প্রফুল্ল রায় যখন গল্পটি লিখেছিলেন সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ঐ অঞ্চল থেকে শহরে পৌঁছনোর একমাত্র পথ ছিল জঙ্গলে ঘেরা শেরমুন্ডি পাহাড় অতিক্রম করা। নাটককে বর্তমান সময়ে নিয়ে আসার ফলে শহরে পৌঁছনোর জন্য শেরমুন্ডি পাহাড় পেরোনোর আবশ্যকতার উপর প্রশ্নচিহ্ন দেখা দেয়! নাটকটি দ্বিভাষিক বলা হলেও মূলত নাটকের সব চরিত্রই হিন্দিতে সংলাপ বলে, শুধুমাত্র সূত্রধর টাইপের দুজন চরিত্র বাংলায় কথা বলে। যদিও তারা কেবল সূত্রধারণের কাজই করে না সাথে সাথে নাটকের বিষয় বিশ্লেষণ করে দেয়, খানিকটা মানে বোঝানোর মতো করে। এ পদ্ধতি কি বাংলাভাষী দর্শকদের সুবিধার্থে? নির্দেশক একটি বিশেষ চরিত্রে স্বল্প সময়ের জন্য মঞ্চে অবতীর্ণ হন। যদিও চরিত্রটি একটি সাংবাদিকের কিন্তু এখানে যাত্রার বিবেকের মতো কিছু জ্ঞানদান করে এবং দুই সূত্রধারের সাথে গান সহযোগে একটু নাচও করে নেন। এই দৃশ্যটি দর্শকদের মনে তাৎক্ষণিক মনোরঞ্জন দান করে বটে, তবে নাট্য প্রেক্ষিতে এর তাৎপর্য বা প্রয়োজনীয়তা কোনোটাই আছে বলে মনে হয় না। ইদানিং নাটকে কোরিওগ্রাফির ব্যবহার প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে যা কখনও কখনও শারীরিক দক্ষতা কিংবা স্ট্যান্ট প্রদর্শনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এ নাটকে বেশ কিছু চমৎকার কোরিওগ্রাফির প্রয়োগ আছে আবার কখনও তা অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। যেমন বিরতির ঠিক আগে গর্ভবতী (দুর্বল) মহিলার রজ্জু আরোহনের দৃশ্যটি, যা দর্শকদের তুমুল হাত তালিতে মুখরিত হয় কিন্তু বাস্তব সম্মতভাবে চিন্তা করা খুবই কষ্টসাধ্য। আবার নাটকের শুরুতে ভরোসার জানোয়ার তাড়া করার দৃশ্যটি আলো, আবহ ও ভরোসার চিৎকার আর দর্শকদের মাঝে ছুটোছুটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে দেয়, কিন্তু তারপরও মঞ্চে কালো পোশাক পরা জন্তু-জানোয়াররূপী অভিনেতাদের উপস্থিতি অতিরিক্ত মনে হয়। এতে করে দর্শকদের কল্পনার স্থান সংকুচিত করা হয়। নাটকে বর্তমান রাজনৈতিক অসঙ্গতি ও কিছু বাধানিষেধ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যেমন দরিদ্র বঞ্চিত মানুষের জন্য নানা সরকারি ঘোষিত প্রকল্প রয়েছে কিন্তু তা’ অর্জনের জন্য জটিল পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা এই সংশ্লিষ্ট মানুষদের কাছে প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাদের নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বদা লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। তারপর আছে বাধার পাহাড় হিসেবে স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতাদের নানা কার্যকলাপ। তবে সমকালীন রাজনীতির এই বিষয়গুলি যেভাবে কিছুটা প্রতীকী ও হাস্যরসের মাধ্যমে উঠে এসেছে তাতে নাটকে রাজনৈতিক ছোঁয়া লাগলেও মূল সমস্যার গভীরতা প্রকাশে অসমর্থ, এবং দর্শক মনে বিশেষ কোন অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে না।
অয়ন ঘোষ ও দেবব্রত মাইতির মঞ্চ পরিকল্পনা বেশ ভাল লাগে। সামান্য রঙিন কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করে সুন্দরভাবে জঙ্গলের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। কাঠের ব্লকের ব্যবহারে পাহাড়ী পথের আদল প্রকাশ পেয়েছে। সাধন পারুই-এর আলো নাটকের পরিবেশ সঠিকভাবে প্রকাশ করেছে। আলো ও আবহের (গৌতম ঘোষাল) পারস্পরিক সহযোগে কিছু ভালো নাট্য মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে। নাটকের থিম মিউজিক হিসেবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যবহার বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, তবে গায়িকার স্বয়ং মঞ্চে উপস্থিতি হয়ে অভিনেতাদের ঘাড়ের কাছে এসে গাওয়াটা কেমন একটু অস্বস্তিকর ও দৃষ্টিকটু লাগে। নাটকের সংঘবদ্ধ অভিনয়ের মধ্যে দীর্ঘ অনুশীলন এবং পরিশ্রমের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। সুন্দর টিমওয়ার্কের ফলে আলাদা করে কারোর কথা উল্লেখ করার অবকাশ নেই। দু-একজন বাদে সকলের হিন্দি উচ্চারণ ভালোই তবে দেহাতী হিন্দি উচ্চারণের ক্ষেত্রে আরেকটু যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।
নতুন প্রজন্মের ভাবনা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তৈরী এই প্রযোজনা দর্শক মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারবে তা’ সময় জানান দেবে। তবে নান্দীকার তাদের পূর্ববর্তী কাজের মাধ্যমে যে উৎকর্ষতার মানদণ্ড স্থাপন করতে পেরেছে তার নিরিখে এই প্রযোজনাকে বেশ ম্লান লাগে।