বহুদিন পর সুযোগ হল একটি অ্যাবসার্ড বাংলা থিয়েটার দেখবার। কল্যাণী মুখোশ দলের নাটক মল্লভূমি।
অ্যাবসার্ড নাটকে বেশ কিছু অবাস্তব সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে বোঝানো হয় জীবন সংক্রান্ত সিরিয়াস কিছু সমস্যার কথা। সেই সমস্যা ব্যক্তিগতও হতে পারে, হতে পারে সমষ্টিগতও। কিন্তু অ্যাবসার্ড নাটকের সবচেয়ে মজার দিকটি হল এই সমস্ত সিরিয়াস আলোচনা মোটেই ভাবগম্ভীর ভাবে চশমা এঁটে অমুক লোকের তমুক থিওরি দিয়ে বলতে শুরু করা হয় না। এর ধরণ হয় খুব স্বাভাবিক, চলন স্বচ্ছন্দ, এবং গমনে তা দর্শককে বহুদূর অব্ধি নিয়ে যেতে পারে।
Previous Kaahon Theatre Review:
নাট্যকার নভেন্দু সেন এবং নির্দেশক অনিন্দিতা ভদ্র মল্লভূমি নাটকটি তৈরি করেছেন খুব যত্ন নিয়ে। এবং সমস্ত সুযোগ থাকা সত্বেও তাঁরা বেশী বলা, বেশী বোঝানো এবং বেশী দেখানোর লোভ যে ত্যাগ করতে পেরেছেন তা বর্তমান অতিনাটকীয় এবং মেগা-সিরিয়ালোচিত ট্রেন্ডের বাজারে বেশ প্রশংসনীয়। নাটকের অ্যাবসার্ড সিচুয়েশনটি একটি রূপকথা। সে রূপকথায় এক রাক্ষস আক্রমণ করে এক রাজ্যকে। রোজ তার কয়েকটি লোক খাওয়া চাই। প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষ, ভয়। অগত্যা রাজা ঘোষণা করেন যে রাক্ষসকে হত্যা করতে পারবে (রাজা কি আর নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দত্যি মারতে যেতে পারেন?), সে পাবে অর্ধেক রাজত্ব এবং রাজকন্যা (যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দত্যি মারতে যাবে, তাকে এই লোভটুকু তো দিতেই হবে!)। কিন্তু এ রূপকথা আর পাঁচটা রূপকথার নিয়ম মাফিক চলে না। শেষ অব্ধি দত্যি মারতে পারে না কেউ। বা বলা ভাল শেষ অব্ধি দত্যির দলে ভিড়ে যায়। মহা পালোয়ান আসে এক একজন, কিছুদিন পর থেকে বলতে শুরু করে গরু ছাগল খেয়ে কি মানুষ-খেকো মারা যায়? তারপর তারাও দানবের মতই দিনে কয়েকটা করে মানুষ খেতে থাকে।
মানুষ খাওয়ার লোভ এখানে হেলায় হারিয়ে দেয় অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যা পাওয়ার লোভ। বৃদ্ধ রসিকের বেশে ঘুরে বেড়ায় দানব, বশ্যতা স্বীকার করিয়ে রাখে মহাপালোয়ান বজ্রধরকে। মল্লযুদ্ধের আখড়ায় ঘুরে বেড়ায় একদল শকুন। এই নাটকে মেটাফর অসংখ্য এবং প্রকৃত অর্থেই এটি একটি ওপেন-এন্ডেড প্লে। এই মেটাফর-যূথিকা থেকে আপনি নিজের গল্প নিজেই বানিয়ে নিতে পারেন। কারুর মনে হতে পারে এই গল্প ক্যাপিটালিসম-এর চরিত্র বদলে যাওয়ার, কারুর মনে হতে পারে এ পৃথিবীর চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার গল্প, কারুর মনে হতে পারে এ গল্প জীবনের মত ধূসর, সাদা-কালো, খারাপ-ভাল যেখানে ওভাবে ঠিক করা যায় না, আবার কারুর মনে হতে পারে সবকটাই। (আসলে তো সবই একটা আরেকটার অংশ, সব ভাবনাই একটা আরেকটার সাথে জড়িত।) মল্লভূমি এমন একটি নাটক যা দর্শককে ভাবার সুযোগ দেয় বা বলা ভাল দর্শককে ভাবতে বাধ্য করে। বহু, বহু দিন পর বাংলা থিয়েটার এরকম নাটক দেখল।
নাটকের অভিনেতারা সকলেই প্রশংসনীয়। কিন্তু কোথাও একটা যেন তাঁরা নাটকে নিজেদের অবস্থান নিয়ে কনভিন্সড নন। কোথায় যেন একটা ক্ল্যারিটির অভাব বা বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব তৈরি হয়েছিল। অ্যাবসার্ড নাটকে অভিনয়রীতি নিয়ে খেলার অনেক জায়গা থাকে। এই নাটকেও তার পূর্ণ সুযোগ রয়েছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার হলে সোনায় সোহাগা। নাটকের আলো, মঞ্চ, মিউসিক সবই নাটকের সাথে সাযুজ্য রেখে তৈরি করা এবং কোথাও বাড়তি কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। মগজের খোরাক খোঁজেন যারা তাদের কাছে এই নাটক খুবই উপাদেয় হয়ে উঠতে পারে।
নাটকের একেবারে শেষে ভীষণ প্রয়োজনীয়তা অনুভব হচ্ছিল আরও একজন সাধারণ মানুষের রাক্ষস নিধনের চেষ্টাটা শুরু হওয়ার। শুধুমাত্র মানুষের জীবনের অবিরত চেষ্টা এবং তা ছাড়া অন্য কিছু করতে না পারার অসহায়তাটুকু বোঝানোর জন্যই। বলবান মানুষ যেখানে অন্যকিছুর লোভে বশ্যতা স্বীকার করেছে সেখানে সাধারণ মানুষের খুব একটা আশা থাকার কথা না। কিন্তু তাও আশায় মরে চাষা। সবকিছু ঠিক করার জন্য এভাবেই বিভিন্ন ভাবে এগিয়ে যায় মানুষ, বিভিন্ন চাহিদায়। কেউ কেউ পারে না, মরে যায়, কেউ কেউ পারে। তখন এক সমস্যা মিটে গিয়ে তৈরি হয় অন্যরকম সমস্যা। কিন্তু এই অবিরাম সমস্যার স্রোতে বয়ে চলাই মানুষের ধর্ম, মানুষের অপারগতা। জেতা…হারা… আশা… নিরাশা… এসব অনেক পরের কথা। মানুষ যতক্ষণ বেঁচে আছে ততক্ষন এই স্রোতে তাকে ভাসতেই হবে।