কন্টেক্সটঃ
প্যাকেজ শব্দটি আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা শব্দ। আমরা প্যাকেজে ঘুরতে যাই, প্যাকেজে অপারেশন করাই, প্যাকেজে জিনিসপত্র কেনাকাটা করি… এমনকি কেউ কেউ প্যাকেজে বিয়ে অবধি করে থাকি। বিভিন্ন রকম মার্কেট অ্যানালিসিস করে দেখা গিয়েছে, আমরা এমনি এমনি একলা সিঙ্গেল জিনিসপত্র আজকাল খুব একটা পছন্দ করছি না, এমনকি জিনিসের কোয়ালিটির সঙ্গে কম্প্রোমাইস করেও দু’তিনটে অপ্রয়োজনীয় জিনিস সমেত প্যাকেজ কিনতে ভালবাসছি।
টেক্সটঃ
সম্প্রতি নটধা নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করল তাঁদের নবতম প্রযোজনা “মহাভারত – ২”। এর আগে ২০০২ সালে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস নিয়ে নটধা “মহাভারত” মঞ্চস্থ করেছিল। এবারে তারা বেছে নিয়েছে মহাভারতের উদ্যোগ পর্বের বেশ খানিকটা অংশ। মহাভারতের গল্প আপনারা সকলেই জানেন। উদ্যোগ পর্ব মূলত পাণ্ডবদের ১২ বছরের বনবাস এবং ১ বছরের অজ্ঞাতবাস শেষে হস্তিনাপুরের সিংহাসন ফিরে পেতে চাওয়ার গল্প। এই পর্বেই মোটামুটি বুঝতে পারা যায় কৌরবদের সিংহাসন কিম্বা অর্ধেক রাজত্ব, কোনটাই ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে নেই সুতরাং যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ।
Previous Kaahon Theatre Review:
মহাভারত আমাদের সংস্কৃতির একটা বিরাট অংশ বহন করে। আমাদের বলতে শুধু বাঙ্গালীদের নয়, সমগ্র মানবজাতির অন্তরে, গভীরে প্রোথিত কিছু মৌলিক প্রবৃত্তি (বেসিক ইন্সটিঙ্কট) নিয়ে বোনা রয়েছে এ কাহিনীর জটিল ও বিস্তৃত জাল। এই জালের বিস্তার এমনই সম্পৃক্ত এবং পুনরাবৃত্তিমুখী যে এর একটি অংশকে নিজের মত ইন্টারপ্রেট করলে (ঘটনা-পরম্পরা এক রেখেও) তৈরি করে নেওয়া যায় নিজের ব্যাখ্যার মত আর একটি নতুন জাল। সেই কারণেই যুগে যুগে সমবেত চেতনার প্রবণতা অনুযায়ী মহাভারত ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিভিন্নভাবে।
এই নাটকের ক্ষেত্রে যেমন খুব স্পষ্ট করে বলা হয়েছে পক্ষ তৈরি হলে যুদ্ধ অনিবার্য, যুদ্ধ ছাড়া নিজের মত প্রতিষ্ঠা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় এবং যে যুদ্ধ চায়না, শান্তি চায় বলে দাবী করে সেও আসলে একটা পক্ষই। আসলে সকলেই নিজের মত করে জিততে চায়, এবং ‘যুদ্ধ ছাড়া জয়লাভ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বর্তমান সমাজের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি এবং সর্বত্র আমিই শ্রেষ্ঠ – এই মানসিকতার সাথে এই ইন্টারপ্রিটেশন বেশ ভালো করেই মিলে গেছে। এখানে আমরা দ্রৌপদীকে দেখি অত্যন্ত সচেতনভাবে পঞ্চ-পাণ্ডবকে প্রভাবিত (ম্যানিপুলেট) করছেন যুদ্ধ করবার জন্য, প্ররোচিত করছেন বিভিন্নরকম ভাবে যাতে তাঁদের আত্মসম্মান, আত্মশ্লাঘা আঘাত প্রাপ্ত হয় এবং অন্তত পৌরুষের খাতিরে তাঁরা যুদ্ধ করতে যান, প্রতিশোধ নেন দ্রৌপদীর অপমানের। কৃষ্ণকে দেখি বুদ্ধিজীবি কূটনীতিবিদের মত শান্তির আড়ালে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় বিভিন্ন পক্ষকে নিজের মত করে প্ররোচিত/প্রভাবিত করতে ব্যস্ত রয়েছেন। একদিকে প্রেমভাব বজায় রেখেছেন দ্রৌপদীর কাছে, অন্যদিকে কর্ণকে লোভ দেখাচ্ছেন দ্রৌপদীকে ফিরে পাওয়ার। আবার দুর্যোধনকে দেখি কখনো পাণ্ডবদের ঘাড়ে, কখনো নিজের বাবা-মার ঘাড়ে, কখনো মামা শকুনির ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন তাঁর অন্তরের ক্রূরতা এবং শয়তানীর বীজ বপনের দায়, পেতে চাইছেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, জনগণকে বাধ্য করছেন সামগ্রিক শাসনের ভাবনা চিন্তা ছেড়ে ব্যক্তি পূজায় বিশ্বাস করতে। এসবই আজকের চেনা দৈত্য-দানব, এসবই আমাদের সকলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে চুপটি করে, খালি মাঝেমাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায়, মুখোমুখি বিতণ্ডায় কিম্বা পক্ষ নেওয়ার প্রয়োজনে বেরিয়ে পড়ে বিভিন্ন রকম থিয়োরির মডার্ন ‘প্যাকেজিং’ এর আড়ালে। তাই এই ইন্টারপ্রিটেশন এই সময়ের জন্য প্রশ্নাতীতভাবে প্রাসঙ্গিক।
কিন্তু বিষয় হল দর্শক প্যাকেজ দেখতে অভ্যস্ত। এই প্রাসঙ্গিকতাটুকু তাঁদের জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁরা চান নাটক দেখে উত্তেজিত ও আবেগ তাড়িত হতে এবং যেকোন উপায়ে টিকিটের ২০০টি টাকা কড়ায়গণ্ডায় উসুল করতে। সত্যি কথা বলতে কি এই প্রযোজনা দেখে মনে হতে পারে নির্দেশক এবং নাট্যকার সম্ভবত দর্শকদের থেকেও বেশী বিশ্বাস করেন এই প্যাকেজিং এর ব্যাপারটায়। উচ্চারণ না করে যেন একটা স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন তাঁরা দর্শকদের প্রতি – “আমাদের নাটক মানেই ফুল এন্টারটেইনমেন্ট প্যাকেজ”। শুধুমাত্র এই নাটকটি নয়, নটধার বিগত ৩-৪টি নাটক দেখলেই এই ট্যাগলাইনটি স্পষ্টভাবে দেখতে/শুনতে পাওয়া যায়। এই কারণেই নাটকটিতে অভিনেতাদের অকারণ দাপাদাপি, চিৎকার, প্রচলিত স্মার্টনেস দেখানো অভিনয়, চোখ ঝলসানো আলো ও কান ফাটানো শব্দের ব্যবহার বিসদৃশভাবে চোখে পড়ে। কোন এক অজানা কারণে এসবের কিছু একটা হলেই দর্শক কলের পুতুলের মত হাততালি দিতে শুরু করেন। মনোরঞ্জনের প্যাকেজটি সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করার জন্যই বোধ করি সংলাপে “শান্তির ছেলে”, “উন্নয়ন আটকে দেওয়া” এসব শব্দ-বন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। হয়ত এই কারণেই হঠাৎ করেই কৃষ্ণের চরিত্রাভিনেতা স্টান্ট দেখানোর মত করে ব্যবহার করেছেন কথাকলির অভিব্যক্তি এবং পরে দুর্যোধনের সাথে ফুট ট্যাপিং এর ছন্দে সগৌরবে বাক-যুদ্ধ করেছেন। কি আশ্চর্য! দর্শকও এসব দেখে বিশেষ আমোদিত হয়েছেন, হয়ত বাড়ি যেতে যেতে বলেওছেন উফ, কি দারুণ এন্টারটেন্মেন্ট প্যাকেজ! কি মডার্ন অ্যাপ্রোচ!
মডার্নাইজেশন বা প্যাকেজ নিয়ে নিয়ে আমাদের কারুর কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। ক্যাপিটালিজম সময়ের দাবী, বিক্রিযোগ্য হয়ে ওঠা ক্যাপিটালিজমের দাবী। কিন্তু ব্যাপার হল মডার্ন প্যাকেজের নামে বাংলা থিয়েটার যেটা করছে সেটা হল পরস্পর সঙ্গতিহীন কিছু ট্রোপের ব্যবহার, অধিকাংশ সময়েই নাটকের টেক্সট এবং ভাবের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না। নাটক দেখতে গিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে নির্দেশক নাটক বিক্রি করার জন্য যতটা উদগ্রীব, নাটকের জার্নিটা সততার সঙ্গে মঞ্চায়িত করার জন্য ততটা নন। হতাশার বিষয় হল এই, যে বাংলার দর্শককুল হইহই করে সে সবেরই নাম গান গাইছে এবং সৎ প্রচেষ্টায় তৈরি মেদহীন স্পষ্ট নাটকের দর্শক সংখ্যা দিন দিন কমছে।
নাটকের টেক্সট এবং অভিনয়ের মত সমান গুরুত্বপূর্ণ নাটকের বাকি ৩টি এলিমেন্ট – মঞ্চনির্মাণ, আবহ পরিকল্পনা এবং আলোক পরিকল্পনা। বারবার এই কথা বলতে খারাপ লাগলেও, না বললেই নয় যে এই এলিমেন্টগুলো নিয়ে বাংলা থিয়েটারের বেশীরভাগ নির্দেশকই যথেষ্ট সচেতন নন। তাই বেশীরভাগ নাটকের ক্ষেত্রেই, এগুলো নিয়ে এক লাইন করে বলে ছেড়ে দিতে হয়। মহাভারতের টেক্সট রচনা করেছেন শিব মুখোপাধ্যায় (তাঁর মত অভিজ্ঞ নাট্যকারের লেখায় ‘সখ্যতা’র মত ভুল শব্দ, ‘শান্তির ছেলে’র মত অপ্রাসঙ্গিক শব্দ-বন্ধ একেবারেই আকাঙ্খিত নয়।) অভিনয়রীতি নিয়ে কিছু বলার নেই, যে যার মত যতটা পেরেছেন স্মার্ট থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন। কয়েকজন এই স্মার্ট অভিনয় করার ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট কনভিন্সড ছিলেন না, কয়েকজন ততটা ম্যাচিওরড নন, তাই এই আপাত স্মার্টনেসটা একটু বিক্ষিপ্ত থেকে যায়। দুর্যোধনের ভূমিকায় অর্ণ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণের ভূমিকায় রুদ্ররূপ মুখোপাধ্যায় এবং দ্রৌপদীর ভূমিকায় সোহিনী সরকার – সকলেই বিশেষভাবে স্মার্ট। ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকায় কৌশিক চট্যোপাধ্যায় কেবল মাত্র দাগ কেটে যান, তাঁর থেকেও তো বাকিরা শেখার চেষ্টা করতে পারতো?
এই নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং আবহ পরিকল্পনা করেছেন অর্ণ মুখোপাধ্যায়, আলোক পরিকল্পনা করেছেন কল্যাণ ঘোষ, মঞ্চ নির্মাণ করেছেন মিলন এবং সার্থক আর পোশাক নির্মাণ করেছেন বিমল মাইতি। এক্ষেত্রে একটা কথা না বলে পারছি না – মহাভারত নাটকে ইউরোপীয় (বিশেষত গ্রিক) এবং গড়িয়াহাট (বিশেষত ধোতিপ্যান্ট) ধাঁচের কস্টিউমের ব্যবহার কেন দেখলাম? মঞ্চে আধুনিক ডাম্বেল ভাঁজতে কেন দেখলাম? নির্দেশক, পোশাক নির্মাতা একবারও কি ভেবেছেন মহাভারতের যুগে কি ধরণের পোশাক ব্যবহৃত হত? কি রকম ছিল শরীর চর্চার যন্ত্র? কিরকম মুকুট পরতেন রাজারা? আবহতে দেশ কাল পাত্রের ঐক্য-বন্ধন ছিন্ন করে ভারতীয়, ইউরোপীয়, আরবি, অ্যামেরিকান … বিভিন্ন স্টক মিউজিকের ব্যবহার হয়েছে। ঢোকানো হয়েছে অনাবশ্যক, অর্থহীন দলবদ্ধ কোরিওগ্রাফি (গ্রিক ট্রাজেডির কোরাস? গ্রিকট্র্যাজেডির অন্য কোন বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়নি )। এতোগুলো কেন’র উত্তর না পেয়ে ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পড়লে পিটার ব্রুকসাহেবের দু’খণ্ডের মহাভারত দেখে নিন একবার।
যেকোনো শিল্পের ক্ষেত্রেই একটি রাজনৈতিক স্টান্স এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্য না রাখতে চাওয়াও আর একরকমের রাজনীতি। কিন্তু এখনকার বাংলা নাটক যেমন কার্য-কারণ ভুলে প্যাকেজ করতে শুরু করেছে এবং এই পথেই দর্শকের ভালোলাগা পেতে শুরু করেছে – এ আমাদের বাংলা নাটকের জয় বলব নাকি… কে জানে?
সাবটেক্সটঃ
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাংলা দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটা প্রবন্ধে একবার লিখেছিলেন যখন মৌষলকাল আসন্ন, যেমন মহাভারতে ছিল মুষলপর্ব, তখন মানুষ রঙ্গরসিকতা, আমোদ প্রমোদের ধরণও হয়ে ওঠে ভীষণ স্থূল, মস্তিষ্কের সূক্ষ্মতা হারিয়ে গোদা ব্যাপারেই সে আনন্দ পায় বেশী। এমনটা নৃসিংহপ্রসাদ বলেছিলেন। আমি কিছু বলছি না।