কল্যাণী কলামণ্ডলম প্রযোজিত ও শান্তনু দাস নির্দেশিত ম্যাকবেথ মিরর মোটের ওপর শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, কিন্তু নাট্যের তথা পারফর্মেন্সের জায়গা থেকে বেশ অভিনব একটি প্রচেষ্টা। যে বাংলা নাটকটি লিখেছেন দত্তাত্রেয় দত্ত, তা শেক্সপিয়ারের নাটকের প্লট ও বিষয় অনুসরণ করেছে সেটা স্বীকার করেও বলতেই হয় যে বেশ কিছু নতুন জিনিস এখানে আছে যা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথমেই যা নজর কাড়ে তা হচ্ছে এটাই যে নাট্যে আমরা পাই মাত্র তিনজন অভিনেতাকে, যারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন চরিত্র রুপায়ণ করেন। কিছুটা অনুমানের ভিত্তিতে বলা যায় যে, কেবল তিনজন অভিনেতাই করবেন একাধিক চরিত্র –নাট্যের বা পারফর্মেন্সের এই বিন্যাসটি (খুব সম্ভবত) পূর্বনির্ধারিত, এবং এই বিন্যাসই নাটকের টেক্সটকে গঠন করে। এবং ঠিক এখানেই উঠে যায় ম্যাকবেথ মিরর নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
Previous Kaahon Theatre Review:
Kaahon Theatre Review
1984? –Timely staging of a political novel
Read this review in English: https://t.co/78TBp1uTgw#bengalitheatre | #theatre | #theatrereview | #kaahontheatrereview | #KaahonPerformingArts pic.twitter.com/gFRQPrIgyB— kaahon (@kaahonwall) July 2, 2018
সময়ের সরণি ধরে থিয়েটারের যে চলা, তাতে আজকের সময়ে এসে কিছুটা হলেও যেন পারফর্মেন্স লিখিত টেক্সটকে পেছনে ফেলে এগোতে চাইছে; এমনকি লিখিত টেক্সটকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে পারফর্মেন্স নির্মাণ করছে সার্বভৌম পারফর্মেন্স-টেক্সট। এই প্রেক্ষিতে যখন দেখি ম্যাকবেথ মিরর অগ্রাধিকার দিতে সচেষ্ট হচ্ছে পারফর্মেন্সকে, বুঝতে বাকি থাকে না যে প্রযোজনাটি ছুঁতে চাইছে তার পারফর্মেটিভ ক্ষণকে। কিন্তু সমস্যা এটাই যে প্রযোজনাটি শ্যাম রাখি না কূল রাখি গোছের দ্বিধাবিভক্ত মনে হয় – একদিকে যেমন পারফর্মেন্স এখানে প্রতিপত্তি লাভ করতে চায়, অন্যদিকে আদি টেক্সট বেশ বড় হয়েই উপস্থিত থাকে এই প্রযোজনায়। যদি ম্যাকবেথের গল্পটাই বলা হবে তাহলে তা মাত্র তিনজন কুশীলবের মাধ্যমে কেন বলা হবে? অভিনেতার এই গুরুতর সংখ্যা সংকোচনের কোনো বুদ্ধিগ্রাহ্য কারণ মিলল না, যা নাটকের থেকে (তা শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথই হোক বা দত্তাত্রেয়’র নাটক) উঠে আসে। যেখানে লেখা টেক্সট প্রবলভাবেই আছে, সেখানে কোনো টেক্সট্যুয়াল প্রয়োজন ছাড়াই তিনজনকে দিয়ে গোটা নাট্যটি করানোয় পারফর্মেন্স হয়ে যায় দেখনদারি-নির্ভর; নাট্যটি মনে হয় অনেকটা যেন পারফর্মেন্স-পটুতা প্রদর্শনের অছিলা। ম্যাকবেথ মিরর যত এগোয় তত মনে হয় এই পারফর্মেন্সটি দাবী করছিল মূল টেক্সটের থেকে অধিকতর বিচ্ছিন্নতা, যা হলে ‘কেন কেবল তিনজন অভিনেতা’ এই প্রশ্নটাই উঠত না।
নাট্যটি শুরু হয় তিন উইচ’কে দিয়ে, যারা কালীর উপাসক এবং যারা তন্ত্রমন্ত্র সহযোগে অশুভ শক্তিকে আহ্বান করে। আশা জাগে, আমরা পাব ম্যাকবেথের উত্তর-ঔপনিবেশিক এক নতুন ভারতীয়করণ। কিন্তু এখানেও নাটক দ্বিধাবিভক্তির বাইরে বেরোয় না – উইচরা যতই শাক্ত হোন না কেন, ম্যাকবেথ, তার রানী, ব্যাঙ্কো প্রভৃতি চরিত্র থেকে যান সেই সুদূর বিদেশের চরিত্রসমূহ হয়ে। কেন এমন হবে তা যেমন বোধগম্য হয় না, তেমনই আরেকটা অভাব খুব পীড়া দেয়। এটা সবারই জানা যে ম্যাকবেথ (বা হ্যামলেট, বা কিং লিয়ার) এমন নাটক যা বিষয়গতভাবে কালোত্তীর্ণ; কিন্তু, এই সময়ে দাঁড়িয়ে ম্যাকবেথ নাটক কেন বর্তমানের কথা বলবে না, কেনই বা সেই নাটক হয়ে উঠবে না বর্তমান প্রতিফলিত করা একটি আয়না (মিরর), জানা নেই। নাট্য/পারফর্মেন্স এখানে সমকালীন, কিন্তু নাটকে সমকাল ধরা দেয় না।
এইসব প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও ম্যাকবেথ মিরর শেষ পর্যন্ত যে বেশ উপভোগ্য দর্শন শ্রবণ অভিজ্ঞতা হয়, তার কারণ পারফর্মেন্স বিন্যাস ও পারফর্মেন্স। নির্দেশক শান্তনু দাস ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামা’র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। দেশ ও বিদেশের নানা পারফর্মেন্স রীতি ও শৈলীর মেলবন্ধন ঘটিয়ে একধরণের সর্বভারতীয় আঙ্গিক থিয়েটারে নিয়ে আসার যে কাজ এই প্রতিষ্ঠান করে চলেছে, তাকেই শান্তনু বহাল রেখেছেন কৃতিত্বের সাথে ম্যাকবেথ মিরর’এর পারফর্মেন্স বিন্যাসে। তাই এই পারফর্মেন্সে জায়গা পায় Antonin Artaud’এর Theatre of Cruelty’র জোরালো অভিঘাত, যার সবচেয়ে উল্লেখ্য উদাহরণ সেই দৃশ্য যেখানে লেডি ম্যাকবেথ তার নারীত্ব ঘোচানোর প্রায় হিস্টিরিয়া-গ্রস্ত আর্জি উপস্থাপনা করেন রক্তলাগা স্যানিটারি প্যাড শরীর থেকে টেনে বের করে এনে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে। আবার, Artaud’এরই theatre as ritual’এর ধারণা মূর্ত হয় উপাচারের মত নানাবিধ সামগ্রী মঞ্চের সামনে সাজিয়ে রাখায় এবং বহু দৃশ্যে একই কাজ বারংবার হতে থাকায়; নজর কাড়ে সেই দৃশ্য যখন মঞ্চের ডান দিকে দুজন অভিনেতার সবাক সচল অভিনয়ের উল্টোপিঠে মঞ্চের বাঁ দিকে একা অভিনেতা কিছু একটা বেটেই চলেন, বেটেই চলেন, একই নির্বাক মুদ্রায়। তবে, প্রসেনিয়াম যেভাবে অনিবার্য দূরত্ব সৃষ্টি করে অভিনেতা আর দর্শকদের মধ্যে, তা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় ম্যাকবেথ মিররের পুরোমাত্রায় Artaud ঘরাণার নাট্য হওয়ার ক্ষেত্রে। শান্তনুর পারফর্মেন্স বিন্যাসে সমস্ত অঙ্গসঞ্চালনই শৈলীকৃত, যার মধ্যে কখনো ঢুকে পড়ে বীরভাবের ভারতীয় নাচের টুকরো, কখনো বা জাপানি কাবুকি থিয়েটারের মীই মুদ্রা। বেশ কিছু দৃশ্য এমনভাবে সাজানো যা একাধারে শক্তিশালী ভিস্যুয়াল ইমেজারি ও নির্দিষ্ট অর্থনির্মাণে সফল – মঞ্চের পেছন দিকে ঝোলা দড়ির উত্তাল আন্দোলন পৈচাশিক শক্তির আস্ফালনে ম্যাকবেথের পৃথিবীতে নেমে আসা শৃঙ্খলার বিপর্যয় দৃশ্যমান করে; সেই দড়ি আবার যখন ম্যাকবেথকে সাপের মত আষ্ঠেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে নেয়, নিয়তির করাল কবলে ম্যাকবেথের বন্দী হওয়াটা দেখা যায়। ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে ম্যাকবেথ যখন সাজান ব্যাঙ্কোর মৃত্যু, তখন যেন ম্যাকবেথের মন থেকে সুকুমার প্রবৃত্তির পাপড়িগুলো ঝরে পড়া দেখা যায়। আলোর বিন্যাস এই নাট্যে এমন যা ম্যাকবেথের দুনিয়ার অন্ধকারকে সামনে নিয়ে আসে; আলোর প্রক্ষেপণও যথেষ্ট কুশলী, কারণ বেশ কয়েকবার অভিনেতার ও আবহসঙ্গীতের সাথে তাল মিলিয়ে আলো নিভেছে, জ্বলেছে বা নির্দিষ্ট স্থানে পড়েছে, ছন্দ না কেটে। শুভদীপ গুহ’র আবহ একটু যেন গতানুগতিক ঠেকে, তবে ম্যাকবেথের গভীর হুতাশ বুদ্ধিমত্তার সাথে এস্রাজের ঝংকারে ধরায় সেই অনুভূতিটা খুব সহজেই দর্শকের কাছে সঞ্চারিত হয়। লেডি ম্যাকবেথের এক কলি গান গেয়ে উঠে ম্যাকবেথকে পাপের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটি অভিনবত্বে চমৎকার।
যদিও তিনজন অভিনয় করেছেন, কারো প্রচেষ্টাকে খাটো না করেই বলা যায়, মোনালিসা চট্টোপাধ্যায়ের পাশে অনন্যা দাস ও জয়িতা দাস কিছুটা সঙ্গতকারীর ভূমিকায় থেকে গেলেন, যার একটা কারণ নাটক’ও মোনালিসার তুলনায় তাদের দুজনকেই কম কাজের সুযোগ দিয়েছে। অনন্যা ও জয়িতা অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী কাজ করেছেন, কিন্তু দুজনেরই শরীরের আড়ষ্টভাব স্পষ্ট। এই নাট্যটির অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য এটা যে এই নাট্য উদযাপন করে এমন এক বিনাশক্ষম নারীশক্তি, সমাজে যার অবস্থান প্রান্তিক, যা উদ্রেক করে আশঙ্কা তথা ভয়। মোনালিসা নাট্যের এই বৈশিষ্ট্যটিকে উপলব্ধি করেছেন তার পারফর্মার ও নারী সত্তা দিয়ে এবং তাই তিনি সক্ষম হয়েছেন নিজের ক্ষমতার গভীরে গিয়ে একটি বিস্ময়কর পারফর্মেন্স খনন করে আনতে। তিনি অক্লান্তভাবে কন্ঠে, শরীরে এক চরিত্র থেকে অন্য বিচরণ করেছেন– একদিকে তার বিস্তৃত ভোকাল রেঞ্জের পরিচয় যেমন রেখেছেন, অন্যদিকে শরীরকে দুমড়ে মুচড়ে ছোট বড় করে তিনি তার শারীরিক পারফর্মেন্স ক্ষমতার নিদর্শন হাজির করেছেন। অভিনয়ের নৈপুণ্য যেমন মোনালিসার আয়ত্তে, তেমনই তিনি পারঙ্গম একটি নাটকের বিষয়ের অন্তরে মন ও মস্তিষ্ক দিয়ে প্রবিষ্ট হতে, যে কারণে মোনালিসার অভিনয়ে শুধু ক্রাফ্টের ঔজ্জ্বল্যই থাকে না, থাকে প্রাণ।এটা আমাদের সংস্কৃতি চর্চার নিতান্ত অগৌরবের দিক যে একজন পুরুষ অভিনেতা যে মানের অভিনয় করে দিকে দিকে বরেণ্য হয়ে ওঠেন, সে মানের চেয়ে অনেকটাই উঁচু দরের অভিনয়ের নজির রেখে একজন মহিলা অভিনেতা ততটা খ্যাতি লাভ করেন না। অত্যুক্তি না করে ম্যাকবেথ মিরর নাট্যে মোনালিসা চট্টোপাধ্যায়ের কাজ মঞ্চ-অভিনয়ের একটি বিশিষ্ট মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।