বাংলাদেশের লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের ১৯৪৮ সালে লেখা প্রখ্যাত উপন্যাস লালসালু নাম অক্ষুণ্ণ রেখে মঞ্চে নিয়ে এলো প্রাচ্য। নাট্যরূপ দিয়েছেন এই সময়ের অন্যতম শক্তিশালী নাটককার, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। কৌশিক যেহেতু কেবল নাটককারই নন, সফল নাট্য নির্দেশকও, তাই তিনি বিলক্ষণ জানেন কীভাবে উপন্যাসে যা বলা ও দেখানো আছে তা অভিনয়ক্ষম করে নাটকের অন্তর্গত করতে হয়। তিনি তার নাটকটিকে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত রেখেছেন উপন্যাসের সাথে এবং মূল টেক্সটের প্রায় কিছুই বাদ পড়েনি নাটকে। তিনি সচেষ্ট থেকেছেন এমনভাবে নাটকটি নির্মাণ করতে যাতে অভিনয়কালে নাট্যে আসে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ নাট্যমুহূর্ত, যা যেকোনো দুই ঘন্টাব্যাপী চলা নাট্যে নিতান্তই আব্যশিক। লালসালু’র নির্দেশনার ভার হাতে তুলে নিয়েছেন অবন্তী চক্রবর্তী; প্রাচ্য নাট্যদল এবং নির্দেশক অবন্তীর যুগলবন্দী আমরা কিছুকাল পূর্বেই দেখেছি, বেশ সফলতার সাথে মঞ্চস্থ হওয়া সখারাম নাট্যে।
Previous Kaahon Theatre Review:
Kaahon Theatre Review
Byatikrom (The Exception) – Old political wine in a new bottle
Read this review in English: https://t.co/lu1n0FfiXR #bengalitheatre | #theatre | #theatrereview | #kaahontheatrereview | #KaahonPerformingArts https://t.co/hAcdHRoLld
— kaahon (@kaahonwall) July 10, 2018
লালসালু নাটকের কেন্দ্রে আমরা পাই নিজভূমিচ্যূত মজিদকে যে মহব্বতনগর নামক গ্রামে নবাগত হিসেবে এসে একটি পরিত্যক্ত কবরকে মাজার বানিয়ে দিয়ে খুব অল্প সময়েই গ্রামে ধর্মের ব্যবসা ফেঁদে বসে। গ্রামের সরলমতি মানুষদের সে সহজেই করে ফেলে বশ, যাদের অর্থ ও প্রতিপত্তি আছে তাদের সাথে সে একপ্রকার লেনদেনে আসে এবং যারা একটু আধটু প্রশ্ন তোলে তাদের সে কায়দা করে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আমরা যে শুধু দেখতে পাই মহব্বতনগরের সমাজজীবনে ধর্মকে হাতিয়ার করে মজিদের প্রায় সম্পূর্ণ ক্ষমতা কায়েম করা তা নয়, আমরা দেখি পারিবারিক জীবনে ব্যক্তিমানুষটিকেও, এবং এখানেও সে আদ্যন্ত স্বার্থপর, লালসাগ্রস্ত ও নিজের ক্ষমতার চাপে তার স্ত্রীকে নিষ্পেষণকারী। নাট্যের শেষে আমরা দেখি মজিদকে বেশ বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে, যে চ্যালেঞ্জ হাজির করে তার দ্বিতীয় স্ত্রী, জামিলা। মজিদের ধর্মীয় ভড়ং নিয়ে জামিলার তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, তার মজিদের যৌনদাসী না হওয়া এবং নিজের স্বাভাবিক আচরণের ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা না মানা মজিদের প্রবল আত্মবিশ্বাস প্রথমবারের জন্য টলিয়ে দেয়, মজিদ হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। খুব সংক্ষেপে দেওয়া লালসালু’র আখ্যানের এই রূপরেখা সাহায্য করবে আমাদের কিছু প্রশ্নে যেতে, কিন্তু তার আগে কিছু কথানাট্যটি নিয়ে।
নির্দেশক অবন্তী চক্রবর্তী এই নাট্যটি বেঁধেছেন বেশ চড়া সুরে, যার ফলে বেশির ভাগ চরিত্রই উচ্চকিতভাবে এসে পৌঁছায় আমাদের কাছে। একটি বৃদ্ধার ছোট্ট চরিত্র নাট্যের অন্তিমলগ্নে স্বপ্লকালের জন্য মঞ্চে আসে; যেটুকু সময় সে মঞ্চে থাকে তার পুরোটাই জুড়ে থাকে অতি উচ্চগ্রামে মজিদের বিরুদ্ধে তার বিষোদ্গার। সমস্যা হচ্ছে, গোটা নাট্য জুড়েই উচ্চগ্রাম এতটাই ছেয়ে থাকে যে এই দৃশ্যের উচ্চগ্রামের কিছু যুক্তি থাকলেও, নাট্যের এই মুহূর্তটা যেন over the top হয়ে যায়। ভাবনা আসে, গ্রাম্য জীবন ধরতে গেলে চড়া দাগের শরীরী অভিনয়, উচ্চগ্রামে সংলাপ বলা – এটা কী অনিবার্য? মজিদের ভূমিকায় বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য উচ্চগ্রামের এই পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকেও, নিজের মত করে তার চরিত্রটিকে চলাফেরায় ও স্বরনিক্ষেপণের একটি নিখুঁত মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত রেখে সম্ভবত তার অভিনয় জীবনের সেরা কাজটি করলেন। মজিদ চরিত্রটি বেশ জটিল – সে যখন পুরদস্তুর ছড়াচ্ছে তার ধর্মের বিষাক্ত জাল, তখনও থেকে থেকেসে শুনতে পায় তার মা তাকে ডাকছে তার হারিয়ে যাওয়া সরল জীবনে ফিরে যেতে; আমরা ধরতে পারি চরিত্রটির মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের জায়গাটা। তাছাড়া, চরিত্রটি সকল বিচারেই নঞর্থক; প্রায় গোটাটাই অন্ধকার, এরকম চরিত্র বাংলা নাটকে খুব বেশি নেই। তবু, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে দর্শকের মনোযোগ মজিদ টেনে রাখল তার কারণ বিপ্লবের এই চরিত্র নির্মাণ। ধমকানো চমকানোর সময় যে বিপ্লব নিজেকে যেন একটু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিলেন, শঠ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার সময় তিনি বেঁকিয়ে চুরিয়ে ছোট ও সর্পিল করলেন নিজেকে। তিনি যত্নবান ছিলেন যাতে তার মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি মজিদের ভাবনার হদিশ দেওয়ায় সক্ষম হয়। খুব উঁচুমানের, পরিশীলিত অভিনয় না হলে চরিত্রের প্রতি দর্শকের গভীর বিরাগ তৈরী করেও শেষ পর্যন্ত অভিনয়গুণে তাদের মনে দাগ কাটা যায় না – বিপ্লব ঠিক সেই কাজটাই করেছেন। এছাড়া, চরিত্রবহুল এই নাট্যে যারা নজর কেড়েছেন তারা হলেন শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায় (ফকির), সৃষ্টি গুপ্ত (রহিমা), শ্বেতা বাগচী (জামিলা), পায়েল মুখোপাধ্যায় (আমিনা) প্রমুখ।
লালসালু’র আখ্যান নিয়ে যে মূল প্রশ্নটি জাগে (যা অবশ্য উপন্যাসেও বিদ্যমান) তা এটাই যে প্রথমার্ধে যে আখ্যান ধর্মকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর সামাজিক সমস্যার গভীরে প্রবিষ্ট হয়, দ্বিতীয়ার্ধে সেই আখ্যান তার পরিধি সংকুচিত করে নজর ফেলে ব্যক্তিমানুষ মজিদের ওপর। যে আখ্যান শুরুতে ব্যাপ্ত ছিল তা যেন আচমকা ছোট হয়ে গেল; দর্শকের দিক থেকে বললে, যে আখ্যানে আমরা প্রথমে নিজেদের বসাতে পারছিলাম(কারণ সমাজের কথা বলা মানে তো আমাদেরই কথা বলা),পরে সে আখ্যানের বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে হয় মজিদের পচন ও পতন (মাথায় রাখার, মজিদের সাথে একাত্ম হওয়া সম্ভব নয়)।
তবে, লালসালু সবচেয়ে বড় করে যে প্রশ্নটা তুলতে বাধ্য করে তা যতটা অস্বস্তিকর, ততটাই জরুরী। বাংলা নাটক আদতেও চিরাচরিতভাবে যেখানে হিন্দু বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতির চর্চায় নিমজ্জিত, সেখানে এই নাট্যটি সেই অত্যন্ত বিরল একটি টেক্সট যা পশ্চিমবঙ্গেরমঞ্চে সামনে তুলে আনে মুসলমান সমাজ জীবন (আরেকটি নাট্য যা একাজ হালে করেছে তা হল রত্না রশিদের রচনার ওপর আধারিত চন্দন সেনের নাটক, বিয়ে-গাউনি কাঁদন-চাপা, থিয়েটার ওয়ার্কশপ প্রযোজনা)। কিন্তু, ২০১৮ সালের ভারতবর্ষে যখন উগ্র হিন্দুত্ববাদের আস্ফালন আর এই রাজ্যেও থেকে থেকে তার রক্তক্ষয়ী মাথা চাড়া দেওয়া দস্তুর হয়ে উঠেছে, ঠিক তখনই লালসালু’র মঞ্চায়ন আমাদের ভাবায়। এই নাটকে যে মুসলমান সমাজ আমরা পাই তা অনপেনয়ভাবে ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আধুনিক শিক্ষাকে অস্বীকার করা এবং নারী-অবমাননাকারী। এই নাটকের বা নাট্যের টেক্সটের কোনো পাঠই এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না যে লালসালু মুসলমান ধর্মের সমস্যার কথা বলার মধ্যে দিয়ে হিন্দু বা শিখ বা খ্রীস্টান ধর্মের সমস্যাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করছে – লালসালু কেবল ও কেবলমাত্র মুসলমান সমাজের কথাই বলে। কথা হচ্ছে, বর্তমান ভারতবর্ষে/পশ্চিমবঙ্গে লালসালু’র মত একটি cultural text কী পরোক্ষভাবে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদকেই পুষ্ট করে না? এই কাজটি কী বর্তমানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে থাকা অতি নিরাপদ একটি কাজ নয়? নাট্য দেখাকালীন এই ভাবনাগুলো যেহেতু মগজে ভিড় করে আসে, একদম অন্তিম কম্পোজিশনটি, যেখানে জামিলার পা উঠে যায় লালসালু আবৃত পীরের কবরে– যার মধ্যে সম্ভাবনা ছিল এমন একটি প্রবল অভিঘাত সৃষ্টি করার যা ছড়িয়ে পড়বে মঞ্চ প্রেক্ষাগৃহ ছাপিয়ে সমাজের প্রত্যন্ত প্রান্তে –আমাদের কাছে নিতান্তই একটি ফাঁপা ইমেজ হয়েই রয়ে যায়।