আভাষ দক্ষিণ কলকাতা’র প্রযোজনায় এবং শেখর সমাদ্দারের নির্দেশনায় গত ৩রা ফেব্রুয়ারি আকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে মঞ্চস্থ হল ‘লহরীর রাজহংস’। হিন্দী সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক মোহন রাকেশের হিন্দী নাটক ‘লহরো কে রাজহংস’ বাংলায় রূপান্তরিত করেছেন শ্রাবস্তী রায়। অশ্বঘোষের মহাকাব্য ‘সৌন্দরানন্দ’ র অনুপ্রেরণায় মোহন রাকেশ এই নাটকটি রচনা করেন। নাটকের উপজীব্য ঐতিহাসিক ঘটনা হলেও তার সাথে নিজের কল্পনা সুন্দরভাবে মিশিয়ে তিনি এটি নির্মাণ করেছেন। নাটকটির বর্তমান রূপটি ১৯৬৮সালে রচিত। যদিও কুড়ি বছর ধরে নানা পরিমার্জনার দ্বারা এই নাট্যরূপটি পরিগ্রহ করে। মহাকাব্যের প্রেরণায় রচিত হওয়ায় নাটকটিতে কাব্যিক সংলাপের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলা রূপান্তর ‘লহরীর রাজহংস’এর সংলাপেও কাব্যময়তার ছাপ পাওয়া যায়। এ নাটকে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় আধুনিক মানবিক অন্তর্দ্বন্দ্বের ছবি ফুটে উঠেছে।
Previous Kaahon Theatre Review:
গৌতম বুদ্ধ বোধি লাভের পর প্রথমবার ফিরে আসছেন কপিলাবস্তুতে। ভগবান বুদ্ধের দর্শনের জন্য নগরবাসী গভীর উৎসাহে অপেক্ষমান। অন্যদিকে বুদ্ধের সৎভাই নন্দের সুন্দরী, যুবতী, এবং আত্মগর্বিতা স্ত্রী সুন্দরী রাজভবনে আয়োজন করেছেন কামনার উৎসব ‘কামোৎসব’। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে আমন্ত্রণ জানান হয়েছে এই উৎসবে। নন্দ সংসার ও সন্ন্যাস – সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা (আসক্তি) আর বুদ্ধের শরণ – এই দুয়ের মধ্যে পড়ে দ্বিধাগ্রস্ত এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ একজন মানুষ। যে বুঝে উঠতে পারে না কোন পথটি বেছে নেবে। সুন্দরী তার মোহপাশে বেঁধে রাখতে চায় স্বামী নন্দকে। নন্দ শিকারে গিয়ে সারাদিন হরিণের পিছনে ছুটে তাকে তীরবিদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়। ফিরে আসার সময় তিনি দেখতে পান সেই হরিণটি মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, মৃত্যুর কারণ ক্লান্তি! ঘটনাটি তাকে বিচলিত করে তোলে। রাজভবনে স্ত্রী সুন্দরীর কাছে ফিরে এসেও তার মন ভগবান বুদ্ধের সাথে সাক্ষাৎ এর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এদিক কামোৎসবে আগত প্রথম ও একমাত্র অতিথি মৈত্রেয়র কাছে জানা যায় এই উৎসবে আর কোনো অতিথি আসবে না কারণ তারা সবাই ভগবান বুদ্ধের দর্শনে যাবে। একথা শুনে সুন্দরীর অহংবোধে আঘাত লাগে এবং সে উদাস হয়ে পড়ে। মৈত্রেয় তাকে এই উৎসব দুদিন পরে করবার পরামর্শ দেয়। এর উত্তরে সুন্দরী বলে ‘এ উৎসব হল কামনার উৎসব, আমি আমার আজকের কামনাকে কালকের জন্য ফেলে রাখতে পারি না’। নন্দ যখন জানতে পারে যে ভগবান বুদ্ধ তার ভবন দ্বারে এসে ভিক্ষা না পেয়ে খালি হাতে প্রস্থান করেছে তখন সে ভীষণ বিচলিত ও দুঃখিত হয় এবং অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে বুদ্ধের অবস্থানস্থলে ছুটে যায়, তার সাথে সাক্ষাৎ করে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য। সেখানে ভিক্ষু আনন্দ বুদ্ধের আদেশে তার কেশ মুণ্ডন করে দীক্ষা দান করেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নন্দ ভাইয়ের সম্মানার্থে বাধা দিতে পারে না কিন্তু সে এই দীক্ষা অস্বীকার করে। নন্দের দীক্ষার খবরে সুন্দরীর মন আঘাত প্রাপ্ত হয়, এবং তার মনে হয় বুদ্ধের আধ্যাত্মিক প্রভার কাছে তার সৌন্দর্য, মোহ, সমর্পণ সবকিছুই যেন ম্লান হয়ে গেছে। কামোৎসবে নগরীর কেউই আসেনি এমনকি তার স্বামী নন্দকেও সে আটকে রাখতে পারে নি। নন্দ ও সুন্দরীর মধ্যে এই পারস্পরিক অন্তর্দ্বন্দ্ব এক বিস্ফোরক রূপ নেয়।
‘লহরীর রাজহংস’ নাটকে সাংসারিক সুখ আর আধ্যাত্মিক শান্তির পারস্পরিক বিরোধ ও তার মাঝে আটকে পড়া ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানসিক দ্বন্দ্বের ছবি ফুটে উঠেছে। এই দ্বন্দ্ব আবার অন্যদিকে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের অন্তঃবিরোধও বটে। মূলত সংলাপ আর নানা প্রতীকের মাধ্যমে নাটকটি গঠিত হয়েছে। যেমন সরোবরের রাজহংস, মৃত হরিণ ইত্যাদি প্রতীক স্বরূপ। শশাঙ্ক ও নীহারিকার নৃত্যের মাধ্যমে রাজহংসের প্রতীকি উপস্থিতি এক সুন্দর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। নাটকটির সফল মঞ্চায়নের প্রধান শর্ত হল অভিনয়। নন্দর ভূমিকায় শেখর সমাদ্দারের অভিনয় নাটককে উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। তার উচ্চারণ ও অভিব্যক্তির মাধ্যমে একজন পুরুষ সংসারে তার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রেখে নিজের কাজ করতে পারার মধ্যে যে টানাপোড়েনে ভোগে সেটা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তাকে যোগ্য সংগত করেছেন সুন্দরীর চরিত্রে কস্তুরী চক্রবর্তী। অহংকারী ও আত্মগর্বিতার ভাব তার চরিত্র চিত্রণে সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তবে চরিত্রের ‘চপলতা’ ও ‘উছ্বলতা’ প্রকাশে সংলাপ উচ্চারণ ও চলাফেরার দ্রুততা সামান্য কম হলে দুটি চরিত্রের মধ্যে অভিনয়ের যুগলবন্দী আরো উপভোগ্য হয়ে উঠত। সকলের অভিনয়ের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায় যা সামগ্রিক প্রযোজনাটিকে সমৃদ্ধ করে। অলকার চরিত্রে ঐন্দ্রিলা ঘোষ ও ভিক্ষু আনন্দ চরিত্রে হিরন্ময় নাথের অভিনয় বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে।
সৌমিক-পিয়লীর মঞ্চ ভাবনায় বাস্তবিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। পর্দা খোলার সাথে সাথে আমাদের পৌঁছে দেয় প্রাচীন কপিলাবস্তু নগরের রাজপ্রাসাদের অন্তপুরে। সম্পূর্ণ নাটকটিতে একটিই দৃশ্যপট, মানে কোনো দৃশ্য পরিবর্তন না থাকায় মঞ্চ পরিকল্পনা কিছুটা সুবিধাজনক হয় এবং নাট্যগতি বাধাহীন ভাবে টানটান ভাবটি বজায় রেখে এগিয়ে যেতে পারে।
সুদীপ সন্যালের আলো শুধুমাত্র যথার্থ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তাই নয়, নাটকের মূল ভাবটিকেও সুন্দরভাবে বিধৃত করেছে। মঞ্চ ও আলো যে দৃশ্যময়তা সৃষ্টি করেছে, স্বপন বন্দোপাধ্যায়ের আবহ তাকে শুধু সহযোগিতা করেছে কোনো অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করতে বা শাব্দিক নাটকীয়তা তৈরী করতে পারেনি। যদিও এ নাটকে শব্দের কাব্যিক প্রয়োগের স্থান ছিল। মধুমিতা দামের পোষাক পরিকল্পনায় সুদূর অতীতের ছোঁয়া পাওয়া যায় ফলে চরিত্রগুলি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। মহম্মদ আলীর রূপসজ্জাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
আলো, মঞ্চ, আবহ, পোষাক, এবং সর্বোপরি সামগ্রিক অভিনয় ও নির্দেশকের ভাবনার সমন্বয়ে একটি সার্থক নাট্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ‘লহরীর রাজহংস’। নাটকটি ইদানিং কালে বাংলা থিয়েটারের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বর্তমান ভোগস্বর্বস্ব সমাজে ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিকতার গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে অন্ধকূপের দিকে এগিয়ে চলেছি সেখানে থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সচেতন করবার প্রয়াস করে এ নাটক।