গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি আকাদেমি মঞ্চে ‘সংসৃতি’ নাট্যদল তাদের নতুন প্রযোজনা ‘কোথাকার চরিত্র কোথায় রেখেছ’ র প্রথম অভিনয় অনুষ্ঠিত করলেন। মূল রচনা ইতালীয় নোবেল জয়ী নাট্যকার তথা সাহিত্যিক লুইজি পিরানদেল্লো। তাঁর লেখা নাটক ‘Six Characters in Search of an Author’এর বাংলা রূপান্তর করেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এবং ১৯৬১ সালে সেটি নান্দীকার নাট্যদল অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ করেছিল। বাংলা রূপান্তরটির নাম ছিল ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’। নান্দীকারের সূচনাপর্বে এই প্রযোজনাটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সেই রূপান্তরটিকে কিছুটা পরিমার্জন করে বর্তমান নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়।
Previous Kaahon Theatre Review:
পিরানদেল্লো তার ‘Six Characters in Search of an Author’ নাটকটি লেখেন ১৯২১ সালে। চিরাচরিত নাট্যরচনার থেকে এই নাটকের রচনারীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। জীবন ও শিল্পের দ্বন্দ্ব, তথাকথিত বাস্তব (reality) ও মায়া (illusion), নানা ধরনের মানবিক সম্পর্ক ও তাদের ভিন্ন ভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক স্তর প্রভৃতি জীবনের বাস্তবতাকে লেখক থিয়েটারের তৈরী করা বাস্তবতার সাথে একাত্ম করার চেষ্টা করেছেন তার রচনায়। সাধারণত নাটকের চরিত্ররা পূর্বনির্ধারিত লিখিত ছকের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। এই নাটকের চরিত্ররা যে ঘটনার কথা বলে এবং সাথে সাথে অভিনয়ও করতে থাকে সেটা তাদের (চরিত্রের) জীবনে ঘটে গেছে, সেই ঘটনা মূল নাটক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে একটা নাটকের মধ্যে আরেকটা নাটক অভিনীত হতে থাকে আর মূল নাটকটিকে সরিয়ে সেটিই মঞ্চে চলে আসে। চরিত্রেরা অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরস্পরবিরোধী কথবার্তা বলে, ফলে এটা বোঝা সম্ভব হয় না যে অতীতে প্রকৃত কী ঘটনা ঘটেছিল। বাস্তব জীবনেও আমরা প্রত্যেকে প্রকৃত ‘আমি’ টাকে বহির্জগতে যতটুকু প্রকাশ করতে চাই বা প্রকাশ করি সেটুকু সত্যিই প্রকাশ্যে আসে কিন্তু তার বাইরে বা ভিতরে অনেক সত্যই অপ্রকাশিত থেকে যায়। সুতরাং প্রকৃত ‘আমি’ কখনই সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশিত হয় না। বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যকার সূক্ষ্ম রেখার ব্যবধান আমাদের সর্বদা বিভ্রান্ত করতে থাকে। এইসব নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় এই নাটকের মধ্যে। এটি সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক নাটক, হৃদয়ের গহনে প্রবেশ করে তাকে খুঁড়ে দেখায় এই নাটক। নাটকের বিষয়বস্তু করুণ ও দুঃখদায়ক হলেও নাট্য উপস্থাপনার ভঙ্গিটি থেকে একটা হাস্যরসের উপাদান উদ্ভুত হয়।
এবার আসা যাক আলোচ্য নাটক ‘কোথাকার চরিত্র কোথায় রেখেছ’র কথায়। প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করলে দেখা যায় মঞ্চের পর্দা খোলা, সেটের নানা উপকরণ ইতস্তত ছড়ানো, নাটকের মহড়ার প্রস্তুতি চলছে। তারপর একে একে সব কলাকুশলীরা উপস্থিত হলে নাটকের মহড়া শুরু হয়। মূল নির্দেশকের অনুপস্থিতিতে তার সহকারীর উপর ভার পড়েছে মহড়া চালাবার। আলো, আবহ, সেট প্রভৃতি নাট্যউপাদান সহযোগে মহড়া শুরু হয়। মহড়া শুরুর অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হয় ছ’জন অপরিচিত মানুষ (চরিত্র)। একজন পুরুষ, তার পুত্র, তার প্রাক্তন স্ত্রী, প্রাক্তন স্ত্রীর দুই কন্যা ও এক পুত্র। পুরুষটি দাবি করে তারা অসম্পূর্ণ চরিত্র, একজন নাট্যকারের সন্ধানে এসেছেন যিনি তাদের কাহিনীকে সম্পূর্ণ করবেন। সহকারী পরিচালক প্রথমে তাদের পাগল মনে করে কিন্তু তারা তাদের নিজেদের জীবনের ঘটনা নিয়ে যেভাবে তর্ক ও পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা চালাতে থাকে তা থেকে তাদের জীবনকাহিনী উন্মোচিত হতে থাকে, ফলে সে (সহকারী পরিচালক) তাদের ঘটনা শুনতে আগ্রহী হয়। তারা তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা দিয়ে নাটক গড়ে তুলতে চায় এবং তার মাধ্যমে তাদের চরিত্রের সম্পূর্ণতা পেতে চায়। নাটকের অভিনেতাদের দ্বারা তাদের চরিত্রের অভিনয় মনোমত হয় না তাই তারা নিজেরাই অভিনয় করে দেখায় তাদের অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। কিন্তু ঘটনার সত্যতা নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক এবং যুক্তির পাল্টা যুক্তি গঠন করতে থাকে। এভাবে ঘটনাক্রম এগিয়ে চলে। শেষে তাদের বর্ণিত ঘটনার পরিণতি অভিনয় করতে হয় না, বাস্তবিকই ঘটে যায়। সহকারী পরিচালক প্রচন্ড বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যে এতক্ষণ যা ঘটল তা বাস্তব না কল্পনা? তার মনে হয় এই দুঘন্টা বৃথাই নষ্ট হল!
নাটক শুরুর নির্ধারিত সময়ের পনের মিনিট আগে থেকেই মঞ্চের পর্দা খুলে রেখে নাটক শুরুর আগেই দর্শকদের নাটকের সাথে একাত্ম করবার চেষ্টা খুব নতুন নয়, তবে কিছু দর্শক বিভ্রান্ত হন সময়ের পূর্বে নাটক শুরু হয়ে গেছে ভেবে। এই বিভ্রান্তি এই নাটকের পক্ষে প্রার্থিত। নির্দেশক সেই লক্ষে সার্থক। নাটকের নামটি – ‘কোথাকার চরিত্র কোথায় রেখেছ’ – চমৎকার ও শ্রুতিমধুর, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কাব্যগ্রন্থের নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দেওয়া, তবে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত কৃত রূপান্তরটির নামটি (নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র) নাটকের বিষয়ের সাথে আনেক বেশি সাযুজ্যপূর্ণ ছিল।
নাটকটি মূলত সংলাপনির্ভর তাই অভিনয় এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নাটকে অনেকগুলি চরিত্র থাকলেও মূল তিনটি চরিত্রের উপর নাটকটি দাঁড়িয়ে থাকে, বাবা, সৎমেয়ে ও সহকারী পরিচালক। সৎমেয়ের ভূমিকায় মোনালিসা চট্টোপাধ্যায় নাটকের সিংহভাগ ভার নিজের কাঁধে বহন করেছেন। তিনি চরিত্রটি সঠিকভাবে আত্মস্থ করেছেন ফলে অভিনয় করবার আলাদা পরিশ্রম তাকে করতে হয়নি। বাবার চরিত্রে অসীম রায়চৌধুরী ও সহকারী পরিচালকের চরিত্রে অভ্র মুখোপাধ্যায় যোগ্য সঙ্গত করেছে তাদের চমৎকার অভিনয়ের মাধ্যমে। নির্দেশক অভিনয়ের ব্যাপারে অভিনেতাকে কোন রকম ছকে না বেঁধে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। এই স্বাধীনতা গ্রহণের ক্ষেত্রে মোনালিসা যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন অন্যদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। যদিও সকল সহ অভিনেতাদের মধ্যে একটা প্রশিক্ষিত অভিনয়ের প্রতিফলন ছিল।
আলো (সুদীপ সন্যাল) বা আবহ (আনিন্দ্য নন্দী) এখানে সবটাই পূর্বপরিকল্পিত নয়, নাটকের পরিবেশ বা পরিস্থিতি যেভাবে এগোয় বা পরিবর্তিত হয় আলো ও আবহ সেই অনুসারে সাহায্য করে। তাই আলো ও আবহের পরিকল্পনার চেয়ে প্রক্ষেপণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মঞ্চসজ্জা হিসেবে স্থির কিছু থাকে না, বিভিন্ন মঞ্চ উপাদান প্রয়োজন মত অভিনেতারাই সরিয়ে নিয়ে সেট তৈরী করে নেয়। দেখলে মনে হয় সবটা তাৎক্ষণিক ঘটছে, তবে অবশ্যই সামগ্রিক একটা পরিকল্পনা পূর্বেই সাধারণভাবে ছকে রাখা হয়। মঞ্চপরিকল্পক হিসেবে আলাদা কোনো নাম না থাকায় এটা অনুমান করা যায় যে ভাবনাটি নির্দেশকের। মঞ্চ উপকরণ হিসেবে পূর্ববর্তী প্রযোজনায় ব্যবহৃত জিনিসপত্রই ব্যবহার করা হয়েছে। রূপসজ্জা (মহম্মদ আলী) বেশ স্বাভাবিক তাই চরিত্রগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
নাটকে নিহিত মূল বিষয়টি বিশেষ কোন স্থান ও কালের মধ্যে আবদ্ধ নয়, ফলে এর প্রাসঙ্গিকতা সর্বদাই বর্তমান। আটান্ন বছর আগের নাট্যরূপান্তরের সামান্য কিছু পরিবর্তন করে, নাটকের মূল অংশের সংলাপ প্রায় এক রেখেও বর্তমান প্রযোজনাটিকে কখনই dated লাগে না। মনে হয় সংলাপগুলি সাম্প্রতিক কালেই রচিত।
গত ২৫ বছরে সংসৃতি দলটি দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় বেশ কয়েকটি মনে রাখার মত ভালো প্রযোজনা উপহার দিয়েছে, এই নাটকটি সেই তালিকায় আরো একটি সংযোজন। কিন্তু বাংলা থিয়েটারে নতুন বিষয়-ভাবনা ও নাটকের অভাব সেই থেকেই গেল।