বেলঘরিয়া অভিমুখ শুধুমাত্র এই কারণেই স্বাভাবিকভাবে খুশি হতে পারেন যে তাদের প্রথম প্রযোজনা কোজাগরী ইতিমধ্যে দুইডজনবার মঞ্চস্থ হয়ে গেছে; অর্থাৎ, সাধারণ হিসেব মত নাটক হিট্। কিন্তু, আমরা সবাই জানি যে নাটক ভালো চললেই এটা সব সময় অবধারিত ভাবে বলা যায় না যে নাটক ভালো হয়েছে। তবে, কোজাগরী নাটকের চব্বিশ ও পঁচিশতম শো দেখে (গিরিশ মঞ্চ, ২৭/০৪/২০১৭ এবং মিনার্ভা, ২৭/০৬/২০১৭ ) ‘ভালো’ বিশেষণটি ব্যবহার করতে আমি খুব দ্বিধান্বিত হব না।
কোড রেড – সমকালীন ভাবনার শৈল্পিক দলিল https://t.co/9ugTvPrZ3j via @Crunchify
— kaahon (@kaahonwall) June 29, 2017
কৌশিক চট্টোপাধ্যায় এই নাটক লিখেছেন ও পরিচালনা করেছেন। মার্কিন লেখক হাওয়ার্ড ফাস্টের উপন্যাস সাইলাস টিম্বারম্যান– র ওপর ভিত্তি করে কৌশিক যে নাটক লিখেছেন তার কিছু গুণাবলীর মধ্যে বিশেষ দুটি আমি উল্লেখ করব। প্রথমত, এমন সাবলীল স্বচ্ছন্দতার সাথে কৌশিক উৎস টেক্সটের ভাবানুগ্রহণ/অনুবাদ করেছেন যে আমরা যখন নাটক দেখি, তখন সাংস্কৃতিক ভিন্নতার শক্ত পাথরে আমাদের হোঁচট খেতে হয়না। অ্যামেরিকায় ম্যাকার্থি জামানায় মুক্তচিন্তা করা ও রাষ্ট্রের মতের বিরুদ্ধে যাওয়া মানুষজনকে কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর দমন, নিপীড়ন চালিয়ে একটা ভয়ের পরিমণ্ডল তৈরী করার তীক্ষ্ণ সমালোচনা – এই ছিল সাইলাস টিম্বারম্যান -র প্রতিপাদ্য বিষয়। উপন্যাসের শিক্ষক চরিত্র সাইলাস টিম্বারম্যানকোজাগরী নাটকে হয়ে যান শিক্ষক শৈলেশ কাষ্ঠ (নামই তাদের গাছপ্রেম নির্দেশ করে)। টিম্বারম্যানের মতই শৈলেশ কলেজের প্রাচীন শালবন কাটার প্রতিবাদ করেন এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই কলেজের পরিচালক সমিতির (যা লোভী, ক্ষমতার দম্ভে মত্ত ও আদতে হিংস্র রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত) রোষে পড়েন। ভয় ও আত্মকেন্দ্রিকতা কাটিয়ে একজন সাধারণ, নির্বিবাদী মানুষের প্রতিবাদ করার গল্প হাজির করে কোজাগরী এবং আমাদের সামাজিক স্মৃতিতে থাকা এই গোত্রের ঘটনার সাথে মিশে কোজাগরী হয়ে ওঠে আমাদেরই গল্প। দ্বিতীয়ত, যে বাংলা ভাষা কৌশিক ব্যবহার করেছেন তার আছে ঝরঝরে চলনের সাথে মিশে থাকা এক ধরণের ঋজুতা। কাব্যের বিধিবদ্ধ কাঠামোও নেই, আবার রাস্তার উচ্চারণের আকৃতিগত শিথিলতাও নেই – এই ভাষা ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে প্রয়োজন মাফিক। স্বর ও সুরের সূক্ষ্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে এই ভাষা বিভিন্ন চরিত্রের মানসিক, বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট নির্দেশ করতেও সক্ষম।
কোজাগরী দর্শকদের তৃপ্তি দিয়ে উঠতে পারে প্রধানত এই কারণে যে গোটা প্রযোজনাই নিয়ন্ত্রিত হয় একটা সংযত শৃঙ্খলাবোধের দ্বারা। বাস্তবধর্মী মঞ্চ (মঞ্চ ভাবনা জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়) অল্প কিছু আসবাব দিয়ে ইঙ্গিত করে কলেজের প্রিন্সিপালের চেম্বার, আর একটু রদবদল ঘটিয়ে, মুখ্য চরিত্রের বসার ঘর। কিন্তু ওপর থেকে ঝুলতে থাকা অতিকায় কুঠার যার ফলায় থাকে বিস্ফারিত চোখ, বাস্তব ধর্মীর ভেতরে অনুপ্রবেশ ঘটায় সাঙ্কেতিকের। প্রিন্সিপালের চেম্বারেএই কুঠার ঝোলে একদম মাঝখানে, নিজের ভয়াল উপস্থিতি জাহির করে। আবার ঘটনাস্থল যখন হয় মুখ্যচরিত্রের বাড়ি, ভয়ের শাসানি তখনও থাকে, একটু কম প্রকট ভাবে; কুঠার তখন নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যায় এককোণে, যেখান থেকে ঘটনা প্রবাহের ওপর তার নজরদারি জারি থাকে। নাটকের প্রয়োজনে প্রপের ছোট ছোট কিন্তু অর্থপূর্ণ ব্যবহার নজর কাড়ে – রকিং চেয়ারের দুলুনি বা টেবলল্যাম্প জ্বালানো নেভানো চরিত্রের মানসিক দোলাচলের মেটাফর হয়ে ওঠে। যখন প্রধান চরিত্রের কর্ম ও সংসার জীবনে নেমে আসে দুঃসময়, প্রায় অন্ধকার মঞ্চে নির্দিষ্ট অথচ হাল্কাভাবে আলোকিত রবীন্দ্রনাথের ছবি তখন জেগে থাকে ধ্রুবতারার মত। নাট্যের শেষ পর্যায়ে উপস্থিত হওয়া গাছটিকে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান করা হয় (আলো পরিকল্পনা করেছেন দীপঙ্কর দে)।একেবারে অন্তিমমুহূর্তে, গাছ যখন ভোরের আভাস লাগা আকাশের গায়ে স্পষ্ট সিলুয়েট হয়ে যায়, তখন আমরা দেখি গাছের ডালপালা আসলে বহু বাড়ানো হাতের আঙ্গুল। এখানেও আবার বাস্তবধর্মীর সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে সাঙ্কেতিক। কোজাগরী নাট্যে যে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহৃত হবে (আবহ, উজান চট্টোপাধ্যায়) তা একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী, কারণ এই নাটকের ভাবাদর্শগত বিষয়বস্তু অনেকাংশেই রবীন্দ্র-ভাবনা দ্বারা আলম্বিত। গান ছাড়া যে আবহসঙ্গীতের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে তা নাটকের সেই মুহূর্তের মেজাজকে ফুটিয়ে তুলেছে সার্থকভাবে; দৃশ্যান্তরে যাওয়ার সময়ে বুদ্ধিদীপ্ত আবহের ব্যবহার প্রশংসার দাবী রাখে। নাটকের একদম শেষে গান এত উচ্চগ্রামে বেজেছে যে তা নাট্যের অন্য অংশের সংযমের ছন্দের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
অভিনয় এই নাটকের সম্পদ। মুখ্য ভূমিকায় হোক বা পার্শ্ব চরিত্রেই হোক, সকল অভিনেতার কাজেই শৃঙ্খলাবদ্ধ দীর্ঘ অনুশীলনের ছাপ স্পষ্ট। নাটকটি তৈরীর ক্ষেত্রে যে আধিক্যহীন ও সংযমী নান্দনিক অভিমুখ বেছে নেওয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে, তা বিদ্যমান নির্দেশক যেমন ভাবে অভিনেতাদের চালনা করেছেন তার মধ্যে এবং অভিনেতারা যেভাবে পারফর্ম করেছেন তারও মধ্যে। দুটি উদাহরণ দেব -উদ্ধত, অভব্য ছাত্রনেতা, যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত, সে তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ঘোষণা করে মাথার ওপর সটান হাত তুলে দিয়ে তার বেয়াদব তর্জনী কয়েক বার শূন্যে ঘুরিয়ে। অন্য একটি দৃশ্যে কলেজ-শিক্ষক প্রধান চরিত্রের স্ত্রী লক্ষ্য করেন, কিছুটা তফাত থেকে, কেমন ভাবে তার স্বামী এক সহকর্মীর যুক্তি ধীরে ধীরে মেনে নিচ্ছেন। এই সহকর্মী একজন তেজী মানুষ, রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় এবং (গুরুত্বপূর্ণভাবে) মহিলা হিসেবে বেশ আকর্ষণীয়। এই দৃশ্য চলাকালীন স্ত্রী, যার যাবতীয় ভাবনা স্বামী, কন্যা ও সংসার ঘিরে, তার তীব্র দৃষ্টিতে ফুটিয়ে তোলেন ঈর্ষা মিশ্রিত হতাশ ক্ষোভ। মাথায় রাখতে হবে, এই দৃশ্যে স্ত্রী কিছুটা ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকেন এবং দর্শকের নজর তখন মূলত থাকে অন্য চরিত্রদের ওপরে; আক্ষরিকই পার্শ্ব অবস্থান থেকে তিনি তার এই অংশের অভিনয় করে চলেন। আমি সচেতন ভাবেই এই উদাহরণ দুটি দিলাম (এই ধরণের নাট্য মুহূর্ত আরো আছে নাটক জুড়ে) এটা বোঝাতে যে সংযম বোধ কিভাবে কেবল শরীরের ভাষা দিয়েই মানে সৃষ্টি করেছে, সংলাপ ছাড়াই। নাটকের শেষে ঘোষণা করা হয়(গিরিশ মঞ্চ, ২৭/০৪/২০১৭) এই প্রযোজনা তারকাহীন এবং এই ভাবনাকে সম্মান জানিয়ে আমি কোন অভিনেতার নাম আলাদা করে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম। শুধু এটাই বলা থাকুক যে অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোজাগরী সফল অভিনেতাদের সমষ্টিগত অবদানের জন্য।
কোজাগরী প্রযোজনাটি কি ফর্ম ও পারফরম্যান্সের নিরিখে বাংলা নাট্যচর্চাকে একটু হলেও এগিয়ে নিয়ে যায়? একেবারেই না। বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের ইতিহাসের দিকে খুব দ্রুত চোখ বোলালেই দেখা যাবে যে বিগত দিনে এমন অনেক কাজ হয়েছে যা কোজাগরীর মতই সফল এবং তা প্রায় একই কারণে।কোজাগরীর নির্মাতারা তাদের নিজেদের প্রথম কাজে এমন এক শৈল্পিক চ্যালেঞ্জ খাড়া করেছিলেন যার মধ্যে তেমন নতুন বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু আছে একটি নতুন নাট্যদলের একসাথে দাঁড়িয়ে সামগ্রিক চ্যালেঞ্জ স্বীকার করা এবং তা অতিক্রম করার সাফল্য। এই সমষ্টিগত প্রয়াস ও তার সাফল্য আমাদের কাছে এক পরম প্রাপ্তি। আমরা আশা করব বেলঘরিয়া অভিমুখ তাদের ভবিষ্যতের কাজে পারফরম্যান্সকে এমন জায়গায় এগিয়ে নিয়ে যাবে যা এখনো অনাবিষ্কৃত।
দীপঙ্কর সেন