আমরা অনেক সময় মনে করি নাটকের টেক্সট ভালো হলেই সেটা দর্শকের মাথায়/মনে পৌঁছবে। এই মনে করা যে খুব ভুল সেরকমও বলা যায় না। কিন্তু কিছু কিছু ভালো টেক্সট এমনও আছে, যেগুলো পারফর্মেন্সের উপরে অনেকখানি নির্ভরশীল। বিশেষত সাইকোলজিক্যাল প্লে, থ্রিলার বা অ্যাবসার্ড প্লে। মানে হচ্ছে, যে নাটকে দর্শককেও নাটকে ঢুকে যেতে হয়, হলঘরে বসে শুধু চোখ খুলে দেখলেই যেটা মাথায় ঢুকে পড়ে না, নাটকে পারফর্মেন্স অনেকটা বাড়ির ভিতরের ঘরের দরজার মত কাজ করে। ভিতরের দরজাটা খুলে যেরকম অতিথিকে বাইরের ঘর থেকে আরেক ঘরে ঢুকতে দি আমরা, তেমনই এই সমস্ত নাটকের ক্ষেত্রে বাইরের স্তর থেকে ভিতরের স্তরে পৌঁছনোর মত একটা দরজার কাজ করে পারফর্মেন্স। আপনি দরজাটা না খুললেও অতিথি আশ্রয়হীন হতেন না, কিন্তু ভিতরের ঘরের দরজাটা খুলে দিলেন বলে তিনি আপনার ঘরটা আবিষ্কার করতে পারলেন!
আন্তন চেকভের সিগাল। বিশ্বের বিখ্যাততম নাটকগুলির একটা। বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন সময়ে অনুদিত হয়েছে নাটকটি, যার মধ্যে অন্যতম আরেক বিখ্যাত লেখক টেনেসি উইলিয়ামস এর একটি অ্যাডাপ্টেশন – “নোটবুক অফ ট্রিগরিন”। এই নাটকটা সম্প্রতি মঞ্চে উপস্থাপনা করেছেন গণকৃষ্টি নাট্যগোষ্ঠী। নাম দিয়েছেন “কিরীটীর নোটবুক”। এই অ্যাডাপ্টেশনটা করেছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় এবং নাটকটার নির্দেশনা করেছেন অমিতাভ দত্ত।
Previous Kaahon Theatre Review:
(এখানে একটা খুব সিরিয়াস অভিযোগ আছে। চেকভ অনুপ্রাণিত উল্লেখ করে ‘নাটকঃ উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়’ বলে দেওয়াটা খুব অন্যায় নয় কি? বিশেষত যখন নাটকের প্লট-সিন বিশেষ ভাবে এদিক ওদিক করা হয়নি। অনুবাদ বা অ্যাডাপ্টেশন বললে কি ক্ষতি হয়? টেনেসি উইলিয়ামস কিন্তু “নোটবুক অফ ট্রিগরিন” নাটকটিকে অ্যাডাপ্টেশন বলেছিলেন চিরকাল।)
নাটকের গল্প একটা আছে, যেটা বলে দেওয়ার কোন মানে হয় না। কারণ গল্পটা জানিয়ে দিলে আপনাকে নাটকটা দেখতে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ (?!) করতে পারব না। গল্পটা ছাড়া তাহলে কি বলি? আচ্ছা টাইটেল দিয়ে শুরু করা যাক। কিরীটী একজন লেখক, যাঁর কাছে সবসময় একটা নোটবুক থাকে। ভালো মন্দ যাহাই ঘটুক তিনি তাঁর নোটবুকে সেসব সঙ্গে সঙ্গে টুকে রাখেন। আচ্ছা বেশ। চরিত্র যখন চলেই এল তখন চরিত্রদের কথাই বলি… কিরীটীর স্ত্রী আনন্দী একজন খ্যাতনামা অভিনেত্রী… কিন্তু তাঁর ছেলে সুমনের বাবা কিন্তু কিরীটী নন। সুমন একজন উঠতি এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার ডিরেক্টর। তার পছন্দের অভিনেত্রী জরি। জরির আবার কিরীটী বাবুকে বিশেষ পছন্দ। জরির সুমনকেও বেশ পছন্দ, মাধুর ও সুমনকে বেশ পছন্দ। সুমন যে বাড়িতে থাকে মাধুও সে বাড়িতেই থাকে, কিন্তু সুমন তো নিজের বাড়িতে থাকে না, থাকে তার দেশের বাড়িতে যে বাড়িতে তার মায়ের এমন এক জামাইবাবুর তত্বাবধানে সে থাকে যার সাথে তার মায়ের বোনটির কোনদিনও বিয়ে হয়নি, উল্টে আবার অনেকে সন্দেহ করে সুমনের বাবা আসলে মায়ের ওই পাতানো জামাইবাবুটিই। (প্লটটা না বলেই মূল চরিত্র গুলোর কথা বলতে পেরেছি, বাব্বাহ!)
পুনশ্চঃ নাটকটির মাঝামাঝি তাদের ফার্মহাউসের যে রাজহংসটিকে গুলি করে হত্যা করে সুমন… সেটির কিন্তু নাটকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা সিগনিফিকেন্স থাকার কথা ছিল…
একটু গোলমেলে ব্যাপার তাই না? এখন বিষয় হল, এরকম একটা গোলমেলে গল্পকে মঞ্চে উপস্থাপিত করতে গেলে প্লট লাইনটা ছাড়াও অনেক কিছু লাগে (যে কারণে অতগুলো কথা বলতে হল শুরুতে)। মূল নাটকটায় কিন্তু পরতে পরতে লুকিয়ে রাখা ছিল অনেক কিছু, যা আমাদের নিজেদের আশা-ভরসা, ভালোবাসা, চাওয়া পাওয়া এসবের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে, নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে শেখায় নিজেকেই, এমন অনেক কিছু যা আমাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নাটকের অন্দরে, যার জন্য ১৮৯৫ তে লেখা এই নাটকটা আজ ও, ১২৪ বছর পরও এমন ভাবে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু কিরীটীর নোটবুকে এসব কিছুই পাওয়া গেল না। এই যে এতোগুলো চরিত্র, তাদের মধ্যে পারস্পরিক জটিলতা, তাদের নিজেদের মানসিক জটিলতা, ইচ্ছে, অনিচ্ছে, হতাশা, ভালো লাগা, অবসেশন, ইকুয়েশন বদলে যাওয়া… সেসব ফুটে ওঠার জন্য সঠিক পরিমিতি বোধ নিয়ে লেখা, সঠিক ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করার মত ডায়ালগ প্রয়োজন ছিল! উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের মত অভিজ্ঞ নাট্যকারের কাছ থেকে এইভাবে আশাহত হতে ভালো লাগে না, একটা সংলাপও সেভাবে নাটকের ভিতরে নিয়ে যেতে পারে না দর্শককে। নাটকের যেভাবে সাজিয়েছেন নির্দেশক সেটাও দর্শককে আলাদা কিছু ভাবতে বাধ্য করে না।তার উপর উজ্জ্বল বাবু যাওবা কয়েকটা ভালো সংলাপ তৈরি করলেন, অভিনেতারা সেগুলো পারফর্ম করতে গিয়ে কেন যে এরকম দিশেহারা হয়ে গেলেন কে জানে! একজন অভিনেতাকেও চরিত্র হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। তাই গল্পটার মধ্যে কোন ভাবেই ঢোকা যায়নি, দর্শক হিসেবে প্লটটা মাথায় ঢুকেছে, নাটকটা মাথায় ঢোকেনি।
আর হ্যাঁ, কিরীটীর চরিত্রে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের মত অনবদ্য অভিনেতাকে কেন এত কম সময়ে, এত খারাপ ডায়ালগে, এত অপরিণত সিচুয়েশনে, এত অপরিণত অভিনেতাদের মধ্যে ব্যবহার করা হল সেটা নিয়ে আলাদা করে একটা ক্ষোভের চিঠি লেখা যায়।
এভাবে বাংলা থিয়েটার কতদূর যাবে বলে ভাবছে? কোথায় যাবে বলে ভাবছে? সকলে পরিণত মনস্ক, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান অভিজ্ঞ মেন্টর। কিন্তু তাদের যেন কোন দায় নেই! আলো করেছেন মনোজ প্রসাদ, মিউজিক করেছেন গৌতম ঘোষ, সেট ডিজাইন করেছেন তাপস নীল এবং স্বর্নেন্দু সেন। এসব এলিমেন্টের কথা এক লাইনে বলার কথা না, এগুলো একটা নাটককে নাটক হয়ে উঠতে কোন অংশে কম সাহায্য করে না, উপরন্তু ভালো নাটকে এগুলোও এক একটা চরিত্র, এক একটা দরজা হয়ে ওঠেন। কিন্তু নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতাদের মত এঁরাও সমান দায়সারা। বা হয়ত সঠিক নির্দেশ পাননি, বা হয়ত নিজের মত আরও ভালো করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সায় পাননি। বা হয়ত… জানিনা।
একটা ভালো নাটকে আসলে ওই দরজা গুলো থাকে। ওই দরজাগুলো যেকোনো ভালো কাজেই থাকে। বাংলা থিয়েটারে ওই দরজা গুলো আছে কিন্তু ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য না সাদরে অভ্যন্তরে আমন্ত্রণ করার জন্য, সেটা ডিসাইড করতে পারছি না।
***
বিঃ দ্রঃ- হতে পারে রিভিউয়ার একটি গাধা! কে বলতে পারে! নাটকটি দেখতে যান, অনেককে নিয়ে দেখতে যান। আলোচনা করুন। আর আমাদের জানান আমাদের সঙ্গে আপনার মত মিলল কিনা।