রাজনৈতিক উপন্যাস ত্রয়ী – উত্তরাধিকার, কালবেলা, ও কালপুরুষ – সমরেশ মজুমদারের সাহিত্যকর্মের তর্ক সাপেক্ষে সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্যযোগ্য অবদান এবং বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল সংযোজন। ‘কালবেলা’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮৪ সালে তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে প্রায় দু’দশক কালব্যাপী বাংলার রাজনৈতিক সময়ের এক দলিলচিত্র এই উপন্যাস ত্রয়ী। এই সংকলনের ‘কালপুরুষ’ উপন্যাসটি মঞ্চে আনল কৃষ্টি নাট্যদল তাদের নবতম প্রযোজনা হিসাবে গত ১৩ই জানুয়ারি। নাট্যরূপ ও নির্দেশনা সিতাংশু খাটুয়া। কৃষ্টি তাদের পূর্ববর্তী প্রযোজনা হিসেবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপস্থাপনা করেছিল এবং তা দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছিল। ফলে আবার যখন কালপুরুষের মতো বিখ্যাত উপন্যাসের নাট্যরূপ মঞ্চে আনলেন তখন দর্শকদের প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকবে। বিশেষ করে নাট্যকার সিতাংশু খাটুয়া তার পূর্ববর্তী কাজে যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার মাপকাঠিতেই এই নাট্যরূপকে তুলনা করা হবে এটাই স্বাভাবিক। সেই তুলনার জায়গা থেকে বলা যায় তুঙ্গভদ্রার উৎকর্ষতার স্তর স্পর্শ করতে না পারলেও উপন্যাসকে নাটকে রূপ দেওয়ার স্বাভাবিক দক্ষতা নাট্যকারের মধ্যে বর্তমান, এবং তার স্বাক্ষর তিনি এখানে রাখতে পেরেছেন। একটি উপন্যাসের দীর্ঘ লিখিত রূপকে নাটকের পরিসরে এনে এবং মূল উপন্যাসের ভাবকে অক্ষুণ্ণ রেখে মঞ্চ উপস্থাপনার উপোযোগী করে নির্মাণ করা বেশ কৃতিত্বর কাজ।
Previous Kaahon Theatre Review:
সত্তর দশকের প্রথম দিকে উত্তরবঙ্গের মফস্বল থেকে কলকাতায় এসে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পরে অনিমেষ। এরপর আদর্শগত মত ভিন্নতার কারণে যোগ দেয় নকশাল আন্দোলনে। তার সাথে পরিচয় হয় মাধবীলতার। তার পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলে। অনিমেষের আদর্শকে শ্রদ্ধা করে মাধবীলতা। নকশাল আন্দোলনের জেরে ধরা পরে অনিমেষ। পুলিশের প্রচন্ড অত্যাচারে সে প্রায় হাঁটাচলার ক্ষমতা হারায়। ১৯৭৭সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে সে জেল থেকে মুক্তি পায়। মাধবীলতা তাকে নিয়ে আসে ৩নং ঈশ্বরপুকুর লেনের বস্তিতে। সেখানে এক চিলতে ঘরে তারা বাস করে তাদের একমাত্র ছেলে অর্ককে নিয়ে। অনিমেষ চেয়েছিল ছেলেকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে। কিন্তু রাজনীতির কুটিলতা আর ঘোলাটে সমাজব্যবস্থা অর্ককে অন্ধকার অসামাজিক পথে নিয়ে যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অনিমেষের আদর্শ আর মাধবীলতার দৃঢ় মানসিকতা অবিলম্বেই তার বোধদয় ঘটায়। সারল্য, পরোপকারিতা, আর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক যাঁতাকলে পেষিত, নিপীড়িত, কিছু মানুষকে জোটবদ্ধ করে উদ্বুদ্ধ করে তোলে নতুন করে বাঁচার জন্য। তাদের স্বপ্ন দেখায় ভবিষ্যৎ সুন্দর পৃথিবীর। কিন্তু ক্ষমতাপ্রিয় রাজনৈতিক দল ও এই সমাজ সেই পৃথিবীর স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে চায়। জেলবন্দি করা হয় অর্ককে। এতদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা মানুষগুলো একসাথে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। অর্ক – যে শব্দের অর্থ সূর্য – তাকে কি বন্দি করে রাখা সম্ভব?
সংলাপ ও ছোট ছোট দৃশ্যের মাধ্যমে নাটকটি গড়ে তোলা হয়েছে, খুব দীর্ঘ দৃশ্য বা বড় টানা সংলাপ রাখা হয় নি। নির্দেশক লিখিত রূপকে নাট্যে পরিণত করবার পথে কবিতা, গান ও নাচকে অনুসঙ্গ হিসাবে রেখেছেন। প্রথমে, মাঝে, ও শেষে তিনটি নাচের দৃশ্য রখা হয়েছে যার কোরিওগ্রাফি (প্রসনজিৎ বর্ধন) এবং উপস্থাপনা চমৎকার, দেখতেও বেশ ভালো লাগে আর আধুনিকতার পরশ পাওয়া যায়, কিন্তু নাট্যাভিনয়ে অতিরিক্ত কোনো মাত্রা যোগ করতে পারল কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। আধুনিক কবিতা ও গানের ব্যবহার কয়েকটি ক্ষেত্রে সুন্দর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে তবে এগুলির অধিক প্রয়োগের ফলে সামগ্রিক ভাবে এর ব্যবহারযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে। নাটকের প্রধান চরিত্রের নাম অর্ক বা নাটকের নাম কালপুরুষ তাই রেফারেন্স হিসেবে শুরুতে সূর্যবন্দনা আর মঞ্চের বাঁদিকে আলোর তৈরী কালপুরুষের অবয়ব ঝুলিয়ে দেওয়া আধুনিক চিন্তা ধারার প্রকাশ ঘটায় না। তবে নাট্যবিন্যাসে নির্দশকের সুচিন্তিত পরিকল্পনার পরিচয় পাওয়া যায়। মঞ্চের প্রায় সবকটি অংশই তিনি সুন্দর ভাবে ব্যবহার করছেন। ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে তিনি দর্শকদের কাহিনীর পূর্ব যোগাযোগ সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করেছেন। সামান্য সময়ের দুটি দৃশ্যের মাধ্যমে তিনি অতীতের অনেকটা কথাই বলে দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি মনে রাখার মত নাট্য মুহূর্ত তৈরি করতে পেরেছেন যা নাটককে সমৃদ্ধ করেছে।
অভিনয়ের ব্যাপারে বলতে গেলে প্রথমেই যেটা বলা দরকার সকলেই একটা নির্দিষ্ট মান বজায় রেখে অভিনয় করবার চেষ্টা করেছে ফলে দলগত প্রচেষ্টার একটা ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কয়েকজনের কথা আলাদা করে বলা প্রয়োজন। মাধবীলতার চরিত্রে মধুমিতা সেনগুপ্তকে চমৎকার মানানসই লাগে, অভিব্যক্তি ও সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চরিত্রটি জীবন্ত করে তুলেছেন। সুমিত রায় আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন অর্ক চরিত্রের অকুতোভয়, ঋজুতা ও মনের দ্বন্দ্ব কে ফুটিয়ে তুলতে। শুরুতে একটু খামতি থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি চরিত্রের সাথে একাত্ম হয়ে গেছেন। মোক্ষবুড়ির চরিত্রে তপতী মুন্সী ও উর্মিমালা চরিত্রে গান্ধর্বী খাটুয়ার অভিনয় বেশ ভালো লাগে। সিতাংশু খাটুয়ার অভিনয়ে পুলিশের তীব্র অত্যাচারে প্রায় পঙ্গু অনিমেষ সেভাবে ফুটে ওঠেনি, অবশ্য রূপসজ্জার খামতিও একটি কারণ। তবে সামগ্রিক রূপসজ্জার কাজ কিন্তু প্রশংসাযোগ্য বিশেষভাবে মোক্ষবুড়ি বা মাধবীলতার ক্ষেত্রে।
মঞ্চ ভাবনার কাজটি সুপরিকল্পিত। মঞ্চের বাঁদিকে (Left back) বস্তির ঘর, ডানদিকে (Right back) একটু উঁচুতে বিভিন্ন অন্তঃদৃশ্যের অভিনয় হয় সামান্য কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে আর এই অংশের নীচে গারদ যা শুধু শেষ দৃশ্যে ব্যবহৃত। বহু ছোট ছোট দৃশ্যের সমারোহে নাটকটি গড়ে উঠেছে ফলে স্বাভাবিক ভাবে অনেকগুলি দৃশ্য পরিবর্তন আছে, সেগুলি এত দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে করা হয়েছে যে তাতে নাট্য চলনের গতিতে কোন ব্যাঘাত ঘটে নি। নাটকের সঙ্গীত (সৌরভ ও অভিজ্ঞান) বেশ ভালো, মূল ভাবটি ব্যক্ত করতে এবং শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে পেরেছে। আলো (সৌমেন চক্রবর্তী) নাটকের চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ করতে সমর্থ হয়েছে। সঙ্গীত বা আলোক পরিকল্পনা সঠিক ও সার্থক রূপ পায় তাদের স্ব স্ব প্রক্ষেপকদের হাতে। এই নাটকের দুই প্রক্ষেপক নিজেদের কাজের জন্য প্রসংশার দাবী রাখে।
একটি নির্দিষ্ট সময়কালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিমন্ডলে উপন্যাসটি লিখিত হলেও এতে এক চিরকালীন মানবতার আহ্বান নিহিত আছে। বর্তমান সময়ে যখন আমরা আত্মকেন্দ্রিকতায় মগ্ন হয়ে ক্রমশ একে অপরের থেকে বিছিন্ন হয়ে পরছি তখন এই উপন্যাসের মঞ্চায়ন আমাদের বোধকে কিছুটা হলেও নাড়া দেবে।