মণীশ মিত্রের পরিচালনায় কসবা অর্ঘ্যের নবতম প্রযোজনা ‘যোনি’ বাংলা নাট্যজগতে এক নিঃশব্দ বিস্ফোরণ যা আমাদের প্রতিবাদহীন বধির মানসিকতাকে বিশেষভাবে নাড়া দেবেই। এ নাটক চলতি থিয়েটারের প্রথাগত ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে স্বতত্র এক প্রয়াস যা আমাদের কপট পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভাবনাকে ছিন্নভিন্ন করে। Eve Ensler-এর ব্রডওয়ে কাঁপানো নাটক ‘The Vagina Monologues’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলায় নাটকটি রচনা করেছেন মণীশ মিত্র, কিন্তু কখনই এটি একটি পাশ্চাত্য নাটকের বঙ্গীকরণ নয়, রচনার গুণে প্রথম থেকেই এটি হয়ে উঠেছে মূলগত ভাবেই ভারতীয়। পাশ্চাত্য প্রকাশ ভঙ্গির এই নাটকে যৌনতার স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ উদযাপন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার দ্বারা যৌন নিপীড়নকে উন্মুক্ত করে দেয়। এ নাটক প্রাচ্যের রক্ষণশীল মানসিকতাকেও ভীষণভাবে চোখ রাঙায়। যেখানে যোনি বাসেই সম্পর্কিত কোন শব্দ উচ্চারণকে অপরাধ বা পাপ হিসাবে ধরা হয়, যে দেশে যোনিকে শক্তিরূপে পূজা করা হয়, সেখানেই যোনিকে ক্ষতবিক্ষত করতে মুহূর্ত কাল সময় লাগে না – ভারতবর্ষের সমসাময়িক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এ নাটক ভীষণভাবে প্রতিবাদ স্বরূপ।
Previous Kaahon Theatre Review:
বেশ কয়েকটি মনোলগের সাহায্যে নাটকটি গঠিত হয়েছে, প্রতিটি মনোলগেই বিভিন্ন বয়সের যোনি সংক্রান্ত বেদনা বিধুর অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, সবকটি অভিজ্ঞতাতেই বিপরীতে একটি পুরুষের উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল যার লোলুপ দৃষ্টিতে নারী শুধুমাত্র যোনি সর্বস্ব এক মাংসপিন্ড। একটি নারী সম্পূর্ণ নারী হয়ে ওঠার আগে থেকেই পুরুষের লালসার শিকার হতে শুরু করে, আবার পূর্ণযৌবনা নারীকে বারবার পুরুষদের এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যে ‘তোমার যোনি কি অক্ষত?’ এই প্রশ্ন করে যে পুরুষ সেই আবার ঐ যোনিকে ক্ষতবিক্ষত করতে কোন দ্বিধা বা সংকোচ করে না। নারী যখন বার্ধক্যে পৌঁছায় তার দেহে যৌবনের লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকেনা তখনও সে একইভাবে লালসার শিকার হয়। নারীর উপর সকল অত্যাচারের পরও সব দায়ভার তার উপরেই বর্তায়, তাকেই সকল যন্ত্রণা সইতে হয় নীরবে, গোপনে। অদ্ভুত আমাদের এই সামাজিক ব্যবস্থা।
পরিচালক তার নান্দনিক ভাবনা দিয়ে নারীর যৌনতার উদযাপনও লাঞ্ছনাকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন, কয়েকটি ঘনিষ্ঠ দৃশ্যও বিশেষ করে যোনি লেহনের দৃশ্যটি যে ভাবে উপস্থাপিত করেছেন তা হয়ে উঠেছে এক নান্দনিক দৃশ্যকল্প। বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারে শালীনতার সীমা বিন্দুমাত্র অতিক্রম না করে এরকম দৃশ্যভাবনার সাহস কেউ দেখিয়েছে কিনা জানা নেই। নাটকে রবীন্দ্রসংগীত, জীবনানন্দের কবিতা, বা দেহতত্বের গানের উপযুক্ত ব্যবহার সুন্দর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে।
মেরী আচার্য্যের অনবদ্য একক অভিনয় এ নাটকের মূল আধার, তার অভিনয় বিষয়ভাবনাকে সুন্দরভাবে মঞ্চে নাট্যের রূপদান করেছে। কসবা অর্ঘ্যর তথা বাংলা থিয়েটারের অমূল্য সম্পদ মেরী আচার্য্য, মাত্র সতেরো বছর বয়সে কি ম্যাচিওরিটি! কন্ঠ, শারীরিক ভাষা, অভিব্যক্তি, মডিউলেশন, প্রতিটি ক্ষেত্র দারুণভাবে নিখুঁত। একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ অভিনেত্রীর মধ্যে যা যা গুণ থাকা প্রয়োজন সবই আছে মেরীর মধ্যে।
নাটকের আলো, সঙ্গীত, ও মঞ্চভাবনা নাট্য উপস্থাপনায় দারুণভাবে সঙ্গত করেছে। মঞ্চের ডানদিকে শিবলিঙ্গ এবং বাঁদিকে তিনটি লাঠির সাহায্য গঠিত যোনির আকার ঝুলিয়ে দেওয়ায় মঞ্চে বিপরীত লিঙ্গের সহাঅবস্থান ও বৈষম্য সূচিত হয়। নাটকের প্রথমদিকে শিবলিঙ্গকে পূজিত হতে দেখা যায়, নাটকের শেষে পৌঁছে যখন ঝুলন্ত যোনির আকারের নিচে জ্বলন্ত প্রদীপ আলোকিত করে তখন সামাজিক বা ধর্মীয় পুরুষতান্ত্রিকতার চাপা পাথর সরে গিয়ে নারীশক্তির জয়ধ্বনি বেজে ওঠে। নাটকটির উপস্থাপনা ও প্রকাশভঙ্গি অত্যন্ত আধুনিক, এ নাটক আমাদের সামনে আয়না ধরে আমাদের প্রকৃত পুরুষতান্ত্রিক রূপকে দেখায়। কখনো আবার চোখের কোণে জল আনে, কখন আবার স্থবির করে দেয়। নাটক শেষ হবার পরও অপলক চোখে চেয়ে থাকতে হয় মঞ্চের দিকে, পর্দা পরে যাবার পরও কিছু সময় লেগে যায় চেয়ার ছেড়ে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে আসতে, বাড়ি ফিরতে হয় একটা ঘোর নিয়ে, নাটক শেষের পরও মনের মধ্যে চলতে থাকে এ নাটক। কুর্নিশ মণীশ মিত্রকে, কুর্নিশ মেরী আচার্য্যকে, এবং কুর্নিশ দলের সকল সদস্যকে, এরকম একটি নাটক উপহার দেবার জন্য।