স্বল্প কথায় বললে নির্ণয়-হাওড়া-র প্রযোজনা যদি (নাটক, নির্দেশনা সঙ্গীতা পাল) গঠনে ও চলনে বর্তমান সময়ের জন্য একটি রূপক-কাহিনী (a parable for our times)। শুরতেই এই নাটকের আখ্যানের আভাস দিয়ে রাখলে আলোচনার সুবিধে হয়। ঘটনাস্থল এখনকার প্যারিস শহর, প্রমুখ চরিত্র বোরিস আন্দ্রে কসমেটিক্স কোম্পানির সেলস্ম্যান। বন্ধুবৎসল, আদতে ভালো লোক এই মাঝবয়েসী মানুষটি পেশায় ও ব্যক্তিগত জীবনে বেশ অকৃতকার্য; সে প্রোডাক্ট বেচার কাজে মোটেও তুখোড় নয় আর স্ত্রী জুলিয়ার সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদ আসন্ন। কোম্পানির নতুন ম্যানেজার নারকম একইসাথে আন্দ্রের চাকরীজীবন ও ব্যক্তিজীবন বিষময় করে তোলে – বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ না করতে পারার অজুহাতে নারকম বরখাস্ত করে আন্দ্রের বন্ধুসহকর্মীদের, উপরন্তু সে আন্দ্রের স্ত্রী জুলিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের নির্লজ্জ প্রয়াস করতে থাকে। সবদিক থেকে আন্দ্রে যখন ভালোই কোণঠাসা, তখন হঠাৎ ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় তার, সে জিতে যায় বিশাল অর্থমূল্যের জ্যাকপট। এরপর বেশ কিছু ঘটনা, দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে, কিছুটা বুদ্ধি কিছুটা উদ্যোগ দিয়ে, আন্দ্রে ঘুরিয়ে দেয় তার জীবনের দিশা – পেশায়, নিজজীবনে সে জয়ী হয় তার মত করে। আখ্যানের এই সারসংক্ষেপই বলে দেয় যদি আগাগোড়া রূপক-কাহিনীর আদলে গঠিত – নায়ক ভালোমানুষ কিন্তু বেকায়দায় পড়ে, একজন খারাপ লোকের আগমনে নায়কের খুব দুর্গতি হয়, কিন্তু একধরণের অপ্রত্যাশিত সাহায্য সে পায় (বহু রূপকে আমরা পাই কোনো দেবতার বা অলৌকিক কোনো সত্তার নায়ককে সাহায্য করা), যার দৌলতে এবং তার সুকুমার স্বভাব ও বুদ্ধির জন্য সে প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে শেষে পায় কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই,রাজকন্যার ভালোবাসা ও অর্ধেক রাজ্য)। রূপক-কাহিনীর গৎ মেনেই- ১) বেশির ভাগ চরিত্র এখানে যত না রক্ত মাংসের মানুষ তার চেয়ে বেশি কিছু স্বভাবের মূর্তকরণ; ২) ঘটনা সমূহ এখানে বিরাজ করে বাস্তবের জমির সামান্য কয়েক ইঞ্চি ওপরে; ৩) একটি নীতিশিক্ষা হাজির করে আমাদের প্রণিধানযোগ্য, অনুসরণযোগ্য হিসেবে।
Previous Kaahon Theatre Review:
Kaahon Theatre Review
AUTO, when Play rescues Drama
Read this review in English: https://t.co/fRVRX2K24R #bengalitheatre | #theatre | #theatrereview | #kaahontheatrereview |#KaahonPerformingArts https://t.co/rIUo17pUrR
— kaahon (@kaahonwall) April 26, 2018
যদি নাট্যের সাফল্য এখানেই যে খুবই সহজ সরল, কাঠামোগতভাবে চিরাচরিত একটি আখ্যান পেশ করা হয় এমনভাবে যা হয়ে ওঠে স্মার্ট ও নগরীয় (urban); নীতিশিক্ষা দেওয়া হাল্কা চালে, জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে নয়। নাটক স্মার্ট হয়ে ওঠে বুদ্ধিদীপ্ত আলো, মঞ্চ ও আবহ বিন্যাস ও প্রয়োগের হাত ধরে (আলো- সাধন পাড়ুই ও দীপঙ্কর দে; আবহ- দিশারী চক্রবর্তী; মঞ্চ- সঙ্গীতা পাল)। নায়ক যখন গাড়ি চালানোর ভঙ্গিমায় বসেন, আবহে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যায় আর স্টেজের ডান দিকে, একটু পেছন ঘেঁষে দৃশ্যমান হয় back-lit গাড়ির প্রতিরুপ ; নাট্য যখন স্থান বদলে বদলে গাড়িতে, pub-এ,সৌখিন রেস্তোরাঁয়,বেশ্যালয়ে ঘুরে বেড়ায়, আবহ সেই মত পাল্টে যায়, back-lit প্রতিরুপও পাল্টায়। পাল্টাতে থাকা back-lit প্রতিরুপ যেন ছুঁয়ে যায় ব্রেশটের থিয়েটার ভাবনা (ব্রেশট প্রায়শই ব্যবহার করতেন তুলে ধরা সাইনবোর্ড স্থান বা কাল বা ঘটনা নির্দেশ করতে)। অন্যদিকে, আবহ দিয়ে শুধু মেজাজ বা স্থান নির্দেশ করা হয় তা নয় – একসময় যখন বেচা কেনা তুঙ্গে ওঠে, তখন আবহে Jingle Bells’এর মূর্ছনা বর্তমান পণ্যময় সংস্কৃতির চাপে ক্রিস্টমাসের মর্ম হারিয়ে যাওয়াকে যেন বিদ্রুপ করে। নাট্য স্মার্ট হয়, তার চলন ঝরঝরে হয় এই কারণেও যে এখানে থাকা প্রচুর, ছোট ছোট দৃশ্য একের পর এক এসে নাট্যকে দেয় একধরণের গতি, দৃশ্যান্তরও ঘটে মসৃণভাবে। এই নাট্য বিরতি দাবী করে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়, কারণ বিরতির পর নাট্যে গতি ফিরতে কিছুটা সময় লাগে।
এটা বললে বোধহয় ভুল হয় না যে বাংলা থিয়েটার নগরীয় বাস্তব (urban reality) ধরতে চাইছে, এটা একটু দুর্লভ। না, গল্পের প্রেক্ষাপট শহর হলেই আর চরিত্ররা সেখানকার বাসিন্দা হলেই যে একটি নাট্য নগরীয় হবে, তা নয়। যদি নগরীয় কেন বুঝিয়ে বলি। একটা দৃশ্য আসে যেখানে মঞ্চ বিভাজিত হয়ে যায় তিনটে এলাকায়। ডান দিকে দেখা যায় এক খদ্দেরের লাগামছাড়া লালসায় ব্যয়সাধ্য বারবনিতা কেটির লাঞ্ছনা, মাঝখানে দেখা যায় পানশালার টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে, শরীর এলিয়ে দেওয়া আন্দ্রেকে (স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে সে কেটির কাছে এসে দেখে কেটি আগে থেকেই ব্যস্ত এবং তাই তার এখানে চলে আসা) আর বাঁ দিকে দেখা যায় বাড়ির ডাইনিং টেবিলে আন্দ্রের জন্য ব্যর্থ অপেক্ষায় থেকে শেষে নেশাতুর ঘুমে ঢলে পড়া জুলিয়াকে। এই সময় মঞ্চের বাঁ দিকের পেছনে কৃষ্ণবর্ণ আকাশের গায়ে জেগে ওঠে প্যারিসের আধুনিক নগর জীবনের অমোঘ প্রতীক আইফেল্ টাওয়ারের আলোকিত প্রতিকৃতি। রাতের অন্ধকার আর ভালোবাসার বিভ্রান্ত খোঁজে ঘুরপাক খাওয়া চরিত্রেদের মনের অন্ধকার যখন একাকার, তখন প্যারিস শহর যেন তার দিকভ্রান্ত সন্তানদের দিকে নির্নিমেষ অথচ নির্লিপ্ত দৃষ্টি রাখে। এইভাবে চরিত্রগুলোর ক্রাইসিস নির্দিষ্টভাবে শহরজীবনের অঙ্গ করে তোলায়যদি নগরীয়; যদি ভীষণ নগরীয় আরো একটি কারণে। সারা নাট্য জুড়ে অফুরান চলে খাওয়া ও বিশেষ করে মদ্যপান করার রিচ্যুয়াল; হাতে পয়সা আসার পর আন্দ্রে মেতে ওঠে দামী ঘড়ি জামা জুতো কেনায়, বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় মহার্ঘ্য খাবার খাওয়ায় ও খাওয়ানোয়, নারী শরীর কেনায়; বন্ধুত্ব গাঢ় করা হয় অত্যন্ত দামী গাড়ি উপহার দিয়ে; এবং সর্বোপরি, আন্দ্রে এবং জুলিয়ার পুনর্মিলন হয় হঠাৎ করে হাতে আসা অনেকটা বৈভবের ও বস্তুসুখের আবহে। অর্থাৎ, আধুনিক শহুরে conspicuous consumption এখানে দস্তুর; যে মানবিক গুনাবলি চর্চার শিক্ষা যদি দেয়, সে শিক্ষায় নেইসম্পূর্ণভাবে ভোগ বর্জনের পাঠ। খেয়াল করার, আন্দ্রে নারকমকে টেক্কা দেয় বাজার অর্থনীতির খেলা ত্যাগ করে নয়, বরং সে খেলায় নারকমকে পর্যুদস্ত করে। ঠিক এই কারণেই শুরুতেই বলা হয়েছে যদি এই সময়ের জন্য একটি রূপক-কাহিনী– চাই না চাই, বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের জালে আটকে পরা শহুরে আমাদের যদি গল্পচ্ছলে বলে যায় ভোগবাদ সম্পূর্ণ বিসর্জন বা তার তীব্র বিরোধিতা না করেও কিভাবে কিছুটা সৌভ্রাতৃত্ব, কিছুটা ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখা যায়। যারা নাটকে বৈপ্লবিক নির্ঘোষ চান, যদি তাদের জন্য নয়। যারা নাটকে চান বর্তমান সময়ের রুঢ় বাস্তবতা কবুল করে তা একভাবে negotiate করার কথা, যদি তাদের জন্য।
নাট্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র আন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন এই সময়ের অন্যতম প্রতিভাশালী অভিনেতা অনির্বাণ চক্রবর্তী। এক জায়গায় স্থির থেকে বলা সংলাপে কতটা প্রক্ষেপণ থাকবে আর ক্ষিপ্রতার সাথে মঞ্চের এদিক ওদিক চলাফেরা করতে করতে বলা সংলাপে কতটা, যাতে কোনটাই হয় চিৎকৃত বা অস্পষ্ট বা অতিরঞ্জিত না শোনায়, তার মাপ অনির্বাণ এতটাই রপ্ত করেছেন যে তার বাচিক অভিনয়ে আর অভিনয় থাকে না। চোখের হরেক রকমের চাহনির, মুখমন্ডলের বিভিন্ন অভিব্যক্তির মত সূক্ষ্মতা যেমন তার কাজে থাকে, তেমনই মাঝেমধ্যেই হাত, পা এবং গোটা শরীরের বেশ বর্ধিত সঞ্চালনেও তিনি ধরেন তার চরিত্রের নানা দিক। সংলাপ উচ্চারণে তার প্রখর সময়জ্ঞান তিনি ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত অর্থপূর্ণভাবে – যখন নারকমের (সুমন নন্দী) সাথে আন্দ্রে টেক্কা দিচ্ছে, সংলাপ আসছে তাড়াতাড়ি কথার পিঠে কথা হয়ে (repartee), আবার জুলিয়ার (সঙ্গীতা পাল) সাথে সে যখন কথা বলছে, সেই বাড়তি ক’টা অনুপল আন্দ্রে নিচ্ছে তার উত্তর দিতে যাতে জুলিয়ার কথাগুলো নিমেষেই না মারা যায়।সুমন নন্দী, সঙ্গীতা পাল, শুভঙ্কর দাসশর্মা, কাঞ্চন আমিন, মধুমিতা দাম, বর্ণালী রায়চৌধুরী, চন্দ্রানী চক্রবর্তী তাদের অভিনীত চরিত্রের দাবী মিটিয়েছেন; স্থানাভাবে এদের কাজের মূল্যায়ন বিস্তারে না করতে পারায় সমালোচক ক্ষমাপ্রার্থী। বেশ কয়েকজন অভিনেতা একাধিক চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন; সত্যি কথা বলতে, তাদের কাজের পরিসর বিশেষ ছিল না। এটা নিয়ে নির্দেশক ভাবতেই পারেন যে এতজন পার্শ্বচরিত্রের কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল? একাধিক চরিত্রে অভিনয় যারা করেছেন তাদের মধ্যে নজর কেড়েছেন জিতসুন্দর চক্রবর্তী – ক্ষমতালোভী, লালসাদুষ্ট হাসপাতালের বড়বাবুর চরিত্রটিতে তিনি আনেন ক্যারিকেচারের ছোঁয়া তার বাড়িয়ে করা অভিনয় দিয়ে, আবার প্রায় আসবাবের সাথে মিশে থাকা ক্যাফের ম্যানেজারের ভূমিকায় তিনি তার চলন বলন গুটিয়ে নেন দক্ষতার সাথে।
নাটককার, নির্দেশক সঙ্গীতা তার এই দুটি ভূমিকাতে যেভাবে কাজ করেছেন তাতে মনে হয়েছে নাটকের ও নাট্যের ক্ষেত্রে কিছু পুরানো baggage (যেমন নাটকের বক্তব্যে থাকতেই হবে সুস্পষ্ট পুঁজিবাদ বিরোধিতা আর নাট্যের মেজাজ হতেই হবে গুরুগম্ভীর) ঝেড়ে ফেলতে তিনি উদ্যোগী। এ নিয়ে বলার কিছু নেই – শিল্পীর স্বাধীন ও মুক্ত ভাবপ্রকাশ বাংলা নাট্যচর্চাকে সমৃদ্ধ করবে বলেই মনে হয়। তবে যা অন্তত এই সমালোচকের বিচারে বেশ বড় ত্রুটি, তা হচ্ছে কোথাও স্পষ্ট করে এই নাটকের উৎস স্বীকার করা হয়নি; শুধু বলা হয়েছে এটি একটি অনুবাদ। কোন টেক্সটের? সেটা কি নাটক? সেটা কি কোন চলচ্চিত্র? কে লেখক, কে চিত্রনাট্যকার? কোন ভাষায় রচিত মূল রচনাটি? কপিরাইট বা অনুমতির প্রশ্ন তুলছি না, বলতে চাইছি আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চায় এই ঋজু নিষ্ঠা ও চর্চার কথা, যেখানে সত্যি যদি মূল রচনা কি তা জানা না থাকে, তা অকপটে ঘোষিত হোক নাট্যের প্রতিটি শুরুর আগে। দর্শকদের মোবাইল ফোন শাসনে রাখতে বলার ঘোষণার চেয়ে এই ঘোষণা কম গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না।