আচ্ছা কখনো ভেবে দেখেছেন কি ডিজাইন আর ডিরেকশনের মধ্যে কি পার্থক্য? অনেকেই ভালো ডিজাইনকে ভালো ডিরেকশনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। সুন্দর দেখতে নাটককে গুলিয়ে ফেলেন ভালো নাটকের সঙ্গে এবং ভোক্যালি বা ফিজিক্যালি ভালো ডায়ালগ বলতে পারা অভিনেতাকে মনে করেন ভালো অভিনেতা। মজার ব্যাপার হল উপরোক্ত সব ক’টি বক্তব্যই উল্টো করে দিলে আসলে বোধ হয় ঠিক হয়। যেমন ভালো ডিরেকশনের ডিজাইন ভালো হয়, ভালো নাটক দেখতে ভালো (দেখতে ভালো মানে নাটকের টেক্সটের সঙ্গে মানানসই) হয় এবং ভালো অভিনেতা ফিজিক্যালি এবং ভোক্যালি ভালো ডায়ালগ বলতে পারেন। আমরা (যারা থিয়েটার দেখি এবং অনেক ক্ষেত্রে যারা করি তাঁরাও) আসলে থিয়েটার ব্যাপারটাকে বড্ড জেনারেলাইজ করে দেখতে দেখতে উল্টো কথাগুলোকে ও সত্যি ধরেনি, কিন্তু পৃথিবীর সবকিছু তো আর ভাইস-ভার্সা হয় না! যেমন ধরুন যাঁরা জেগে থাকে, তাঁরা কখনো ঘুমোন না – এই কথাটা যদি বলি, এটা কি কখনো সত্যি? নিশ্চয়ই না! কখনো না ঘুমোলে তো ওঁরা এমনি মরে যাবেন! মরে গিয়ে কি আর জেগে থাকা যায়?
Previous Kaahon Theatre Review:
কিন্তু মরে গিয়েও জেগে থাকা যায়, যেমন জয়সিংহ জেগেছিল, যেমন সুমন জেগেছিল। কিছু কিছু লোক জেগে থাকে, মরে গিয়েও জেগে থাকে। এমন একটা ভাবনা নিয়েই প্রজেক্ট প্রমিথিউস-এর প্রযোজনায় ইন্দুদীপা সিনহার নির্দেশনায় মঞ্চস্থ করা হল নাটক – “যারা জেগে থাকে”। পটভূমি ৮০র দশকের শেষের দিকের ইস্ট জার্মানি, যেখানে তখন জার্মান ডেমোক্রেটি করি পাব্লিকের পুলিশবাহিনী এবং ইন্ট্যালিজেন্স বিউরো একটি মাত্র লক্ষ্যকে পাখির চোখ করে এগিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য – to know everything! সারা দেশের লোক, বিশেষত কবি শিল্পী নাট্যকাররা কি ভাবছে তা জেনে ফেলা, এবং যে যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলবে তাদের ব্ল্যাক লিস্টেড করা, এবং ফাইনালি কয়েদ করা, মেরে ফেলা বা মরে যেতে বাধ্য করা। তাদের পন্থাটিও ছিল চমৎকার! সারা দেশের লাখ লাখ লোককে তারা রাষ্ট্রের ইনফরমার হতে উদ্বুদ্ধ (উদ-বাধ্য?) করেছিল। প্রায় প্রতি ৫ জনে ১ জনকে ইনফরমার হতে হয়েছিল। এরকম একটা রাজনৈতিক অবস্থায়ও কিছু লোক “জেগে থাকার” চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তাদেরকে নিয়েই এই নাটক।
অনেকের কাছে প্লটটা বেশ চেনাচেনা লাগছে, লাগারই কথা, ২০০৬ সালের ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম ক্যাটাগরিতে অস্কার পাওয়া জার্মান ছবি “Das Leben der Anderen” (“The Lives of Others” in English) দেখে এই নাটকটি বানানো হয়েছে। সিনেমা-খোর বাঙালির ফিল্মটি দেখা থাকাই স্বাভাবিক।
নাটকের প্লটটা বলব না। যাঁরা সিনেমাটা দেখেছেন তাঁরা জানেন, যাঁরা দেখেননি তাঁরা দেখে ফেলুন। অনেকগুলো সিনই (প্রায় ৭৫%) ডায়ালগ-টু-ডায়ালগ কপি করা হয়েছে, সুতরাং ওগুলো নিয়ে আর কিছু বলার নেই। শুধু এটুকু বলছি একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নাটকে অন্যরকম ভাবে দেখানো হয়েছে, সিনেমার মত পরিণতি পায়নি সে। কোন চরিত্র? বলব না। যান নাটকটা দেখে আসুন।
এই নাটকটায় প্রধান সমস্যা দুটো, না না, তিনটে। এক নম্বর হল, এই যে রাষ্ট্র মানুষের পারসোনাল স্পেসে ঢুকে পড়ছে, ডেমোক্রেসি বলে কিছুই থাকছে না, সেটা যে যেকোন রাষ্ট্র নয়, একটি “ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক”, যারা দাবী করে সোশালিস্ম, ডেমোক্রেসি এসব তাদের দেশের ভিত্তি এবং ভবিষ্যৎ – এই ব্যাপারটা নাটকে কোথাও ফুটে ওঠেনি। একটা স্বঘোষিত বামপন্থী দেশ যখন ভয়ানক দক্ষিণপন্থী আচরণ করে, তখন সেই অত্যাচারের গভীরতা এবং ব্যাপ্তি মাল্টিলেয়ারড হয়ে ওঠে। তখন তা আর খালি শাসকশ্রেণী অত্যাচার করছে – এখানে আটকে থাকে না। সোশ্যালিজমের স্বপ্ন বড্ড রঙিন, সেই স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় ধরে যখন জানতে পারা যায় সেটা আদতে সাদাকালো, তখন সেই কামার দাগ মিলিয়ে যেতে অনেক সময় লাগার কথা… সেই দাগ এক বার ধুয়েই হাত থেকে উঠে গেলে… কেমন যেন স্বপ্নটারই গুরুত্ব কমে যায়।
দ্বিতীয় সমস্যাটাও এখান থেকেই উঠে আসে। এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “তাসের দেশ” নাটকের কিছু গান, কিছু দৃশ্য ঢোকানো হয়েছে। বিশেষ করে এইটে বোঝানোর জন্য যে কোন না কোন সময় এমন বদ্ধজীবনের মধ্যেও কেউ না কেউ গেয়ে উঠবে “বাঁধ ভেঙ্গে দাও, বাঁধ ভেঙ্গে দাও”। কিন্তু তাসের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর এ নাটকের রাজনৈতিক অবস্থা দেখতে একরকম লাগলেও দুটোর মূল কনফ্লিক্টটা কিন্তু আলাদা!
তৃতীয় সমস্যাটা কেমন বোকা বোকা। এই যে কেউ না কেউ বাঁধ ভাঙ্গার গান গেয়ে উঠবে সেটা মূলছবির চিত্রনাট্যকারও (তাসের দেশ না পড়েই) জানতেন! তাই ছবির মধ্যেই এরকম একটা বাঁধভাঙ্গা চরিত্র তৈরি করেছিলেন তিনি। ইনফ্যাক্ট, সিনেমাটির প্রোটাগনিস্ট সেই চরিত্রটাই। সিনেমাটি থেকে সম্পূর্ণ ইন্সপায়ার্ড হলেও এই নাটকের নির্দেশক কিন্তু সেই চরিত্রটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি। পরিবর্তে অন্যদুটো চরিত্রের মধ্যে দিয়ে এই বাঁধভাঙ্গার ব্যাপারটা নিয়ে আসতে চেয়েছেন। কিন্তু কেন চেয়েছেন? একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কেন তাঁর যথেষ্ট মনে হল না? তার কোন সদুত্তর নেই। তিনি কি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন “এর সঙ্গে তাসের দেশটা একটু মিলিয়ে দেব?” আসলে এই লজিকটা দর্শকের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয় না বলে তাসের দেশের ইনক্লুশনগুলো নাটকটাকে কোথাও একটা চেপে ধরে রাখে, সঠিক বাঁধুনি তৈরি হতে দেয় না।