‘পদাতিক থিয়েটার’ ও ‘রিখ’এর যৌথ প্রযোজনায় গত ১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ তরিখে কলকাতার পদাতিক লিটল থিয়েটার-২ তে অভিনীত হল হিন্দি নাটক ‘জাঁচ পরতাল’ যদিও এই রিভিউ ২৮শে এপ্রিল, ২০১৯ তারিখের অভিনয়ের নিরিখে করা হয়েছে। বিশিষ্ট ইউক্রেনিয়ান রাশিয়ান কথাসাহিত্যিক নিকোলাই গোগোলের লেখা বহুচর্চিত স্যাট্যায়ার ‘The Government Inspector’ অবলম্বনে বর্তমান নাটকটি লিখেছেন সঞ্জয় সহায়, নির্দেশনায় বিনয় শর্মা।
নিকলাই গোগোল (১৮০৯-১৮৫২) এই The Government Inspector নাটকটি লিখেছিলেন মূলতঃ জারের সময়ে রাশিয়ার ছোট শহরগুলির দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীদের বিদ্রুপ করে। নাটকটি বিশেষভাবে ‘সমাজের আয়না’ ধরণের, যেখানে দর্শকরা নিজেদের কুৎসিত চেহারাটা নিজেরাই দেখতে পান। নাটকটি লেখা হয় ১৮৩৬ সালের আশেপাশে, আর তারপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দুই শতক ধরে নাটকটির জনপ্রিয়তা অব্যাহত, আর এই নাটকটি যে কোনো দেশের যেকোনো সময়ের সাপেক্ষে এখনো প্রাসঙ্গিক (হয়ত চিরকালই প্রাসঙ্গিক থাকবে)! সঞ্জয় সহায় কৃত অ্যাডাপ্টেশনটিও সুপরিচিত এবং বহু অভিনীত। এই নাটকটিকেই নির্দেশক বিনয় শর্মা নিয়ে এসেছেন নতুন আঙ্গিকে, অন্তরঙ্গ ফর্মের মধ্যে দিয়ে।
Previous Kaahon Theatre Review:
এই নাটকের বিশেষত্ব হল যে এখানে প্রতিটা চরিত্রই চূড়ান্ত লোভী আর স্বার্থান্বেষী, কারোর মধ্যে সততার লেশমাত্র নেই! এর মধ্যে রয়েছেন শহরের মেয়র এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা, যেমন – আইন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও ডাক বিভাগের প্রধানেরা। তারা প্রত্যেকেই চূড়ান্ত অকর্মণ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত, এবং তা’ নিয়ে এতটুকুও লজ্জিত নন! অবশ্য তারা প্রত্যেকেই ভীরু, তাই তারা যখন খবর পান যে রাজধানী থেকে কোনও এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছদ্মবেশে শহর পরিদর্শনে আসছেন, সকলেই বেশ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু ভুল বশত তারা একজন কপট প্রতারককেই সেই ছদ্মবেশী পরিদর্শক বলে ভেবে নেন, এবং তাকেই তুষ্ট করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। নাট্যকার সঞ্জয় সহায় এই কাহিনীটিকে নিয়ে এসেছেন উত্তরভারতীয় প্রেক্ষাপটে। মূল গল্পে ঠগব্যক্তিটির একজন সহকারী ছিল, সেই চরিত্রটি এখানে অনুপস্থিত। তাই স্বভাবতই বাদ পড়েছে সহকারীর সঙ্গে মেয়রের পরিবারের কথোপকথনের দৃশ্যটি। কাহিনীর মূল বক্তব্যের তাতে তেমন কোনো হানি হয়নি, উপরন্তু নাটকটি সংক্ষিপ্ত ও সংহত হয়েছে। দুই অনুগ্রহ প্রার্থীর চরিত্রদুটি পরিবর্তিত হয়েছে পুরোহিত ও মৌলবীতে, এখানে এই ধর্মীয় অনুসঙ্গটির আত্মীকরণ ভারতীয় প্রেক্ষিতে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। নাটকের চরিত্রগুলির প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতার অবিকল প্রতিরূপ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোর ধারণায় বেশ অবাস্তব। তবে যেহেতু এটি একটি কৌতুকনাট্য, এবং চরিত্র ও পরিস্থিতিগুলি কিছুটা অতিরঞ্জিত করে দেখানো, তাই চরিত্রগুলিকে প্রতিনিধি স্বরূপ বলে মেনে নিতে সমস্যা হয় না। আর এখানেই বড় হয়ে দেখা দেয় এই বিশেষ নাটকটিতে ফর্মের গুরুত্ব।
নির্দেশক বিনয় শর্মা নাটকটিকে লোকনাট্যের ঢঙে সাজিয়েছেন, সঙ্গে আধুনিক অন্তরঙ্গ থিয়েটারের শৈলী ব্যবহার করেছেন। এই রীতিতে বাস্তবানুগ মঞ্চসজ্জার বাহুল্য সম্ভব নয়, অল্প কিছু মঞ্চসামগ্রীই ব্যবহার করা হয়। নাটক শুরুর আগে অভিনেতা অভিনেত্রীরা ঐ মঞ্চ সামগ্রীগুলির আশে পাশে ঘুরতে থাকেন। তাদের ঐ যান্ত্রিক, পুনরাবৃত্ত কর্মকাণ্ড দর্শক মনে ‘অ্যাবসার্ডিটি’র অনুভব জাগিয়ে তোলে। মঞ্চসামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষক হল বসবার চেয়ার হিসাবে কমোডের ব্যবহার, যা স্প্যানিশ পরিচালক লুইস বুনুএলের ‘The Phantom of Liberty’ (১৯৭৪) ছবিটিকে মনে করায়, এবং সেইসঙ্গে একধরণের প্রতিবাস্তবতার অভিঘাত নিয়ে আসে। তবে ঠগচরিত্রটি যখন প্রস্রাব করার জন্য সেই একই চেয়ার ব্যবহার করে (যদিও চেয়ারটিকে তখন ঘুরিয়ে রাখা হয়), তখন যেন ভাবনার একটা অসঙ্গতি অনুভূত হয়। নাটকে সকলে প্রায় একই ধরণের পোশাক পরেন, যে পোশাকটিকে প্রায় একটি প্রতীকী অন্তর্বাস বলা যেতে পারে! নাটকের শুরুতেই মেয়রপত্নী আয়নায় মুখ দেখতে থাকেন। এই সমস্ত প্রয়োগই আসলে সেই ‘সামাজিক দর্পণ’ বিষয়ক ভাবনা প্রসূত। প্রসঙ্গত, নাটকের মঞ্চ ও পোষাক ভাবনা স্বয়ংপরিচালকের। নাটকের আলোক ভাবনায় আছেন সুদীপ সান্যাল, তবে এই নাটকে শুধু একটু সাধারণ সঙ্গত করা ছাড়া আলোর তেমন গুরুত্ব নেই। এই নাটকের সম্পদ হল এর দলগত অভিনয়, তোরোজন শিল্পী মাপা পদক্ষেপে, এবং সঠিক সমন্বয়ে প্রায় নিখুঁত একটি নাটক গড়ে তোলেন। অভিনয় শৈলী কিছুটা উচ্চকিত, তবে তা’ নাটকের আঙ্গিকের সঙ্গে মানানসই। বেবি চরিত্রে কৃষ্ণা সোনিকা এবং ম্যাজিস্ট্রেট চরিত্রে সায়ক চক্রবর্তী উচ্চকিত অভিনয়ের মধ্যেও আলাদা স্বাভাবিকতা দেখাতে পারেন। সব মিলিয়ে একটি চমৎকার পেশাদারী নাট্য নির্মাণ, যা একই সঙ্গে মননশীল এবং দর্শক উপভোগ্য।
তবে একটি দুশো বছরের পুরোনো নাটকমঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে কিছু পূর্বশর্ত থাকে। নাটকটিকে তার নিজের সময়ে রেখেই অভিনয় করা যেতে পারে, সেক্ষেত্রে নাট্য নির্মাণের গুণে দর্শক নাটকের প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করবেন। অথবা নাটকটিকে সমসাময়িক পটভূমিতেও নিয়ে আসা যেতে পারে। এই দুই এর অন্তবর্তী কোনও প্রচেষ্টাকে গুরু চণ্ডালী দোষে অভিযুক্ত করা যেতে পারে। নাটক যদি কল্পিত টাইম-স্পেসেরও হয়, তাহলেও কিন্তু তার নিজস্ব কিছু নিয়মানুবর্তিতা থাকে, যার অন্যথা হলে অসঙ্গতি অনুভূত হয়। এই নাটকে ডাকবিভাগের একটা বড় ভূমিকা আছে, হাতে লেখা চিঠির ভূমিকাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নাটকের মধ্যে যদি একবার ‘ইমেল’ শব্দটি উচ্চারিত হয়ে যায়, তারপরে কিন্তু আর ঘটনা প্রবাহের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে! আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে, সামাজিক অন্যায়ের উদাহরণ হিসাবে ‘দুর্নীতি’র গুরুত্ব অনেকটাই লঘু হয়ে এসেছে; অন্তত ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তো বটেই! দুর্নীতির বিষয়ে দর্শকদের সংবেদনশীলতা ও এখন আর তেমন জোরদার নয়! তাই এই নাটকের বক্তব্যকে দর্শকের মাথায় গেঁথে দেওয়ার জন্য হয়ত আরও আক্রমণাত্মক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। নাটকটি অন্তরঙ্গ স্পেসে অভিনীত হওয়ায় সেই সুযোগও পুরোমাত্রায় ছিল। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, নাটকের শেষের দিকের বহুআলোচিত দৃশ্যটি, যেখানে চিঠি খুলে পড়া হচ্ছে – একেকজন পড়ছেন আর বাকিরা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছেন। এই দৃশ্যের সংলাপকে ব্যবহার করে দর্শককে সরাসরি অভিযুক্ত করা সম্ভব ছিল। কিন্তু নির্মাতারা হয়ত দর্শককে এইরকম কোনো ধাক্কা দিতে, বা অস্বস্তিতে ফেলতে চাননি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে – একটি তীব্র শ্লেষাত্মক ক্লাসিক নাটক, উদ্ভাবনী মঞ্চায়ন, এবং তোরোজন অভিনেতা অভিনেত্রীর অসাধারণ দলগত পারফরম্যান্স সত্ত্বেও, নাটকটি শুধুমাত্র একটি ‘মজার নাটক’-এর গণ্ডীতেই আটকে থাকছে। দর্শক হাসিহাসি মুখে হল থেকে বেরোচ্ছেন, ক্যামেরার সামনে ‘দারুণ হয়েছে’ বলে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, তারপর বাড়ি গিয়ে সবই ভুলে যাচ্ছেন। কিন্তু এতে করে নাট্য নির্মাণের মূলউদ্দেশ্যটাই কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছেনা তো? পদাতিক এবং বিনয় শর্মার কাছে আমাদের প্রত্যাশা কিন্তু শুধুমাত্র ‘সুস্থ এন্টারটেইনমেন্ট’ নয়, আরও বেশি কিছু!