বিভাবন নাট্যগোষ্ঠী’র ১৬তম ইন্টিমেট থিয়েটার উৎসব (প্রসেনিয়াম আর্ট সেন্টারের সহায়তায় এবং সেই ঠিকানাতেই) হয়ে গেল কিছুদিন আগে (১৫–১৯নভেম্বর, ২০১৭)। তারপরেই, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সপ্তদশ নাট্যমেলার অন্তর্গত অন্তরঙ্গ বিভাগের উৎসব হল তৃপ্তি মিত্র সভাঘরে (২৫ নভেম্বর–০৪ডিসেম্বর, ২০১৭)। একমাসেরও কম সময়ে কলকাতার ও জেলার বিভিন্ন দলের/গোষ্ঠীর প্রযোজনায়, দু’টো উৎসব মিলিয়ে প্রায় তিরিশটি অন্তরঙ্গ নাট্য দেখল শহর কলকাতা। এটা পরিস্কার, নাট্যজগতের লোকজন – তা নির্দেশক, অভিনেতা বা দর্শক যেই হোন – অন্তরঙ্গ নাট্য নিয়ে বেশ লক্ষণীয়ভাবে ভাবছেন, কাজ করছেন এবং সামগ্রিকভাবে বললে, উৎসাহী হচ্ছেন। খুব নিবিড়ভাবে এই দু’টি উৎসবে হাজির থেকে কাহন “অন্তরঙ্গ থিয়েটার” নিয়ে এই নতুন উৎসাহকে বুঝতে এবং যে প্রযোজনাগুলি পরিবেশিত হল তার কয়েকটির দিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টিপাত করতে এই প্রতিবেদনে প্রয়াসী হল।
ধ্রুবপুত্র: কিছু ধ্রুব সত্যের অবমাননা https://t.co/vnij0deEd5 via @Crunchify
— kaahon (@kaahonwall) December 14, 2017
শুরুতেই “অন্তরঙ্গ নাট্য” নিয়ে দু’চার কথা, যা বলা না হলে এই লেখার বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্কার হবে না – বলাই বাহুল্য, এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই কাহনের অন্তরঙ্গ নাট্য দেখা। প্রসেনিয়াম থিয়েটার কি তা অল্প কথায় বলা হয়ত সহজ, কিন্তু “অন্তরঙ্গ থিয়েটার” ঠিক কি তা বলা বিলক্ষণ কঠিন। এর কারণ এই আঙ্গিকটি এখনও তৈরী হয়ে চলেছে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যিনি অন্তরঙ্গ থিয়েটার করার কথা ভাবছেন, তিনি একদিকে যেমন চিন্তার রসদ সংগ্রহ করতে পারেন স্ট্রিন্ডবার্গ, আন্তোনিন আতৌ, গ্রোটোস্কি, বাদল সরকার প্রমুখের নাট্যভাবনা থেকে, অন্যদিকে তার সামনে রয়েছে কীর্তন, লেটো গান, আলকাপ, কথকথা, থিয়েটার ইন দ্য রাউন্ড, ফ্রী থিয়েটার ইত্যাদি পারফর্মিং ট্র্যাডিশনের থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ। আজকাল অন্তরঙ্গ নাট্য করা হচ্ছে এমন বিশেষ জায়গায় যা আদতে নাটকের জন্য তৈরী হয় নি (সাইট স্পেসিফিক ইন্টিমেট থিয়েটার) – যেমন কোন বাড়ির বৈঠকখানায়, বা কফিশপে, এমনকি চলন্ত বা দাঁড়ানো ট্যাক্সির ভেতরে বা ইয়ার্ডে পড়ে থাকা বাতিল ট্রেনের কামরার মত অভিনব, চমকপ্রদ জায়গায়। যদিও অন্তরঙ্গ নাট্য অনেক রকম হতে পারে, তবুও যে তিনটি বৈশিষ্ট্য একটি নাট্যকে অন্তরঙ্গ আখ্যা দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমাদের মনে হয়েছে তা হলো পারফর্মার ও দর্শকের নৈকট্য, দর্শকের সীমিত সংখ্যা এবং এই দুইয়ের কারণে, পারফর্মার ও দর্শকের মধ্যে এক বিশেষ ধরণের আদানপ্রদান, বিনিময় সৃষ্টি হওয়া। প্রসেনিয়ামে থাকে বাস্তবের ইল্যুশন তৈরী করার প্রচেষ্টা, থাকে পারফর্মার ও দর্শকের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য দূরত্ব, থাকে উচ্চ মঞ্চ থেকে একমুখী কম্যুনিকেশন যেখানে সকল মানে উৎপাদন করার গুরু দায়িত্ব নেন পারফর্মার আর দর্শক থাকেন নিষ্ক্রিয় গ্রাহী হিসেবে।অন্যদিকে স্বল্প উপকরণ ব্যবহার করে, দর্শককে পারফর্ম্যান্সের সমতলে রেখে এবং তাকে পারফর্ম্যান্সের অন্তর্গত করে নিয়ে অন্তরঙ্গ নাট্য প্রচেষ্ট হয় প্রসেনিয়াম-পারফর্ম্যান্স রীতির বিপরীতে দাঁড়াতে।
কিন্তু তা হয় কি সবসময়, তা কি ঘটল দু’টি অন্তরঙ্গ নাট্যোৎসবে সবকটি প্রযোজনার ক্ষেত্রে? বলতেই হচ্ছে, না। মোটের ওপর তিন প্রকারের কাজ পেলাম আমরা। কিছু নাট্য ছিল সর্বার্থে দুর্বল। যেমন, সাঁইথিয়ার দল ওয়েক আপের ‘হ য ব র ল’ (বিভাবন উৎসব), রঙ্গশীর্ষের ‘ত্রাশানু’ (বিভাবন উৎসব), হাওড়া জোনাকির ‘অবিশ্বাসের বাস্তব’ (নাট্যমেলা)। দ্বিতীয়তঃ বেশ কিছু এমন প্রযোজনা দেখলাম যা প্রসেনিয়াম বা মুক্তমঞ্চের জন্য যতটা উপযোগী, একটা ঘরের অন্তরঙ্গ পরিধীতে ততটাই বেমানান। এর মূল কারণ প্রসেনিয়াম বা মুক্তমঞ্চের থিয়েটার শৈলীতে নির্মিত এই কাজগুলোকে যখন ঘরের মধ্যে নিয়ে আসা হলো, তখন এই ছোট হয়ে আসা, অন্তরঙ্গ হয়ে যাওয়া জায়গাটার পারফর্ম্যান্স সম্বন্ধীয় যে সম্ভাবনা এবং দাবী, তা মিটল না। এই তালিকায় আসবে আয়নার ‘সিংহমুখ’, সাম্প্রতিকের ‘অশনি সংকেত’, জেড থিয়েটারের ‘শূন্যতা’ (দুটো উৎসবেই হাজির ছিল এই তিনটি নাট্য), পুষ্পকের ‘রাখ হরি আল্লা রাখা’, প্রস্থানের ‘দ্য লেসন’, হালিশহর সাংস্কৃতিকের ‘উচ্ছেদ’, সাহিত্যিকার ‘রথের রশি’ এবং আমরা সবুজের ‘ক্লেপ্টোম্যানিয়া’ (এগুলি শুধু নাট্যমেলায় পরিবেশিত) । ঋতমের প্রযোজনা ‘বিদুষক’ কিছুটা হলেও অন্তরঙ্গ নাট্য হওয়ার প্রয়াস করেছে, তবে এই কাজটি অনায়াসে অন্য পরিসরেও করা যায়।হাতিবাগান সঙ্ঘারামের প্রস্তুতি ‘উদরনীতি’ কাহনে আগেই বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে; সেখানে বলা হয়েছিল এই নাট্যটিও প্রসেনিয়ামে করা সম্ভব। তবু এটা বলতেই হয় যে ‘উদরনীতি’ একটি অত্যন্ত সুলিখিত, সুগঠিত কাজ, যা অভিনয়গুণে, আলো ও আবহের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহারে খুবই তৃপ্তিদায়ক দর্শন-অভিজ্ঞতা। তৃতীয়, আমরা পেলাম কিছু কাজ যেগুলো অন্তরঙ্গ নাট্যের দাবী মেটাতে সক্ষম হয়েছে, যদিও সব কাজের গুণগত মান এক নয় তা বলাই বাহুল্য। এবারে এরকম কাজ নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
ক্যান্ডিড থিয়েটারের ‘আমাকে দেখুন’ (দু’টি উৎসবেই অভিনীত) অন্তরঙ্গ নাট্য সন্দেহ নেই। কিন্তু, যা এই নাট্যের ক্ষতি করে তা হলো পুরো আলো টর্চলাইট দিয়ে নির্মাণ করা, যা চমকই থাকে, বিশেষভাবে অর্থবাহী হয় না। অভিনয় এই নাট্যে জায়গায় জায়গায় খুব দুর্বল। ওগ্লামের ‘দিগম্বরী’ সচেষ্ট হয়েছে কালীর দিগম্বরী রূপধারণ নিয়ে যে তান্ত্রিক বিশ্বাস তার নাট্যরূপ দেওয়ায়, সেই প্রাচীন গল্পের সাথে নতুন একটি কাহিনী কিঞ্চিৎ বুননের মাধ্যমে। প্রসেনিয়াম থেকে বেরিয়ে এলে টেক্সটের কড়া নিয়ন্ত্রণের থেকে মুক্তির একটা সম্ভাবনা খুলে যায় – ইম্প্রোভাইজড পারফর্ম্যান্সের ওপর জোর দেওয়া এই নাট্য সেই সম্ভাবনাকে কিছুটা অণ্বেষণ করেছে। তবে, এই নাট্যের দুর্বলতার জায়গাও বেশ কয়েকটি – প্রধানতঃ কুশীলবের পোশাক এবং ইংরেজি বাংলার মেশানোর অর্থহীন প্রচেষ্টা। প্রজেকশনের ব্যবহার নিতান্তই অসফল থাকে।
বিভাবন গোষ্ঠীর দুটো কাজ দেখা গেলো – ‘কনফেশনস’ এবং ‘ব্ল্যাক কফি’। পারফর্ম্যান্স-ভাবনার দিক থেকে ‘কনফেশনস’ কাজটি পুরোদস্তুর অন্তরঙ্গ – এখানে প্রথমেই দর্শককে নাট্যের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা হয়, বস্তুত তারাও ‘অভিনয়’ করেন। তাদের চোখ বাঁধা থাকে, তারা একজনের পারফর্মারের কনফেশন (স্বীকারোক্তি) শোনেন, তারপর তাদেরকে আহ্বান করা হয় নিজেদের স্বীকারোক্তি উপস্থাপনা করতে। এই বিষয়টি একটু ভাবার। থিয়েটার একটি জীবন্ত আর্ট ফর্ম – যদি তাই হবে, তাহলে দর্শকেরও নাট্য পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করার পূর্ণ অধিকার আছে। এমনটা ভাবতেন বাদল সরকার এবং তিনি বারবার সওয়াল করেছেন এমন থিয়েটারের হয়ে যেখানে দর্শকও অর্থবহ ভাবে নাট্যে যুক্ত থাকবেন। প্রসেনিয়ামে এ সম্ভাবনা নেই বলেই তৃতীয় থিয়েটার, অন্তরঙ্গ থিয়েটার। দর্শকদের দিয়ে পারফর্ম করিয়ে, মানে উৎপাদন করিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন ঘটানো অন্তরঙ্গ থিয়েটারের প্রায় অপরিহার্য দাবী এবং সেটা মেটানোর ইচ্ছা ও সাহস বিভাবন দেখিয়েছে বলে তাদের অভিনন্দন। এই নাট্যে ব্যবহৃত বাউল গানে ও একটি ছবি আঁকায় ইম্প্রোভাইজেশনের ছোঁয়াও প্রশংসনীয়। তবে, নাট্যের নির্মাতারা গোটা পারফর্ম্যান্সটিকে আরেকটু সংযুতি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাববেন আশা করি। নাট্যটি শুরু হয় একটি সম্ভাবনা নিয়ে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কোথাও পৌঁছায় না। নিটোল গল্প না হয় নাই বলা হল, কিন্তু একধরণের আখ্যানমূলক গঠন থাকতেই পারে। বহু বছর ধরে শতাধিক অভিনয় হয়ে যাওয়া ‘ব্ল্যাক কফি’ নিয়ে নতুন করে বিশেষ কিছু বলার থাকে না। অত্যন্ত শক্তিশালী এই অন্তরঙ্গ নাট্যে বাস্তব পরাবাস্তব মিশে যায়, সাথে থাকে খুব শক্তিশালী অভিনয়। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে সরকারের দ্বারা কৃষকের জমি কেড়ে নেওয়ার সময়ে তৈরী এই নাট্যের রাজনৈতিক বক্তব্য খুব পরিস্কার, কিন্তু কালে কালে সেই বক্তব্যের ধার কমছে, বর্তমানে সেই বক্তব্য কিছুটা প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
অল্টার্নেটিভ লিভিং থিয়েটারের প্রস্তুতি ‘মাইনাস জিরো প্লাস – প্লাস জিরো মাইনাস’ (নাট্যমেলা) সন্দেহাতীতভাবে সেই কাজ, যা সবচাইতে বেশি ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে। নাট্য শুরু হয় আবছা আলোয় দেখা সার দিয়ে মেঝেতে কাপড়ে মোড়া শায়িত স্থাণুবৎ শবদেহ দিয়ে, আবহে তখন শোনা যায় কন্ঠনিঃসৃত একটা ধ্বনি যাকে সুরেলা বলা যায় না। অনেকক্ষণ পর যখন একটি শবদেহ উঠে বসে, নড়ে চড়ে, আর তার বেশ কিছুক্ষণ পরে আরেকটি, তারপর অন্য আরো একটি, তখন আমরা বুঝতে পারি এগুলো আদপেই শবদেহ নয়। এই বোঝাটায় আসতে হয় ভাবনা দিয়ে – আর ঠিক এখানেই এই নাট্য হয়ে ওঠে অন্তরঙ্গ, কারণ তা দর্শককে টেনে নেয় চিন্তার সুতো দিয়ে। এই নাট্যে গল্পের লেশমাত্র নেই, চরিত্র বলতে যা বুঝি তা নেই, ভাষা নেই। কুশীলবেরা কিছুটা অর্থ তৈরি করেন তাদের শরীরী মুদ্রা, অঙ্গসঞ্চালণ ও কিছু শব্দ ব্যবহার করে, আর বাকিটা নির্মাণ করে নিতে হয় দর্শকদের নিজেদের মত করে এবং তাতে কোন একশিলা (monolithic) অর্থ তৈরী না হয়ে, বিভিন্ন জনের কাছে আলাদা অর্থ তৈরী হয়। আমাদের কাছে যে অর্থ এসে পৌঁছেছে এবং তার সাথে আমরা যে অর্থ গেঁথে নিয়েছি, তাতে মনে হয়েছে এই পারফর্ম্যান্সটি ‘মানব-সভ্যতার’ উদ্ভবের, ‘মনুষ্য-চেতনার’ উন্মেষের একটা রুপরেখা হাজির করতে চেয়েছে। আমরা এখানে পেয়েছি সমানতার/ভিন্নতার নিরীখে সমাজবদ্ধ হওয়ার আভাস, পেয়েছি যৌনতাবোধের সৃষ্টি হওয়া (যা মনে করিয়েছে Freud’কে), পেয়েছি আয়নায় আত্মপরিচিতি খোঁজার চেষ্টা (যা অনিবার্যভাবে মনে করিয়ে দিয়েছে Jacques Lacan’এর মিরর স্টেজের ত্বত্ত্ব), পেয়েছি সময় বা মহাকালের প্ররোচনায় উঠে আসা মৃত ঈশ্বর (Nietzsche, Heidegger?), পেয়েছি বস্তু ও সম্পদ ব্যক্তি মালিকানাধীন করে (Engels ও Marx) তা নিয়ে মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিভাজন ঘটা, সীমানা উপস্থিত হওয়া। বিমূর্ত ধারণা, কঠিন ত্বত্ত্ব পারফর্ম্যান্সের ভাষায় সম্যকভাবে, নিপুণ দক্ষতায় ও অটল মনঃসংযোগে ফুটিয়ে তোলার দুঃসাধ্য কাজটি করেছেন অল্টার্নেটিভ লিভিং থিয়েটার। তাদের অকুন্ঠ অভিনন্দন; তাদের সম্পাদনের গুনে আশ্চর্যজনকভাবে এই নাট্য আমাদের ভারাক্রান্ত করেনি। এই পারফর্ম্যান্স চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে প্রসেনিয়ামের, ভাষার, গল্পের বড় পরিসর ছেড়ে ছোট স্পেসে, অন্যতর ভাষায়, গল্পহীনতায় ঢুকে পড়াটা কিরকম liberating অভিজ্ঞতা হতে পারে, নাট্য নির্মাতাদের জন্য, দর্শকদের জন্য।
সর্বশেষ যে কাজের কথা বলে হবে তা হল সিউড়ি’র ইয়াং নাট্য গোষ্ঠীর প্রযোজনা ‘সর্বাশী’ (নাট্যমেলা)। অর্ণব মুখার্জী রচিত, সত্যজিৎ দাস নির্দেশিত এই নাট্য বাংলা বিহার সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাস করা আদিবাসীদের জীবনের একটা ফালি তুলে ধরে। অন্তরঙ্গ থিয়েটারের দাবী মিটিয়ে এটি সর্বার্থে একটি সফল প্রযোজনা। দর্শকদের মাঝে রেখে চারদিক দিয়ে অভিনয় করে প্রথমেই এই নাট্য দর্শককে টেনে নেয় নিজের গণ্ডীর ভেতরে।চারটি দিকই যাতে ব্যবহৃত হয় তা নজর করা হয়েছে, সাথে সাথে দুইপাশ ও পেছনদিক ব্যবহার করার ক্ষেত্রে খেয়াল করা হয়েছে যে দর্শক যাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থেকে বঞ্চিত না হন। দূরত্ব বোঝাতে পেছনদিক আর একটা পাশ ব্যবহার হয়েছে বারবার। দূর থেকে আদিবাসীদের নেচে নেচে গান গাইতে গাইতে আসার দৃশ্যে বা দূরে গ্রামে কিছু ঘটছে তা বোঝাতে নাট্যে স্থানিক ব্যবহার সত্যিই প্রশংসনীয়। আবার, বাঁদিকে দর্শক-নৈকট্যের সদ্ব্যবহার করে প্রেমের মুহূর্তের নরম স্পর্শ বা মারামারির প্রায় শারীরিক অনুরণন স্পষ্টভাবে সঞ্চারিত করা হয় দর্শকদের মধ্যে। সম্রাট মুখার্জীর আলো – সঠিকভাবে বললে, অন্ধকারের ব্যবহার -এই নাট্যের সম্পদ। একটি দৃশ্য আসে যেখানে প্রধান চরিত্র রাতে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে – তৃপ্তি মিত্র সভাঘরের জমাট অন্ধকার অক্ষুণ্ণ রেখে চরিত্রের মুখের ওপর টর্চের আবছা আলো ফেলে একটা ময়লা জ্যোৎস্না বানানো হয়, এবং সেই কম আলোয়, বেশি অন্ধকারে চলে জঙ্গল অভিযান।ভয় ও রহস্যের আবহ তৈরী করে আলো আঁধারির খেলা। নাট্য চলাকালীন এটা একবারের জন্যও মনে হয় না, যারা অভিনয় করছেন তারা কেউই আদিবাসী নন। ভাষায়, উচ্চারণে, বাচনভঙ্গীতে, দেহসঞ্চালনায় অভিনেতারা আত্মস্থ করেছেন আদিবাসী চলন, নিছক অভিনয় করেন নি। অত্যন্ত মনোগ্রাহী এই প্রযোজনার নির্মাতারা যদি তাদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে দর্শকদের এই নাট্যে আরো অন্তর্গত করে নিতে পারে, তাহলে নাট্যটি আরও সমৃদ্ধ হবে।
দুটি নাট্যোৎসব দেখে এটা পরিস্কার যে অনেকেই অন্তরঙ্গ ফর্মটি বেছে নিচ্ছেন যতটা না এই ফর্মের প্রতি নান্দনিক বা রাজনৈতিক আস্থার কারণে, তার চেয়ে বেশি পরিস্থিতির চাপে, যেমন প্রসেনিয়াম মঞ্চ না পেয়ে বা আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে। পরিস্থিতির চাপে অন্তরঙ্গ থিয়েটার করা যেতেই পারে, কিন্তু তা করতে হলে আঙ্গিকগত দাবীগুলো মেটানোটা অবশ্যকর্তব্য। আর, অন্য মঞ্চের জন্য বানানো কাজ অন্তরঙ্গ স্পেসের উপযোগী না করে পরিবেশন করার প্রবণতাটা পরিত্যাজ্য। বিভাবন নাট্যগোষ্ঠী’র উৎসবে প্রায় প্রতিটি নাটকই নির্ধারিত সময়ের অনেক পর শুরু হয়েছে; এই ব্যাপারটা নিয়ে আশা করি ওনারা ভবিষ্যতে ভাববেন। সেই সুযোগে আমরা আরেকটা কথা ভেবে নি। এক সন্ধ্যায় দেখা গেলো সরকারী নাট্যমেলার অন্তর্গত মুক্তমঞ্চে মাইক্রোফোন ব্যবহার করে আলকাপ অভিনীত হচ্ছে, যখন সভাঘরে চলছে এমন একটা নাটক যা মুক্তমঞ্চেই উপযুক্ত। এ এক অদ্ভুত অসমাপতন। আমাদের বাংলায় এমনকিছু লোকায়ত নাট্যধারা আছে যা আসলে অন্তরঙ্গ থিয়েটার বা তার খুবইকাছাকাছি নাট্যশৈলীতে চর্চিত। ভবিষ্যতে এই ধরণের অন্তরঙ্গ নাট্যোৎসবে বাংলার নিজস্ব অন্তরঙ্গ থিয়েটার পরিবেশিত হবে এ একান্তই কাম্য।
(পুঃ – দুটি উৎসব মিলিয়ে কয়েকটি নাট্য অনুল্লিখিত রয়ে গেলো কারণ সেগুলো দেখা সম্ভব হয় নি। সেই দলের/গোষ্ঠীর কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।)
সহযোগিতায় শ্রীজয়ী ভট্টাচার্য