রঙ্গলোকের নবতম প্রযোজনা হন্তারক ইতিমধ্যেই দর্শকের প্রসাদ লাভ করেছে তা স্বীকার করেই এই লেখা শুরু করা যায়; ০৫/০৩/২০১৮ তারিখে নাট্যটি রবীন্দ্রসদনে অভিনীত হল বেশ ভালো সংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে। তারা অনেকেই জায়গায় জায়গায় করতালি দিয়ে নাটকের বক্তব্যের সাথে সহমত প্রকাশ করলেন। কিন্তু, দর্শকের একাংশের নাট্যগ্রহণের বিপরীতে গিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই প্রযোজনাটিকে সমস্যাসংকুল মনে হয়েছে। চেষ্টা থাকবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার।
তীর্থঙ্কর চন্দের লেখা এই নাটকটি থ্রিলারের মোড়কে আসলে একটি থিসিস নাটক, যেখানে মূখ্য চরিত্র আগাগোড়া নাটককারের নানা মতামতের বাহক ও প্রেরক হয়ে থাকে। প্রায় এক শতাব্দী আগে প্রচলনে থাকা সংলাপ নির্ভর ও শব্দবহুল থিসিস নাটক আজকের দিনে কোন নাটককার লিখতেই পারেন, কিন্তু হন্তারক নাটকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে এর থিসিসটিই (অর্থাৎ নাটকের মূল তর্কটি) ভীষণরকম বিভ্রান্ত। কেন তা বলছি তা বোঝানোর জন্য সংক্ষেপে এই নাটকের আখ্যানের একটা আভাস দেওয়া দরকার। একজন অধ্যাপক একাধিক খুন করে জেলে অপেক্ষা করছেন ফাঁসির জন্য। তার শেষ সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য টিভি চ্যানেল জেলে উপস্থিত; এই সাক্ষাৎকার লাইভ সম্প্রচার হবে, যা দেখার জন্য উদগ্রীব লাখো দর্শক। সাক্ষাৎকার শুরু হয় – সিরিয়াল কিলার অধ্যাপক খুনের বর্ণনা দিতে আরম্ভ করেন। এক অসতর্ক মুহূর্তেখেলাটা ঘুরে যায় (ঠিক কি হয় তা উহ্যই থাক, যারা নাটকটি দেখবেন তাদের জন্য কিছু সাসপেন্স তোলা থাক), তবে যা চলতে থাকে তা হল অধ্যাপকের খুনের ইতিবৃত্ত প্রকাশ এবং তার সাথে যুক্ত হয় জেলে আটক অন্য কয়েকজন সাজাপ্রাপ্ত আসামীর বয়ান হাজির করা। নাটকের শেষে অধ্যাপক পুলিশের গুলিতে মারা যান। মোটের ওপর নাটকের প্লট্ এই। প্লট যত বিস্তার পায়, বোঝা যায় অধ্যাপক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে খুনগুলো করেছেন নিজেই জাজ, জুরি এবং এক্সিকিউশানারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে। এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের সমাজে ছেয়ে আছে অন্যায় ও অবিচার, কিন্তু তার প্রতিকার বা প্রতিরোধ করতে গিয়ে অধ্যাপক মহাশয়ের নাগরিক অরণ্যদেব হয়ে যাওয়াটা বাস্তবতা ও যুক্তির কাঠামোর বাইরে বেরিয়ে গিয়ে একরাশ সমস্যা সৃষ্টি করে। এক ডাক্তার-নার্স দম্পতির অবহেলায় একটি শিশুর প্রাণ যায়; তার বদলা/শাস্তি/ন্যায়বিচার হিসেবে অধ্যাপক তাদের শিশুকে খুন করেন; ট্রেনে এক মহিলা বোগি সাফ করা দরিদ্র বালকের গায়ে গরম চা ঢেলে দিয়ে চুরির অভিযোগে বালককে পুলিশের অত্যাচারের মুখে ঠেলে দেন; সেই মহিলাও অধ্যাপকের শিকার হন। বোঝাই যাচ্ছে, সমস্যা এখানে প্রচুর – অধ্যাপকের খুনের মোডাস অপারেন্ডি না হয় ছেড়েও দিলাম, কিন্তু অন্যায় যাই হোক না কেন খুনই তার একমাত্র শাস্তি, এই তর্কটি প্রশ্নাতীতভাবে উদ্ভট। তাছাড়া রয়েছে অধ্যাপকের ক্রোধের লক্ষ্য নিয়ে সমস্যা – তিনি কখনো ক্রুদ্ধ ব্যক্তির ওপর, কখনো রাষ্ট্রের ওপর, কখনো নানা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর – এই একবার তিনি মিডিয়াকে একহাত নিলেন, তারপর পুলিশের তথা বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন, ওই আবার সেনাবাহিনীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন তার দুরন্ত ক্ষোভ। সব মিলিয়ে মনে হয় আলাদা করে খুন না করে অধ্যাপক একটা বিরাট বড় বোমা বানিয়ে তা ফেলতে পারতেন দেশের ওপর, ল্যাঠা চুকে যেত। আশ্চর্যরকমভাবে, তিনটে প্রতিষ্ঠান তার ক্রোধের আওতার বাইরে থেকে যায় –দেশের আইন-প্রণয়নকারী রাজনেতারা (একজন এমএলএ তার শিকার হন বটে, তবে তার কারণ তার পোলিসি-মেকিং নয়, তার ব্যক্তিগত দুর্নীতি), সেই আইন বলবতকারী আমলাতন্ত্র এবং বর্তমান সময়ে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাটাকে কৌশলে নিয়ন্ত্রণকারী বিশাল সম্পদের মালিক কর্পোরেট পুঁজিপতিরা। কেন?
Previous Kaahon Theatre Review:
নাটকের অনেক কিছুই যুক্তির তোয়াক্কা করে না। এমন ভয়ঙ্কর অপরাধীর সাথে এত কাছে এসে কথা বলা যায়, যেখানে পাহারায় থাকে মাত্র একজন পুলিশকর্মী? যারা অদৃশ্য থেকে শেষে অধ্যাপককে গুলিবিদ্ধ করলেন, সেই পেয়াদারা কেন অধ্যাপককে তার পুরো গল্পটা বলার সুযোগ দিয়ে তারপর তাকে মারবেন, বিশেষত মারার মুহূর্ত আর তার আগের অনেকটা সময় জুড়ে গোটা পরিস্থিতিটা একই থাকে? সমস্যা আরো আছে – একদিকে মীরাটে দাঙ্গার প্রতিবাদে মৌলালিতে মোমবাতি মিছিল করা নিয়ে কটাক্ষ করা হয়, অথচ ভারতের শিশুদের দুরবস্থা বোঝাতে গিয়ে পর্দায় ফেলা হয় সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের নিহত শিশুদের ছবি। পর্দায় থেকে থেকেই ভেসে ওঠে পৃথিবীর মানচিত্র; সেজন্যই কি ওই ছবি? ইন্টারনেটের দৌলতে গোটা পৃথিবী ও তাতে ঠেসে ভরে থাকা অন্যায় চিত্রাকারে সত্যিই আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু সেখানকার গভীর ক্রাইসিসের ভেতরে এতটুকু প্রবেশ না করে, আলগাভাবে সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা ছবি দেখিয়ে ইমেজ-ড্রপিং করার লোভটা সংবরণ করলে বোধহয় ভালো হত। নাটকে বলা হল, ছবি দেখানো হল গাছ থেকে উল্টো ঝুলিয়ে কয়েকজন দলিতের ওপর অকথ্য অত্যাচারের কথা – আবার শেষে ঠিক সেই দৃশ্যকল্পই মঞ্চে হাজির করা হল একজন অভিনেতাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে। একদিকে টিভির দর্শকদের রোমহর্ষক বীভৎসতার প্রতি ঈক্ষণকামী আকর্ষণকে সমালোচনা করা হল, অন্যদিকে সহানুভূতি আদায়ের অছিলায় নাটকের দর্শকদের ঈক্ষণকামীতা পরিতৃপ্তির আয়োজন করা হল। নাটকের একটা দৃশ্য অন্য আরেকটা সিকোয়েন্সের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তার একটা উদাহরণ দেওয়া থাক। এক সৈনিককে হাজির করা হয়, সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ যাকে এমন একটি মারণযন্ত্রে পরিণত করেছে যে জোরে শব্দ শুনলেই সে গুলি চালিয়ে দেয়, বিচার করে না কাকে, কেন সে গুলি করছে। সে ছ’জন নির্দোষ, নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলেছে, সাধারণ সমাজ/পরিবার জীবনে, যুদ্ধে নয়। নাটকে কাঠগড়ায় তোলা হয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণকে যা মানুষকে যন্ত্র বানিয়ে দেয়। অন্যদিকে, নাটকের শেষে আমরা দেখি এক জোড়া ভাইবোনকে যাদের শুরুতেও আমরা দেখেছি – ভাই শুরুতে এবং শেষেও হিংস্র, যে হিংস্রতা সে শিখেছে টিভি থেকে, বৃহত্তর সমাজ থেকে। কিন্তু তার বোন স্বাভাবিক, শান্তিকামী – সে নাটকের অন্তিম দৃশ্যে ফুল ও মোমবাতি নিয়ে হাজির হয়। তাহলে দাঁড়ালো কি? একই শিক্ষায় একজন হয়ে যাচ্ছে হিংস্র ও অন্যজন থাকছে অহিংস; অর্থাৎ নিজস্বভাবের দায় অনেকটাই ব্যক্তি মানুষের ওপরেই বর্তায়। তাই যদি হবে, একজন সৈনিকের পাভ্লোভের কুকুর সদৃশ যন্ত্র হয়ে যাওয়াটার পুরো দায়টাই কি করে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের হয়, ব্যক্তির মনস্তত্ত্বিকগঠনের দায় এতটুকু না থেকে? নাটকের তর্কের বিভ্রান্তি আমাদের ক্লান্ত, হতাশ করে।
নাটক থেকে নাট্যে এলেও সমস্যা কমে না। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে, বসার ঘরের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রান্নাঘরে থাকা স্ত্রীর সাথে নাগাড়ে চেঁচিয়ে কথা বললে শেষ সারির দর্শক তা শুনতে পান বটে, কিন্তু তা দফারফা করে দেয় আখ্যানের রিয়্যালিস্টিক চরিত্র। মেয়ে ব্যথা পাওয়ার সাথেসাথেই যে দ্রুততায় মা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন, মনে হয় তিনি জানতেন এবার মেয়ে ব্যথা পাবে। এগুলো ছোট সমস্যা। এই নাট্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা এর অতিনাটকীয়তা, যার দায়ভারের সিংহভাগ অবশ্যই নির্দেশক শ্যামল চক্রবর্তীর। তিনি নাট্য বেঁধেছেন দুর্দম, শ্বাস-নেওয়ার-সময়-নেই গতিতে (যাতে নাট্য চলাকালীন নাটকের যুক্তির অজস্র ফাঁকফোকর লাফিয়ে পেরিয়ে যাওয়া যায়, দর্শকদের তা নিয়ে ভাবার সময় না দিয়ে?) এবং সংলাপ বলা, অঙ্গসঞ্চালন করা অত্যন্ত উচ্চগ্রামে। যেখানে মেঝেতে দাঁড়ানোই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত (অভিকর্ষের কেন্দ্র সম্পর্কে অধ্যাপকের অজ্ঞতা অমার্জনীয়), সেখানে তিনি অভিনেতাকে উঠিয়ে দিয়েছেন টেবিলের ওপর এবং অন্য অভিনেতাকে একটা অদ্ভুতরকম অস্বস্তিকর ভঙ্গিমায় এক পা তুলিয়েছেন সেই টেবিলের ওপর – এতে নাটুকেপনা জিতেছে, যুক্তি ও বাস্তবতার চাহিদাকে পরাস্ত করে। অধ্যাপকের ভূমিকায় সঞ্জীব সরকার তার নির্দেশকের অতিনাটকের দাবী মিটিয়েছেন; থেকেই থেকেই মাথার ওপর শূন্যে তোলা হাতের বিচিত্র মুদ্রা এই কাজে তাকে বিশেষ সহায়তা করেছে। সাংবাদিকের চরিত্রের দাবী মেনে প্রথমে একটা প্রশিক্ষিত কৌতূহল এবং পরে সন্ত্রস্ত সমবেদনা ও বেশ কিছুটা বিতৃষ্ণা ফুটিয়ে তোলার কাজটা সঞ্জিতা মুখোপাধ্যায় যথেষ্ট কুশলতার সাথে করেছেন। নজর কেড়েছে কাজল শম্ভুর নিয়ন্ত্রিত অভিনয়, বিশেষত এমন একটি নাট্যে যেখানে সবকিছু বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা প্রকট। এই প্রযোজনায় প্রজেক্শনের মাধ্যমে স্থির ও সচল চিত্রের ব্যবহার বেশ ভালো লাগে – এর অন্যতম কারণ প্রজেক্শন এসেছে টেক্সটের প্রয়োজন থেকে। একটি জায়গায়, পর্দার সচল দৃশ্য ও মঞ্চের দৃশ্য মিলিয়ে দেওয়াটা বিশেষ পটুত্বের সাথে করা হয়েছে।
হন্তারক কোথায় দর্শককে ছুঁয়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না – যে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পক্ষে অসম্ভব, সেই লড়াই যখন মঞ্চে আমাদের হয়ে কেউ লড়ে দেয় তখন আমাদের মধ্যে জমে থাকা পুঞ্জিভুত ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হয়, আমরা আরাম পাই। ঠিক এই কারণেই angry young man নায়ক একা হাতে দুষ্টের দমন করছেন আইনের/বিচার ব্যবস্থার তোয়াক্কা না করে, এমন বেশ কিছু হিন্দী সিনেমা কয়েক দশক আগেকঅসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে মাথায় রাখার, এই ধরণের ছবির রাজনীতি খুব গোলমেলে। দর্শকদের ক্ষোভ খুঁচিয়ে দিয়ে, তারপর নানা কাণ্ডকারখানার মধ্যে দিয়ে সেই ক্ষোভ উগড়ে বের করে এনে নিঃশেষ করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত স্থিতাবস্থাকে জিইয়ে রাখাই হয়। এই ধরণের প্রায় সমস্ত সিনেমা শেষ হয় নায়কের মৃত্যু বা তার জেলে যাওয়া, এবং তারপর একটা ছোট্ট দৃশ্য দিয়ে, যেখানে সাধারণ শান্তির জীবনের আসা চিহ্নিত হয়। সেভাবে দেখলে এই ধরণের সিনেমা সমাজের অন্যায় মেটানোর উস্কানি তো দেয়ই না, বরং এমন একটা সেফটি ভাল্ভের মত কাজ করে, যেখান দিয়ে দর্শকের ক্ষোভ বেরিয়ে উবে যায় এবং দর্শক ঝাঁকের কই হয়ে ঝাঁকে ফিরে যায়। হন্তারক নাট্য তার প্লট্, তার নায়ক, তার শেষ দৃশ্য, তার প্রায় সবটা নিয়েই একবারেই ওই ধরণের হিন্দী সিনেমার মত – আমরা ভাবি আমরা নাড়া খেয়েছি, কিন্তু আসলে আমরা একটু নড়ে চড়ে আবার একই জায়গায় ফিরে আসি।