শান্তিপর সাংস্কৃতিকের নবতম প্রযোজনা গুলি নাট্যে বিরতির ঠিক আগে একটি মুহূর্ত তৈরী হয় যেখানে সফল, সেলিব্রিটি লেখক তপোব্রত আর তার স্ত্রী সুতপার সংঘাত চরমে ওঠে। তাদের সম্পর্কের বাঁধুনি আলগা হয়ে গেছে, এবার তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তপোব্রত’র প্রধান সমস্যা (অন্তত সে যেভাবে ব্যাপারটা উপস্থাপনা করে) এটাই যে সুতপা ‘শব্দনির্বোধ’, সে ভাষার জাদু বোঝে না, সে লেখালেখি বোঝে না, সে কবিতা-অজ্ঞ। তপোব্রত অবজ্ঞা ও ঘৃণা মিশিয়ে বলে সুতপা ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটাও জানে না। এরপর আবহে ধ্বণিত হতে থাকে স্ট্যাকাটো, কর্কশ একটি ছন্দ যার সাথে সুতপা গলা মিলিয়ে চিৎকার করে আউড়াতে থাকে ‘আমাদের ছোট নদী’। তার তীব্র ক্ষোভ, গ্লানি, অসহায় হাহাকার ঠিকরে বেরোতে চায় তখন। বেরোতে চায়, কিন্তু পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারে না। প্রতিটি নাটকই খোঁজে এমন কিছু নাট্যমুহূর্ত যেখানে টেক্সট, বিন্যাস ও পারফরম্যান্স একজোট হয়ে এমন অর্থ উৎপাদন করবে যা আখ্যানের ও চরিত্রদের মূল ক্রাইসিস ব্যক্ত করবে এবং দৃশ্যের সামগ্রিক অভিঘাত দর্শকদের মনে, মাথায় গেঁথে যাবে। গুলি নাটকে এই মুহূর্তটি ছিল এমনই একটা সম্ভাবনাময় মুহূর্ত, যা জন্ম নিতে গিয়েও কোথায় যেন আটকে গেল।
Kaahon Theatre Review
HRIDIPAASH – SOME HITS, SOME MISSES
Read this : https://t.co/iY4pLbUOht#theatrereview | #kaahontheatrereview pic.twitter.com/wZ5z1miqBV— kaahon (@kaahonwall) August 23, 2017
গোটা নাটকটাই যেন, দৃশ্যটার মতই, হয়ে উঠতে গিয়েও আটকে যায়।এই আটকে যাওয়ার প্রধান কারণ, আমার মতে, নাটকটির টেক্সট, যা লিখেছেন কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, যিনি এ নাটকের নির্দেশকও। টেস্কট নিয়ে আলোচনার আগে আরেকটা কথা – বলা হয়েছে নাটকটি রচিত চেকোস্লোভাকিয়ার লেখক ক্যারেল কাপেকের লেখা অবলম্বনে। কিন্তু কোন লেখা? ছোট গল্প, নাকি নাটক? কাপেক গত শতাব্দীর শুরুর দিকে বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, নাটক লেখেন; R.U.R. নাটকে ব্যবহার করেন তার ভাই যোসেফের বানানো robot শব্দটি, যা ইংরেজি ভাষায় ঢুকে যায় তার মানে অক্ষুণ্ণ রেখে; তিনি ছিলেন fascism, militarism ও communism, এসবেরই বিরোধী। গুলি নাটক কাপেকের কোন টেস্কট অবলম্বনে লেখা তা কেন বলা হল না তা বোধগম্য হল না। যাই হোক, যে নাটক কৌশিক লিখেছেন তা ভাষার দিক থেকে অত্যন্ত সুঠাম, তবে আখ্যানের গঠনে দুর্বল। একথা বলার কারণ বিষদে আলোচনা করছি পরের অনুচ্ছেদে।
তপোব্রত (অশোক মজুমদার) এক সন্ধ্যায় একলা মদ্যপান করতে বসেন আর হঠাৎ একটি গুলি কোথাথেকে এসে তার জানলার কাঁচ সশব্দে ভেঙ্গে দেয়। পুলিশ আসে, শুরু হয় তদন্ত। একটা প্রশ্ন সামনে আসে – তপোব্রত’র কি কোন শত্রু আছে? এই প্রশ্নের হাত ধরে তপোব্রত’র অতীতে ঢুকে পড়ে আখ্যান। এক এক করে সামনে আসে মহসীন (ছোটবেলার বন্ধু, উজান চট্টোপাধ্যায়), সুতপা (প্রাক্তন স্ত্রী, রাত্রি চট্টোপাধ্যায়), মনীষা (প্রাক্তন প্রেমিকা, বর্ণালি চট্টোপাধ্যায়) এবং একজন ফুটপাথবাসী পঙ্গু মানুষ (বাবলা বসাক), তপোব্রত মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে যার মেয়েকে মেরে ফেলেছে এবং যার পা নষ্ট করে দিয়েছে। আখ্যান যে সফল ও বিখ্যাত লেখকের অন্ধকার অতীতের ওপর আলো ফেলতে ফেলতে এগোচ্ছে তা বুঝতে আমাদের বিশেষ দেরি হয় না। জানা যায় ছেলেবেলার বন্ধুই হোক, স্ত্রী বা প্রেমিকা, সবার সাথেই তপোব্রত অন্যায় করেছে, সকলকেই ব্যবহার করেছে, খ্যাতি খোঁজার ও বজায় রাখার নিরন্তর তাড়নায়। সমস্যা এখানে মূলত দুটো – গুলি যে সাসপেন্স তৈরী করে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। প্রথমে কমবয়েসের বন্ধু মহসীন, আর তারপর স্ত্রী সুতপার আগমনের সাথে সাথেই বুঝতে বাকি থাকে না নেশাতুর অবস্থায় গুলির আওয়াজ শুনতে পাওয়া একধরণের মানসিক বিদারণ হাজির করার একটি সাধনী, যা তপোব্রতকে তার অতীতে প্রবিষ্ট হতে দেয়। আখ্যান একটা প্যাটার্নে পড়ে গিয়ে হয়ে যায় সহজেই অনুমেয়, যার ফলে যখন মনীষা ও আরো পরে যখন লোকটি আসে, গল্প ততক্ষণে ‘তারপর? তারপর কি?’ এর উত্তেজনা হারিয়ে ফেলেছে। আরো বড় সমস্যা হচ্ছে যে তপোব্রত’র তারকা অবস্থান, তার খ্যাতির উচ্চতা তাকে এতটাই সাধারণের স্তর (যেখানে থাকি আপনি, আমি) থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় যে তার ক্রাইসিস কোনভাবেই আমাদের ক্রাইসিস হয়ে ওঠে না। আর সত্যি কি কোন ক্রাইসিস তপোব্রত’র জীবনে আছে? সে কি অনুতাপে দগ্ধ হয়, তাকে কি তার অন্তরাত্মা পীড়া দেয়? নাকি, সন্ধ্যা গড়িয়ে যে রাত নামে তা পেরিয়ে যখন সকাল আসে আর কেটেযায় তার নেশার ঘোর, তখন দুঃস্বপ্ন-মুক্ত তপোব্রত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবার ঢুকে পড়ে তার সফল জীবনে, যে জীবন আমরা সবাই বুঝি কখনোই আসলে বিপন্ন হয়নি? যাদের সাথে আমরা একাত্ম হতে পারতাম – মহসীন, সুতপা, মনীষা বা লোকটি – আখ্যান তাদের খুব সামান্যই আলোকিত করে।
অভিনয় বিষয়ে কয়েকটা কথা। তপোব্রত’র ভূমিকায় অশোক মজুমদার গোটা নাট্য নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। গুলির শব্দের পর আমরা পাই এমন তপোব্রতকে, তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে, যে তাঁর খ্যাতির চকচকে মোড়কের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে তাঁর সমস্ত অসুন্দর নিয়ে। এই জায়গাগুলোর বেশির ভাগটাই অশোক নির্মাণ করেছেন চড়া সুরে, যা তার চরিত্রের কুশ্রী দিকগুলো ফুটিয়ে তোলে বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবে। সমস্যা হয়েছে বিশেষ করে সেই দৃশ্যে যেখানে অশোক পেয়েছেন তার সহভিনেতা হিসেবে রাত্রিকে এবং বাবলাকে – এরা দুজনেই অভিনয় করেছেন উচ্চগ্রামে, যার ফলে সব মিলিয়ে দৃশ্যগুলো বড্ড চিৎকৃত ঠেকেছে। উজান কিন্তু তার চরিত্র ফুটিয়েছেন ধীর লয়ে, খাদে অভিনয় করে এবং অশোকের সাথে তার যুগলবন্দী জমেছিল ভালো। মাথায় রাখতে হবে মহসীন, সুতপা, মনীষা, লোকটি এবং কৃষ্ণপদ (দিব্যেন্দু বর্মণ রায়) চরিত্রগুলো তপোব্রত’র স্মৃতি বা কল্পনা থেকে উঠে আসা – তারা সে অর্থে রক্ত মাংস দিয়ে তৈরী নয়। উজান একটা হাল্কা ঘোরের অনুষঙ্গ জড়িয়ে দিয়েছিলেন তার চরিত্রের গায়ে এবং দিব্যেন্দু এনেছিলেন একটা সূক্ষ্ম কমিক ছোঁয়া, যার ফলে তাদের চরিত্রগুলোকে বাস্তবের থেকে একটু যেন দূরে যেতে পেরেছিল, টেস্কটের প্রয়োজনমাফিক। মনীষা চরিত্রে বর্ণালি যদিও সাবলীল, তিনি তার চরিত্রের ছায়াময়তা/পরাবাস্তবতা সৃষ্টি করার ব্যাপারে আলাদা নজর দিয়েছেন বলে মনে হয় নি, যেমন মনে হয়নি সুতপার চরিত্রে রাত্রির বা লোকটির চরিত্রে বাবলার কাজে। অসিত প্রামাণিক তার মাধব চরিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন তপোব্রত’র প্রতি তার স্নেহের দিকটা – মাধব এত কাছ থেকে তপোব্রতকে দেখেও কি জানতে পারেনি তার চরিত্রের ও জীবনের অন্ধকার দিকের কথা? পারলে, সেটা অভিনয়ে এলো না কেন?
মঞ্চ করেছেন জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় যা নিয়ে আলাদা করে বিশেষ কিছু বলার নেই, শুধু এটা ছাড়া যে কৌণিক দরজার ফ্রেম, চেয়ারের পিঠ ইঙ্গিত করে এই নাটক বাস্তবকে তির্যকভাবে দেখবে। সুদীপ সান্যালের আলো এবং উজান চট্টোপাধ্যায়ের আবহ যে গুলির শব্দের আগে ও পরে বিশেষ কোন মাত্রা যোগ বা বিয়োগ করে না তা নাট্যের অভাবের বিষয় হয়ে যায়। তপোব্রত যখন খুব কাছ থেকে বসে টিভি দেখে তার মুখে এসে পড়ে স্ক্রিনের আভা যা স্থির থাকে, ফ্লিকার করে না। সুদীপ এতটা অসাবধান হন না সাধারণত।
গুলি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি এটা বলতেই হয় কারণ কোজাগরী, যদিও তা অন্য দলের প্রযোজনা, কৌশিক-অশোক জুটির কাছে প্রত্যাশার মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এটাও বলতে হয়, চমক আর গিমিক দিয়ে মন ভোলানোর কোন প্রচেষ্টাওগুলি করে না – এই নাটক ভালো কারো নাও লাগতে পারে, কিন্তু নাটক দেখে কেউ মনে করবেন না যে তাকে ঠকানো হয়েছে। একটা সর্বার্থে সার্থক প্রযোজনা না হওয়া স্বত্ত্বেও দর্শক মোটের ওপর নাট্যটি গ্রহণ করেছেন বলেই মনে হয়। দর্শক কৌশিক ও আশোকের মত নাট্যে সম্পূর্ণ নিয়োজিত, গুণী মানুষদের কদর করতে প্রস্তুত থাকবে বলেই মনে হয়।