শুরুতেই পরিস্কার করে দেওয়া যাক। এটা কোন রিভিউ নয়, এটা একটা প্রতিবাদ। গিলেরমো আরিয়াগা’র লেখা ও আলেয়ান্দ্রো ইনারিত্তু’র নির্দেশনায় তৈরী চলচ্চিত্র টোয়েন্টি ওয়ান গ্রামস ’এর ওপর আধারিত নৈহাটি ব্রাত্যজনের নাটক একুশ গ্রাম (২১ গ্রাম) ভাবানুগ্রহণের (এড্যাপ্টেশনের) নামে যেভাবে একটি টেক্সটকে ধ্বংস করেছে, এই লেখা তার প্রতিবাদ। এটাও বলে নেওয়া জরুরী, যারা এই সিনেমাটা দেখেননি, তাদের পক্ষে এই লেখার যুক্তি তর্ক পুরোটা ধরা সম্ভব হবে না। এ জন্য মার্জনা চেয়ে রাখলাম।
নাটকটি লিখেছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, নির্দেশনা করেছেন ব্রাত্য বসু। এই ‘রিভিউ’ নাটকের মঞ্চায়নের বিভিন্ন দিক – নির্দেশনা, অভিনয়, মঞ্চ ভাবনা ও নির্মাণ, আলো, আবহ সঙ্গীত – নিয়ে কোন কথাই বলবে না। তার কারণ, আমার মতে এড্যাপ্টেশনের স্তরেই, অর্থাৎ লিখিত টেক্সট নির্মাণের সময়েই, যে বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে, মঞ্চায়নে কোনভাবেই সেই ক্ষতি পূরণ হওয়া সম্ভব নয় ও তা হয়’ও নি। এই লেখা শুধু চেষ্টা করবে সিনেমা থেকে নাটক নির্মাণ করার ক্ষেত্রে যে পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে এবং যে ভাবনা কাজ করেছে সেই পন্থা নির্বাচন করার জন্য (অন্তত আমার কাছে সে ভাবনা যেভাবে ধরা দিয়েছে), তার ওপর আলোকপাত করতে।
থিসিস নাটক প্রকটিতভাবে স্রষ্টার ভাবাদর্শ সমূহ প্রকাশ করে : https://t.co/jvAgw565xR#thetare pic.twitter.com/B9V7O7DDbb
— kaahon (@kaahonwall) April 8, 2017
অত্যন্ত সংক্ষেপে, টোয়েন্টি ওয়ান গ্রামস সিনেমাটি একটি অরৈখিক (নন-লিনিয়ার) আখ্যান গড়ে তোলে, যেখানে একটি দূর্ঘটনা কয়েকটি বিচ্ছিন্ন মানুষকে আচমকাই জড়িয়ে দেয় একে ওপরের জীবনের সঙ্গে। তৈরী হয় দমবন্ধ ট্র্যাজেডির একটা বাতাবরণ, যদিও সিনেমার শেষ লগ্নে আশার একটা হাল্কা আভাস থাকে। মূল কথা হচ্ছে, টেকনিকের নৈপুণ্য শুধু নয় (ক্যামেরা, সম্পাদনা, ফ্রেম নির্মাণ ইত্যাদি), কাহিনীর কালক্রম ভেঙ্গে দিয়ে সময় সম্পর্কেই একধরণের সচেতনতা তৈরীই শুধু নয়, অবিস্মরণীয় অভিনয় শুধু নয় (শন পেন, নাওমি ওয়াটস, বেনেচিও দেল তোরো এবং অন্য শিপ্লীরা) – এই ছবি আমাদের যা দেয় তা হচ্ছে জীবন ও অস্তিত্ব সম্পর্কেই খুব গভীরভাবে, খুব নিবিষ্টচিত্তে ভাবার প্রচুর উপাদান। টোয়েন্টি ওয়ান গ্রামস হচ্ছে ছবি ও শব্দ দিয়ে নির্মিত একটা দার্শনিক ডিসকোর্স। যারা ইচ্ছুক, তারা এই প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন, যেখানে রবার্ট হান এই ছবিটিকে তুলনা করেছেন, ভাবনার গভীরতার নিরিখে, ইডিপাস রেক্স ও কিং লিয়ারের সাথে।
21 Grams; Robert Hahn; Film Quarterly
এইরকম একটা টেক্সট নিয়ে উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় কাজ করতে গেলেন সম্পূর্ণভাবে হ্রাস করব, লঘু করব, তুচ্ছ করব এই অভিমূখ স্থির করে। ছবিতে হৃদয় প্রতিস্থাপনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আছে; নাটকে সেখানে আমদানি করা হোল এই প্রক্রিয়ার খরচের বিষয়। লোকজন আজকাল বেসরকারী হাসপাতালের টাকার খাঁই নিয়ে কথা বলছে বলে? বারবার করে হাজির করা হোল দূর্ঘটনায় মৃত দু’টি শিশুকে জন্মদিনের পার্টির পোশাকে, সস্তা ভাবপ্রবণতা ঢোকাতে। দর্শক সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি চায় এটা ধরে নিয়ে? সিনেমায় একটি চরিত্র নিদারুণভাবে যীশুকে আঁকড়ে ধরে অতীতের অপরাধের জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, তার বেঁচে থাকার মধ্যে একধরনের আধ্যাত্মিক অর্থ নিয়ে আসার জন্য। সিনেমায় ঐকান্তিক ও গভীর ধর্ম বিশ্বাসের যে ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছিল, নাটকে তার জায়গায় আনা হোল মোটা দাগের কুসংস্কার; নিবেদিত যাজক হয়ে গেল কদর্য ভাঁড়ামো করে যাওয়া প্রতারক জ্যোতিষী। সিনেমায় ইউজেনিও মন্তেয়ো’র লেখা একটা কবিতা উল্লিখিত হয় মূলত আবহমান কাল ধরেই মানব জীবন জুড়ে আছে যে অনিশ্চয়তা, তার দিকে ইঙ্গিত করতে। জীবনানন্দের আকাশলীনা কবিতা আর যাই করুক অনিশ্চয়তার ব্যঞ্জনা বহন করে না। গোটা এড্যাপ্টেশন জুড়েই থাকে সূক্ষ্মকে স্থূল ও জটিলকে সরল করার উদ্যোগ। ভাবানুগ্রহণ করতে গিয়ে মূল টেক্সটকে খাটো ও ছোট করে দেব, টেক্সটের ভাবনাগত গভীরতার জায়গাটাকে নষ্ট করে একটা চমক-সর্বস্ব স্পেক্টাকেল তৈরী করব – এটা ঘটে সম্ভবত দু’টো কারণে। এক, ধরে নেওয়া হয় নব্বই শতাংশ দর্শক সিনেমাটা না দেখেই আসবেন নাটক দেখতে, তাই তাদের ফাঁকি দেওয়াটা কোন ব্যাপারই নয়। এটাও ধরে নেওয়া হয় যে দর্শক চান শুধু জমজমাট বিনোদন, তারা ভাবতে চানও না, পারেনও না। দুই, আমরা বাঙালিরা এখন মেধাচর্চা ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে এতটাই খাটো করে নিয়েছি নিজেদের, যে গভীরতা সম্পন্ন, ব্যাপ্তি সম্পন্ন কোন টেক্সটের সামনে দাঁড়ালে আমরা একটাই কাজ করতে পারি – টেক্সটাকে কেটে, ছেঁটে, লঘু ও হ্রাস করে আমাদের ক্ষুদ্রতার কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারি। যিনি এই লেখা পড়বেন তার কাছে একটা সনির্বন্ধ অনুরোধ করব – না এটা নয় যে নাটকটি দেখবেন না। সেটা আপনার মর্জি। অনুরোধ এটাই, টোয়েন্টি ওয়ান গ্রামস সিনেমাটি দেখুন। একটি অসামান্য শিল্পকর্মের সাথে ঘন্টা দুয়েক কাটান। দেখবেন, সিনেমাটি আপনাকে অনেক কিছু নিয়ে – আপানার জীবন নিয়ে – নতুন করে ভাবার রসদ দেবে। আর যদি তারপরও আগ্রহ ও সময় থাকে, এই লেখাগুলো পড়ে দেখতে পারেন, যা প্রমাণ করে উচ্চমানের শিল্প কি ধরণের উৎকৃষ্ট ডিসকোর্সের জন্ম দেয়। সংস্কৃতিচর্চা এইটুকু পরিশ্রম আপনার কাছে দাবী করে।
১। Irresistible Death: “21 Grams” as Melodrama; Michael Stewart; Cinema Journal
৩। THE EARTH TURNED TO BRING US CLOSER; Bruce L. Hay
দীপঙ্কর সেন