নাটকের নাম একটি উত্তর আধুনিক সামাজিক পালা। নামটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে এর মধ্যে একটা উত্তর-আধুনিক ব্যাপার রয়েছে এবং বিষয়বস্তু অবশ্যই সামাজিক। উত্তর আধুনিক… সহজ “বাংলায়” বললে পোস্টমডার্ন। “সহজ বাংলায়” বলা বাঞ্ছনীয় কারণ বাঙালির ইংরিজি প্রীতি “বাংলাটা কেন পড়ায় না ইংলিশে?” ধরনের প্রশ্ন করতে শেখায়…এই জাতীয় বোকা বোকা (স্টুপিড) বহু চর্চিত (ওয়াইডলি ডিসকাস্ড) প্রসঙ্গ টেনে আনতাম না, যদি না সামাজিক “পালা”টি একটি পাক্কা ইউরোপীয় প্লে হয়ে মঞ্চে নামত।
যাইহোক, নাটকটা বোঝার জন্য “প্লে” আর “পালা” নিয়ে কচলানো কি জরুরী? বিল্কুল নহি। একটি ইউরোপীয় নাটক বাঙালির পালা বলে নামকরণ করায় আপত্তি? আজ্ঞে না। বাঙালি রোজ বিন্দুমাত্র ক্রিম ছাড়া একটা ইটের মত শক্ত বিস্কুটকে ক্রিম ক্র্যাকার বলে,বাঙালির নামে কি আসে যায়? তাছাড়া প্লে আর পালা- দুটোরই ব্যাঞ্জনবর্ণ (কনসোনেন্ট) গুলো একই। দুটোর মধ্যেই একটা পারফরমেন্সের ব্যাপার আছে। স্বরবর্ণ গুলো আলাদা তাই শব্দ দুটোর এবং পারফর্মেন্স দুটোর স্বাদটা আলাদা। কি আর করা যাবে? বহুস্বর যে সমাজে তুলতেই দেওয়া হয় না, সেখানে কি স্বরবর্ন (ভাওয়েল) নিয়ে মাথা ঘামালে চলে?
Previous Kaahon Theatre Review:
অথচ বহুস্বর ব্যাপারটা বহু-সর মানে রাবড়ির মতই গুরুত্বপূর্ণ। (রাবড়ির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না।)। বহু সরের প্রলেপে রাবড়ি যেমন সুস্বাদু হয় বহু স্বরের সহাবস্থানে সমাজ হয়ে ওঠে প্রাণ খুলে বাঁচার মত বাসযোগ্য। বহু শর (মাল্টি অ্যারোড উন্ড) খেয়ে এখনও কেউ কেউ এইরকম একটা সামাজিক সাম্য নিয়ে আসার একরকম চেষ্টা করে যাচ্ছেন, না পারলেও একরকম স্বপ্ন দেখছেন। এই নাটকের লেখক ও নির্দেশক জয়রাজ ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে একজন। যদিও তাঁর স্বপ্ন একান্তই এক স্বরে বাঁধা – সোশালিসম। তবে সোশালিসম এক মাত্রিক এমনটা বলা যায় না।
তিনি স্বপ্ন দেখেন বিপ্লব আসবেই এবং একদিন সেই বিপ্লব পরবর্তী সমাজে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বণ্টন হবে। সেই সমাজে সবচেয়ে কনফিউসড অবস্থান হবে মিডিয়ার কারণ অভিযোগের দেনা-পাওনা, অসাম্যের নামকরণ হুট বললেই ইচ্ছেমত দেগে দিয়ে টেলিকাস্ট করা সম্ভব হবে না। তবেআসন্ন এই সমাজের নিরিখে নির্দেশক দেগে দিয়েছেন বাংলার অধিকাংশ রাজনিতিক ও বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান। (কিভাবে কনফিউসড হবে মিডিয়া আর কে কোন অবস্থানে আছেন সেসব নাম জানতে হলে নাটকটা দেখতে যেতে হবে।) জয়রাজ ভট্টাচার্যের এই স্বপ্ন দেখার মধ্যে একধরনের যুগোপযোগী তাগিদ খুঁজে পাওয়া যায়, খুঁজে পাওয়া যায় কনভিকশন। বাংলা থিয়েটারে এই দুটি বিষয়েরই আশঙ্কাজনক মাত্রায় অভাব।
তাহলে এত অবধি পড়ে এটুকু অন্তত বোঝা গেল এই নাটকটা একটা পোস্ট-মডার্ন ইউরোপীয় প্লে, নাটকের লেখক ও নির্দেশক জয়রাজ ভট্টাচার্য, এই নাটকটির মধ্য দিয়ে একটা সামাজিক সাম্যের স্বর তোলার চেষ্টা রয়েছে এবং নাটকটি যুগোপযোগী এবং “এমনি এমনি, চল নাটক করি” বলে করা হয়নি। বাংলা থিয়েটারের এমন এমন প্রচেষ্টাই প্রাপ্য।
এবার আবার একই বাক্সে ফিরে যাওয়া যাক (ব্যাক টু দ্য সেম স্কোয়ার)। নাটকের নাম একটি ‘উত্তর আধুনিক সামাজিক পালা’। প্রথম প্রশ্ন, উত্তর আধুনিক বা পোস্টমডার্ন মানে কি? এক কথায় বলতে গেলে… ব্যাপারটা এক কথায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। (গুগুল করুন অথবা পোস্টমডার্নিজম-এ ক্লিক করুন) ব্যাপারটা আরোই জটিল হয়ে উঠবে যদি আপনি অ্যাক্যাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের না হন। পৃথিবীর অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই এই সমস্ত টার্ম গুলোকে খুব জটিল ভাবে ব্যাখ্যা করে এসেছেন (কারণ জানা নেই।) অর্থ, সুযোগ এবং মেধার দিক থেকে দাগিয়ে দেওয়া সাধারণ শ্রেণীর জন্যই মূলত কথা বলেন যারা তাঁদের মধ্যে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশী।
এই আলোচনাটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ কারণ সুযোগ মেধা এবং অর্থের দিক দিয়ে যারা সাধারণ নন, তাঁরা যখন সাধারণ লোকেদের বোঝা ও জানার বাইরে তাঁদের নিয়ে এবং তাঁদের জন্য কথা বলতে চান বা কাজ করতে চান তখন তা কম জানা লোকেদের কাছে দুই ভাবে প্রতিফলিত হয়-
১। এঁরা আমাদের করুণা করে উদ্ধার করতে চাইছেন এবং আমাদের জ্ঞান বুদ্ধির বিকাশ তাঁদের এই মহত্তর করুণার পথে অন্তরায়।
২। আমাদের জীবন এদের কাছে চর্চার বিষয়। যাপনের যন্ত্রণা আর চর্চার সুখ, দুটো একেবারে উল্টোদিকের রাস্তা, আমাদের নিয়ে আসলে এঁরা আদৌ চিন্তিত নন।
এইটাই বলা যায় একটি উত্তর আধুনিক সামাজিক পালা নাটকের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এবং এইকারণেই এই নাটকটি নিয়ে শুধুমাত্র সাব্জেক্টিভ্লি বা শুধুমাত্র অব্জেক্টিভ্লি আলোচনা করা সম্ভব না। বা বলা ভাল সাব্জেক্টিভ এবং অবজেক্টিভ আলোচনা এই নাটকের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে আনবে।
সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর জন্য তৈরি করা একটি নাটক – যার মূল বক্তব্য সাধারণ মানুষ একদিন জেগে উঠবেই, বিপ্লব আসবে এবং নতুন বাংলা তথা নতুন পৃথিবী গড়ে উঠবে, সেই নাটক সাধারণ মানুষ দেখতে বসলে কোন রসই নিতে পারবে না। নাটকের রস (অভিনয়ের রস নয়) লুকিয়ে থাকে নাটকের রচনায়। এই রচনায় যে সমস্ত রেফারেন্স ব্যাবহার করা হয়েছে যা না বুঝলে নাটকটার রস আস্বাদন করা সম্ভব না এবং সেগুলো ভীষণ ভীষণ এলিট, একেবারেই সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর বোধগম্য হওয়ার মত নয়। বস্তুত, নাটকটি যারা দেখতে গিয়েছিলেন তাঁরা দৃশ্যতই শিক্ষিত এলিট ক্লাসের। তাঁদের পোশাক-পরিচ্ছদ ভাষার ব্যবহার, সবকিছুই বলে দিচ্ছিল তাঁরা কি কি ভাবে সাধারণের থেকে আলাদা হয়ে ওঠার একটা সচেতন প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছেন। একটা সাধারণ মানুষকে নিয়ে, সাধারণ মানুষের জন্য তৈরি হওয়া নাটকের এতগুলো পারফর্মেন্স হয়ে যাওয়ার পরে যখন একটি বিশেষ শ্রেণীই নাটকটি দেখতে আসেন তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না নাটকটি কাদের অ্যাপিল করছে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠেই, এই অ্যাপিলই কি কাম্য? তাহলে উপরোক্ত ওই দুটি বক্তব্যের মধ্যে এক্ষেত্রে কোনটি প্রযোজ্য?
তলিয়ে ভাবলে আরও দুটি ভাবনা আসে –
১। একটি নাটক একটি প্রোডাকশন। প্রোডাকশন হয় প্রডাক্টের। প্রডাক্ট বিক্রি হওয়া জরুরী। সত্যি কথা বলতে আমাদের আগের প্রজন্মের নাটকীয় দাদা জেঠুদের কল্যাণে নাটক একটা নাক উঁচু চর্চায় পরিণত হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে টিভি ও মাল্টিপ্লেক্সের কমপ্লিট এন্টারটেনমেন্ট প্যাকেজের সহজলভ্যতার দরুন নাটকের অবস্থা না ঘর কা না ঘাট কা। আজকের প্রজন্মের সাধারণ মানুষ অধিকাংশই নাটক সম্পর্কে আগ্রহী বা উৎসাহী নন। যারা উৎসাহী তাঁদের আবার “আমি নাটক করছি, সমাজে বদল আনছি” ধরণের নাক উঁচুপনা রয়েছে। ফলত উভয় ক্ষেত্রেই নাটক সাধারণ মানুষের থেকে বহু মাইল দূরে চলে গেছে, হয়ে উঠেছে অ-সাধারণের সম্পত্তি ও চর্চার বিষয়। যারা নাটক করেন তাঁদের লতায় পাতায় ভাই বোন দাদা দিদিরাই নাটক দেখতে আসেন। এই অ-সাধারণ বর্গ আবার “সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়”-তে বিশ্বাসী। একটু দুর্বোধ্য না হলে এঁরা বুঝে ঠিক আনন্দ পান না। এই ধরণের কাস্টমারকে একটি নাটক বেচতে গেলে তা সহজ-স্বাভাবিক-সাধারণ হলে চলে না। চারপাশে ঘটে যাওয়া যে সমস্ত ঘটনায় এঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাবিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হন না সেইসমস্ত ঘটনা (বিশেষত দলগত রাজনৈতিক ঘটনা) এদের ফেভারিট কুইসিন। (হ্যাঁ, ব্যাপারটা কুইসিন পছন্দ করার মতই বাহুল্যের।) সুতরাং একটি প্রডাক্ট বিক্রির মার্কেটিং স্ট্রাটেজি হিসেবে এই আপাত-দুর্বোধ্যতার একেবারে অ্যাপ্ট বা প্রযোজ্য।
(প্লিজ নাটক কি একটা বিক্রির জিনিস? জাতীয় বোকা বোকা প্রশ্ন করবেন না।)
২। বহু বহু বছর ধরে বুদ্ধি এবং বোধ কে পুঁজি করে ব্যবসা শুরু হয়েছে। যাকে সহজ বাংলায় বলে “ইন্টেলেক্চুয়াল ক্যাপিটালিসম”। এই সমস্ত ক্যাপিটালিস্টরা বছরের পর বছর ধরে এই সমস্ত টার্ম, থিওরি, বক্তব্যকে সাধারণের কাছে আনতে দেননি পাছে তাঁদের জ্ঞান ও বুদ্ধির মহত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। এখন এসে সাধারণ মানুষ এসব বোঝে না বলে কোন লাভ নেই। কয়েকটা জেনারেশন ধরে এই দুরত্ব তৈরি হয়েছে। হঠাৎ করে মিটে যাওয়ার সম্ভবনা নেই। এবার এইধরনের ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপিটালিসমের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কারুর যদি পোস্টমডার্নিজমের ভাষায় স্বপ্ন দেখতে এবং দেখাতে ইচ্ছে হয় তাহলে তিনি অনিচ্ছাকৃত ভাবেই সাধারণের থেকে দূরে চলে যাবেন যতক্ষণ না পোস্টমডার্নিজম এবং আনুসাঙ্গিক টার্ম এবং থিওরিগুলি জীবনের ভাষায় বোঝানোর মত শক্তিশালী এবং সাহসী হচ্ছেন।
তাহলে কি এই নাটককি শুধুমাত্র একটি সুরসুরি-জনক প্রডাক্ট? নাকি এই নাটক সেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে দেখানোর উদ্দ্যেশেই করা? প্রথম পদক্ষেপটা কি তাঁদের দিক থেকে আশা করা হচ্ছে? আদৌ কোন পদক্ষেপ আশা করছেন কি নির্দেশক ও তাঁর দল? তাঁদের দিক থেকে তাঁরা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? এলিট ক্লাস’কে জানান দেওয়া? যে সাধারণ মানুষ জেগে উঠবে?
নাটক চলাকালীন এবং নাটক শেষ হলে এইসমস্ত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রশ্ন মাথায় ঘুরঘুর করে। নাটক শেষ হলেও এসবের উত্তর পাওয়া যায় না। অগত্যা এই নাটক একটা অমীমাংসিত সমস্যা হয়েই থেকে যায়। অথচ নাটকের প্রাসঙ্গিকতা দাঁড়িয়ে রয়েছে এই প্রশ্নগুলির উত্তরের উপরেই।
নাটকটি সঠিক এবং সমস্ত অর্থেই পোস্টমডার্ন। বিচ্ছিন্ন ন্যারেটিভ, ইতিহাসের নিরিখে আমাদের অবস্থান, এতদিন ধরে চলে আসা থিওরি ও থিয়োরিস্টদের অবস্থানের প্রতি সংশয় প্রকাশ, নতুন দৃষ্টিকোণের সাপেক্ষে ইতিহাসের বিনির্মাণ এবং সর্বোপরি সামাজিক ভাবে তৈরি হয়ে যাওয়া মূল্যবোধকে প্রশ্ন করা… এই সমস্ত কিছুই এই নাটকটিতে রয়েছে। সুতরাং এই নাটকটির (পারফর্মেন্স ছাড়া, শুধুমাত্র টেক্সটটির) একটি নির্দিষ্ট পলিটিকাল স্ট্যান্ড পয়েন্টও রয়েছে। তাই আপনি যদি রাজনৈতিক ভাবে সচেতন একজন অ্যাকাডেমিশিয়ান হন তাহলে এই নাটক আপনার জন্যই। যদি তা না হন, তাহলে দুঃখিত, এই নাটক আপনাকে নিয়েই তৈরি করা, কিন্তু আপনার জন্য তৈরি করা নয়।
একবার পাড়ার জনৈক বস্তিবাসিনী বৃদ্ধা শাসক দল আয়োজিত কম্বল বিতরণ সভায় কম্বল নিতে না গিয়ে বলেছিলেন – “এমন করে দেশ শাসন করে কেন? যে আমাদের কম্বল কেনার ক্ষমতা থাকেনা, হাত পেতে চাইতে হয়? ঝ্যাঁটা মারি ওরম ভিক্ষের মুখে।” আসল কথা হল এইসব শক্ত শক্ত কথা বোঝার উপর কারুর রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা নির্ভর করে না। রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হতে চাওয়া, সাম্যের পথে এগিয়ে যাওয়া এগুলো এক প্রকারের ইন্সটিঙ্ক্ট। না হলেও এগুলো কঠিন কিছু কথা নয় যা সহজে বোঝানো যাবে না। সমস্যা হল এগুলোকে বেচতে বসে আমরা কঠিন করে ফেলছি। তারপর ওই একরকমের ক্যাপিটালিসমের সার্কেল শুরু হয়ে যাচ্ছে। তারপরে “বাগানে বাড়ছে ধর্ষকাম, তাড়িয়ে দিলেও যাচ্ছে না।“