থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম-এর নতুন নাটক ‘একটি সহজ খুনের গল্প’। এই রিভিউ গত ১৫ই মার্চ, ২০১৯ তারিখে তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহের অন্তরঙ্গ পরিসরে অভিনীত শো-এর নিরিখে রচিত। কাহিনী প্রচেত গুপ্ত; আবহ, আলো, মঞ্চভাবনা ও নির্দেশনায় দেবাশীষ রায়।
দেবাশীষ এই প্রজন্মের একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিচালক। নাট্য প্রযোজনার আনুষাঙ্গিক সব ক’টি বিষয়ের উপর দখল ও দক্ষতার পরিচয় তার পূর্ববর্তী কাজের মধ্যে আমরা পেয়েছি। তার প্রতিটি প্রযোজনা একটির চেয়ে অন্যটি আমাদের কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সব সময় নতুন কিছু দেবার চেষ্টা তার কাজের মধ্যে থাকে। বর্তমান প্রযোজনাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রচেত গুপ্তের গল্পটিকে তথাকথিত নাট্যরূপ দেওয়া হয়নি, মূল চরিত্রের আত্মকথনের মাধ্যমে কাহিনীটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেমন সচরাচর একটি লিখিত গল্প এগিয়ে চলে। ফলে নাটকটি দেখার পর যে অনুভূতি হয় তা একটি গল্প পাঠের অনুভূতির মতো। গল্প পাঠের সময় আমাদের কল্পনায় চরিত্রগুলি যেমন ছবির মতো দেখতে পাওয়া যায়, তেমন ভাবেই নির্দেশক চরিত্রগুলিকে আমাদের সামনে এনেছেন। অন্তরঙ্গ পরিসরে অভিনীত হওয়ায় দর্শকরা সহজেই নাটকের সাথে একাত্ম হয়ে ওঠেন।
গল্পে একটি খুনের ঘটনা ঘটলেও এটি ঠিক মার্ডার মিস্ট্রি বা ক্রাইম থ্রিলার নয়। যদিও নাটকটি দেখার সময় একটা রোমাঞ্চ অনুভূত হয়। আসলে এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের গল্প। গোঁড়া পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাহিনীও বলা যেতে পারে। অবহেলা, তাচ্ছিল্য, যোগ্যতর ব্যক্তির সাথে অসম তুলনা, প্রভৃতি বিষয়গুলি মানবমনে বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করে যা অনেক সময় অভিমান বা রাগ রূপে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে, এবং একসময় তা’, প্রতিশোধের আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে। সে পরিণতি কি চরম হতে পারে তা’ এই কাহিনীর মধ্যে সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
Previous Kaahon Theatre Review:
মূল চরিত্র তৃষা দর্শকদের একটা গল্প বলে, একটা খুনের গল্প, এবং খুনটা সে-ই করেছে। খুনের কারণ জানাবার জন্য সে তার জীবনের গল্প বলে। ছোটবেলায় সে পড়াশুনায় বেশ খারাপই ছিল। শিক্ষক বাবা ছিলেন ভীষন কড়া ধরণের মানুষ, অনুশাসনের মধ্যে সবাইকে বেঁধে রাখতে চাইতেন, তার অনুমোদন ছাড়া কোনও কাজ হত না। বাবার প্রিয় ছাত্র নির্মাল্য ছিল পড়াশোনায় দুর্দান্ত, সেই কারণে তিনি তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। পড়াশোনার সূত্রে বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল অবাধ। ছোটবেলা থেকেই তৃষার বাবা নির্মাল্যর সাথে তুলনা টেনে তাকে বোঝাতে চাইতেন যে সে কত খারাপ। নির্মাল্যও তৃষাকে ভীষণ অবহেলার চোখে দেখত, তার অস্তিত্ব নির্মাল্যের কাছে ছিল না বললেই চলে। পদে পদে বাবার অপমান আর নির্মাল্যের অবহেলা ছোটবেলা থেকেই তৃষার মনের মধ্যে একটা রাগের জন্ম দেয় যা ক্রমে প্রতিহিংসার রূপ নেয়। নিজেকে ‘ব্যাড গার্ল’ মেনে নিয়ে ‘গুড বয়’ নির্মাল্যের প্রতি তার প্রতিশোধস্পৃহা নিয়েই সে বড় হয়। পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনার পর বিদ্যুৎ-তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা শুরু করে নির্মাল্য। তৃষার বাবা তার প্রিয় ছাত্র নির্মাল্যের সাথে তৃষার বিয়ে ঠিক করে। তৃষা বিয়েতে রাজি হয় না এবং এই প্রত্যাখানের মধ্যে সে ভীষণ আনন্দ পায়। এখানেই থেমে থাকে না সে বিয়ে করে নিম্নরুচিসম্মত এক জমি বাড়ির দালাল বিলুকে। নিজেকে ‘ব্যাড গার্ল’ প্রতিপন্ন করে মনের ভিতরে প্রতিশোধের আগুনটা জ্বালিয়ে রাখে। এরপর একসময় সে এমনভাবে পরিকল্পনা করে তার স্বামীকে খুন করে যে খুনের জন্য নির্মাল্যও অভিযুক্ত হয়ে যায়। খুনের পরেই সে পুলিশকে সব কথা জানিয়ে দেয়। এভাবে প্রতিশোধ নিয়ে সে তৃপ্তি পায়। এখন গুড বয় আর ব্যাড গার্লের মধ্যে কোনো পার্থক্য রইল না, দুজনেই এখন খুনের আসামি।
অভিনয়ের ব্যাপারে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় তৃষার ভূমিকায় রায়তী ভট্টাচার্যের কথা। এই নাটকের সম্পূর্ণ রাশটি ছিল তার হাতে। নাটকের শুরু থেকে পরিণতিতে যাবার পথে কখনোই সেই রাশ তিনি আলগা হতে দেননি। তার জবানিতে সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণিত হয়, শুধু মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো অন্য চরিত্রেরা অভিনয়ের মাধ্যমে তাকে সঙ্গত করেন। সুস্পষ্ট উচ্চারণ, অনায়াস বাচনভঙ্গি, সাবলীল চলাফেরা, পরিস্থিতি অনুসারে কন্ঠের ব্যবহার, ও স্বাভাবিক অভিব্যক্তি দিয়ে রায়তী তৃষা চরিত্রটিকে এবং নাট্যটিকেও একদম সজীব করে তুলেছেন। দেবাশীষ তার শান্ত স্বাভাবিক ও মার্জিত অভিনয় দিয়ে নির্মাল্য চরিত্রটি সহজেই বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন। বিলু চরিত্রে অপূর্ব ঘোষ তার উচ্চারণ, কথা বলার ভঙ্গি, ও চলাফেরার মাধ্যমে চরিত্রের সামাজিক অবস্থান এবং স্বভাব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে বাবার ভূমিকায় শক্তিব্রত সিংহরায় নাট্যচলনের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে যে প্রচন্ড চিৎকৃত ও অতিনাটকীয় অভিনয় করলেন তা শুধু অস্বাভাবিকই নয়, নাট্যচলনে এবং দর্শকদের একাগ্রতায় প্রবল বিঘ্ন ঘটায়।
ছোট অন্তরঙ্গ পরিসরে বেশ কিছু আসবাব ও প্রপস দ্বারা অভিনয়ের স্থানটি গড়ে তোলা হয়েছে। মিক্সি, মাইক্রোওভেন, টোস্টার সহ বেশ কিছু প্রপ ছিল যার প্রতিটি সুন্দর ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আসবাব ও প্রপ এমনভাবে সাজানো হয়েছে তাতে চরিত্রদের স্বাভাবিক চলাফেরার কোন অসুবিধা হয় না। অভিনেতারাও সম্পূর্ণ পরিসরকে সুন্দর ভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন।
আলো ও আবহ পরিবেশ অনুসারে একেবারে পরিমাণ মতো মেপে পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রক্ষেপনের কাজটিও অত্যন্ত সুচারু রূপে এবং সুনিপুণ ভাবে করা হয়েছে ফলে নাট্য পরিবেশনে সুন্দর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়েছে যা প্রযোজনটিকে অবশ্যই সমৃদ্ধ করেছে।
একটি গল্পের স্বাদ সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ন রেখে অন্তরঙ্গ পরিসরে দর্শকদের কাছে মুন্সীয়ানার সাথে যে নাট্যটি পরিবেশিত হল তা’ বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। দর্শকরাও তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়ে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে রইলেন। এ রোমাঞ্চ শুধুমাত্র গল্পের নয়। মঞ্চ, আলো, আবহ, ইত্যাদি সঙ্গী করে নির্দেশক যেভাবে পুরো ব্যাপারটি আমাদের সামনে পরিবেশন করলেন তার মধ্যেও একটা রোমাঞ্চ ছিল। অন্তরঙ্গ পরিসরকে কিভাবে ব্যবহার করলে দর্শকদের সহজেই তার সাথে একাত্ম করে ফেলা যায় তার পাঠ পাওয়া গেল এই পরিবেশনায়।