একনায়কের শেষ রাত – নাটকের মূলবিষয় হারিয়ে গেল বিনোদনের আড়ালে

Posted by Kaahon Desk On June 29, 2019

একনায়কের শেষ রাত। হযবরল’র নতুন নাটক। রচনা ও নির্দেশনা চন্দন সেন। এই নাটকের নায়ক একজন একনায়ক। কিন্তু তিনি সে অর্থে নায়ক নন। তাঁকে আসলে অ্যান্টিহিরো বলা চলে। তাঁর চলন-বলন হিরোরই মত, কিন্তু চরিত্রটা হিরোদের মত সাদা, সুন্দর এবং উজ্বল নয়। বরং কালো, কুৎসিত এবং অন্ধকার মেশানো বেশ মানুষ মানুষ। (আসলে সব মানুষই এক একজন অ্যান্টিহিরো এবং এক একজন একনায়ক।)

নাটকের প্রেক্ষাপট বিদেশজ। আসলে নাটকের প্রেক্ষাপট মেটাফরিকাল। (মেটাফরিকালঃ যখন একটা কিছু দেখিয়ে মিন করা হয় অন্য কিছু। যেমন বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মিন করা “আমার তাতে কাঁচকলা”। এখানে কি দেখিয়ে কি মিন করা হয়েছে সেটা বুঝতে গেলে নাটকটা দেখতে যেতে হবে)। নাটকে আমরা দেখতে পাই এক একনায়ককে যার রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, দেশ চালানো ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা স্বচ্ছ, স্পষ্ট এবং ভণিতাহীন। যার খারাপ হতে কোন খারাপ লাগা নেই, যিনি ক্ষমতায় থাকার জন্য যা খুশি করতে পারেন। তাঁর ব্যবস্থায় সমস্ত ‘তন্ত্রের’ উঁচুতে বসে রয়েছেন তিনি এবং মনে করছেন এভাবেই দেশ চালাতে হয়। আসলে নির্দেশক আঙ্গুল তুলেছেন সেইসমস্ত দেশচালক (রাজ্যচালক?)দের দিকে যারা মুখে বলেন গণতন্ত্রের জয়, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সেই একনায়কেরই মত করেই বিচরণ করেন।

Previous Kaahon Theatre Review:

নাটকের একনায়ক বলে কয়ে সেই সমস্ত কাজ করেন যা আজকের গণনায়কেরা অন্য কোন তকমার আড়ালে করছেন। দেশের অতীত পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা, সংখ্যালঘুদের গল্প বদলে দেওয়ার ছক, বইয়ের পাতায় বিকৃত ইতিহাস প্রমোট করা… সব, সব দেখতে পাই এই নাটকে। এই নাটকের সবচেয়ে বড় জোর, এই নাটক ভীষণ ডিরেক্ট। এই নাটকেই আমরা শুনতে পাই- “পাবলিকের এখন ইডিওটিক মন্তব্য শুনতে কোন অসুবিধে হয় না। ওটা অভ্যেস হয়ে গেছে।“  , “রুলিং পার্টির নেতারাই সরকারকে সারাক্ষণ রক্ষা করলে সরকারের ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেবে কে” এবং “আসলে বুদ্ধিজীবীরা কোন অনুগ্রহেই আগ্রহ হারান না”-এর মত স্পষ্ট মন্তব্য। নাটকের একনায়ক টিকে থাকার জন্য নির্দ্বিধায় গণহত্যা করেন, মনে করেন বিধিসম্মত বিরোধিতায় কখনো কোন একনায়ককে পরাজিত করা সম্ভব না এবং যে শাসন ব্যবস্থায় সরকার বিরোধীদের রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা দেয় এবং নিজের সরকার কে চোখের মণির মত রক্ষা করতে চায়, সে গণতন্ত্র আসলে কোন ভণ্ড অটোক্র্যাটের একনায়কতন্ত্র। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন আমি ক্রুড আর তোমরা রিফাইন্ড, আমি নিজের অবস্থান ডিক্লিয়ার করতে ভয় পাইনা কারণ আমার একটা অবস্থান আছে। শুরু থেকেই তাঁর কাছে লোকসভার আসনের হিসেব, বিরোধীপক্ষের কার্যকরিতা, সংখ্যালঘুদের কাজে লাগানোর উপায় পরিষ্কার। বুঝতেই পারছেন নাটকটি আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেমন উপযোগী তেমন গুরুত্বপূর্ণ।

নাটকটা বেশ টানটান করে লেখা। চন্দন সেন অভিজ্ঞ নাট্যকার। তাঁর কাছ থেকে পোক্ত বাঁধুনির নাটকই এক্সপেক্টেড। কিন্তু নাটকের ভাষা বড্ড বই খাতার ভাষার মত, যেন বিদেশী নাটকের নড়বড়ে অনুবাদ। চরিত্ররা যে ভাষায় কথা বলেন তা মানুষের কথ্য ভাষা নয়। প্রেক্ষাপট বিদেশী, কিন্তু অভিনেতাদের অভিনয়ের ধরণ একেবারে বাঙ্গালি। বাঙালির মুখের ভাষায় নাটকটা লেখা যেত না? অভিনেতারা বেশীরভাগই বেশ দুর্বল । দেবশঙ্কর হালদার তাঁর বিখ্যাত ভোকাল ও শরীরী অভিনয় দিয়ে একা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গেছেন এই নাটক। কিন্তু তাঁর কাঁধে বোধ করি চাপটা একটু বেশীই পড়ে যাচ্ছে আজকাল। দর্শক তাঁর থেকে অভিনেতা হিসেবে আরও অনেক অনেক অনেক বেশী আশা করে। নাটকের মিউজিক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিখ্যাত কিছু ইংরিজি গানের ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যেমন হ্যারি বেলাফন্টের জামাইকান ফেয়ারওয়েল, শাকিরার দিস টাইম ফর অ্যাফ্রিকা ইত্যাদি। সেট লাইট নাটকের সাথে মানানসই। বিশেষত সেগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়নি বলেই নাটকের কন্টেন্ট এত ভাল করে প্রকাশিত হয়েছে। এই নাটক আরও একবার প্রমাণ করে বিষয়বস্তুই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কি বলতে চাইছি সেটা স্পষ্ট ও প্রয়োজনীয় হলে দর্শকের কাছে পৌঁছতে সে অর্থে আর কিছু লাগে না।

Eknayoker Shesh Raat –Trivialization of contextby much dependence on entertainment quotient

নাটকটি যুগোপযোগী, অবশ্য-দ্রষ্টব্য, এই সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় একটি কাজ। কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। আসলে নাটক যতক্ষণ না সাধারণ মানুষের কথা বলে, যতক্ষণ না জীবনের কথা বলে, ততক্ষণ তা সম্পৃক্ত বা সম্পূর্ণ নয়। দেশের অবস্থা তো দেখতে পেলাম আমরা। কিন্তু দেশবাসীর কি অবস্থা? এ হেন একনায়কের পাল্লায় পড়ে কিভাবে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষের? কারুর খামখেয়ালীপনায়, কারুর রাজনৈতিক চালে, কারুর লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে কিভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে জনগণকে? কি ভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে তার স্বাভাবিক অধিকার? কিভাবে বেঁচে থাকাটুকুও হয়ে যাচ্ছে সংশয়াকীর্ণ? এসব নিয়ে নাটক কিছুই বলে না। মানুষেরই বা এই গণবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে কি করা উচিৎ? কিচ্ছু বলা নেই। তাই এই নাটক সকলের কাছে পৌঁছোয় বটে, কিন্তু পৌঁছোয় এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে। অথচ এই নাটকের বিষয়বস্তু ভীষণ ভয়াবহ। প্রায় হরর স্টোরির মত। এর মধ্যে শক্তি ছিল দর্শককে নাড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু দর্শক শেষ অবধি নির্বোধের মত নিজেদের সিচুয়েশন নিয়েই হাসাহাসি করে ক্ষান্ত হয়, দলগত রাজনৈতিক ক্রিটিসিজম নিয়ে মজা পায়, কিন্তু সময়ের ভয়াবহ রূপটি তাঁদের সামনে ফুটে ওঠে না। তাঁরা বুঝতেও পারেন না এমন এক একজন একনায়ক কিভাবে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে দিয়েছে এক একটা জেনারেশনের জীবনের স্বাভাবিকতা, কিভাবে তাঁর নিজের এবং আশেপাশের প্রতিটা জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে, তাঁরা বুঝতেও পারেন না, যা দেখে তাঁরা মনোরঞ্জিত হচ্ছেন তা আসলে তাঁদের মাথার উপর ঝুলতে থাকা ধারালো খাঁড়া বা পায়ের নীচে প্রথিত হওয়া অ্যাটম বোমের গুরুগুরু। এই নাটকের এইটুকু দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ ছিল।

 

Ebong Ipsita
A Kolkata based theatre practitioner, she has been doing theatre from 2005 and now she is co-directing and adapting plays for different theatre groups in Bengal. She believes to explore the web medium as well to express herself to the world.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us